ধর্ম ও মাতৃভাষা

মাতৃভাষার গুরুত্ব

“সালাম সালাম হাজার সালাম,
সকল শহীদ স্মরণে,
আমার হৃদয় রেখে যেতে চাই,
তাদের স্মৃতির চরণে …

মায়ের ভাষায় কথা বলাতে
স্বাধীন আশায় পথ চলাতে
হাসি মুখে যারা দিয়ে গেল প্রাণ
সেই স্মৃতি নিয়ে গেয়ে যায় গান।

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙ্গানো
একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া
এই ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?

দুনিয়ায় বাঙালিদের মত আর কোন জাতি মাতৃভাষার জন্য সংগ্রাম করে নি। এইজন্য আমরা প্রত্যেক বছর ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহীদদের কথা স্মরণ করি, শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ অর্পন করি। তবে শুধু তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনেই যেন সব শেষ না হয় – এই একুশে ফেব্রুয়ারিতে মাতৃভাষার গুরুত্ব নিয়ে আমাদের গভীরভাবে চিন্তা করা উচিত। তাই আসুন আমরা এই বিষয়ে একটু চিন্তা করি।

ভাষার প্রতি আমরাও যেন দেখাই আমাদের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা; সম্ভব হলে এই ভাষার উৎকর্ষে আমরাও যেন কাজ করি।

মাতৃভাষা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা কী?

বিদেশী ভাষা পুরাপুরি আয়ত্ত করা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। একজন বিদেশী ভাষার ছাত্র যতই আগ্রহ থাকুক ও কঠোর পরিশ্রম করুক না কেন, তার উচ্চারণ এবং ব্যাকরণের জ্ঞান সবসময় একজন দেশীয় নিরক্ষর কৃষকের চেয়ে দুর্বল থাকবে। প্রত্যেক সমাজে মানুষের ভাষার ব্যবহারে তার বুদ্ধি যাচাই করা হয়। এইজন্যে, একজন বিদেশী বক্তার পক্ষে দেশী বক্তার সঙ্গে তর্কে পেরে ওঠা প্রায় অসম্ভব, কারণ তিনি তার স্বল্প ভাষাজ্ঞানের কারণে যুক্তি প্রকাশে অসমর্থ। যেমন, পাকিস্তান আমলে কোন বাঙালি একজন পাকিস্তানীর সঙ্গে উর্দু ভাষায় বিতর্কে জিততে না।

বাংলা ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হওয়ার প্রয়োজন কি ছিল? ইতিহাসে আমরা শিখি যে সাম্রাজ্যবাদের একটি প্রধান কৌশল হচ্ছে অন্য দেশে তাদের নিজ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে ঘোষণা করা। এইভাবে তারা সেই জাতিকে সহজে দমনে রাখতে পারে, কারণ ঐ জাতির নেতারা যতই বুদ্ধিমান হোক না কেন, তারা কখনও সমানভাবে সাম্রাজ্যবাদী জাতির লোকদের সঙ্গে যুক্তিতর্কে পারবে না এবং সবসময় তাদের ঠকানো যাবে। সেই দমনে-রাখা দেশের লোক সবসময় চিন্তা করবে যে, বড় বা প্রভাবশালী হতে হলে সেই সাম্রাজ্যবাদীদের ভাষা ভালভাবে শিখতে হবে। এইভাবে সমাজের বড় নেতারা সবসময় সেই বিদেশী ভাষা শেখার চেষ্টা করেছেন যা কখনই তাদের পক্ষে পুরাপুরি আয়ত্ত করা সম্ভব ছিল না। এই ব্যর্থতার ফলে তাদের সবসময় সমাজের নিচু স্তরে থাকতে হয়েছে। যেমন ধরুন, ইংরেজ কোম্পানী তাদের শাসনকালে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের নিজের ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। এইজন্য ভারতবর্ষের নেতাদের ইংরেজি ভাষা ও নিয়ম শিখতে হয়েছে। পাকিস্তানী নেতারা যখন আমাদের পিতৃপুরুষদের উপর এইভাবে উর্দূ ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করল, তখন তারা প্রচণ্ড বাধার সম্মুখে সংগ্রাম করেছিল, কারণ উর্দূ রাষ্ট্রভাষা হলে বাঙালি জাতি সবসময় উর্দূভাষীদের নিচে থাকত। এইজন্য আমাদের জাতির হাজার হাজার মানুষ মাতৃভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছেন।

ধর্মের ক্ষেত্রে মাতৃভাষা

তাহলে এই ধারা দেখা যায়, যে এক জাতি অন্য জাতিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের নিজের ভাষা ও সংস্কৃতি অপর জাতির উপরে চাপিয়ে দেয়। অন্য জাতিকে নিয়ন্ত্রণের এই কৌশল প্রায় সকলে জানে, কিন্তু ধর্মের ক্ষেত্রেও যে এটা ঘটে সেটা খুব কম লোকই লক্ষ করে।

ইতিহাসে দেখা যায় প্রত্যেক ধর্মে ধর্মীয় পেশাদার গোষ্ঠী গড়ে উঠেছে। এদের মধ্যে অনেকে আন্তরিকভাবে আল্লাহ্‌র পথে মানুষকে পরিচালনার শিক্ষা দেয়। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে, এমন ধর্মীয় নেতারা ঐশী তথ্য শিক্ষা না দিয়ে বেশি চিন্তা করে কীভাবে তারা তাদের নেতৃত্বের মাধ্যমে ক্ষমতা ও প্রভাব বৃদ্ধি করবে।

ধর্মীয় জ্ঞান নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে, ধর্মীয় পেশাদাররা তাদের ধর্মীয় জ্ঞানের চাহিদা সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এছাড়াও তারা দেখাতে চান যে, এদের ধর্মীয় পদ্ধতি অন্যান্য সব ধর্মীয় পদ্ধতির চেয়ে স্রেষ্ঠ। এটা না করলে, মানুষ হয়ত এদেরকে ছেড়ে অন্য ধর্মীয় পথে যাবে। এইভাবে দেখা যায় যে নিজের ধর্মীয় পদ্ধতির দুর্বলতা অস্বীকার করা বা ঢেকে রাখার একটি বর প্রলোভন আছে।

একটি উদাহরণ – দু’হাজার বছর আগে রোম সাম্রাজ্যের অনেকে ইহুদী-ধর্মের একেশ্বরবাদের প্রতি আকৃষ্ট হল। অনেক অ-ইহুদী লোক ইহুদী ধর্ম গ্রহণ করেন। কিন্তু সেকালের ইহুদী সমাজ গর্ব করে ভাবত যে তাদের তৌরাত শরীফ যেহেতু তাদের নিজের হিব্রু ভাষায় নাজেল হয়েছিল তাই সেই ভাষা একটি স্বর্গীয় বা ঐশী ভাষা (לשון הקודש লেশন হা-কোদেশ)। এজন্য তারা অ-ইহুদী হানাফীদের তাদের যার যার মাতৃভাষায় প্রার্থনা না করে যে ভাষা তারা বুঝতো না সেই হিব্রু ভাষায় প্রার্থনা করতে বলল। এটি আল্লাহ্‌র আদেশের বিপরীতে হল, কারণ আল্লাহ্‌ইহুদী জাতিকে পৃথিবীর কাছে তাঁর সংবাদ পৌঁছানোর দায়িত্ব দিয়েছেন। কিন্তু ইহুদী বা ইস্রায়েলীয়রা আল্লাহ্‌প্রদত্ত সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছিল। এই ব্যর্থতার আংশিক কারণ হচ্ছে যে, তারা মনে করতো যে, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতি অন্য জাতির চেয়ে উন্নত।

তেমনিভাবে, চীনের বৌদ্ধ ও কনফুশীয় ধর্মে চীনের জটিল লেখার পদ্ধতি একটি স্বর্গীয় ভাষার মত ধারনা করা হত, জনগণের কাছ থেকে ধর্মগ্রন্থের শিক্ষা দূরে রাখার জন্য। এই চল্লিশ-হাজার-অক্ষরের লেখার পদ্ধতি শিখতে জনসাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থাকত, কারণ অক্ষর-পরিচয় শিখতে ৩-৪ হাজার অক্ষরের মুখস্থ করা লাগে। কোরিয়ান ‘হাঙ্গুল’ বর্ণমালার মত আর কোন সহজ বর্ণমালা ছিল, কিন্তু কনফুশীয় ধর্মযাজকরা তা নিষেধ করে বলত যে, ধর্মে শুধু সেই কঠিন বর্ণমালা ব্যবহার করা চলবে।

শত শত বছর আগে আর্য ব্রাহ্মণরা যখন বঙ্গে সিন্ধু এলাকা থেকে এসেছিল, তখন তারা স্থানীয় দ্রাবিড়দের বলত যে, আর্য ভাষা, অর্থাৎ সংস্কৃত হচ্ছে ঐশী ভাষা, এবং তাদের বাংলা ভাষাটি ধর্মের ক্ষেত্রে ব্যবহারে অযোগ্য। এইভাবে সেই আর্য-ব্রাহ্মণ শ্রেণী শত শত বছর ধরে তাদের নিজের স্বার্থে ধর্ম নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ধর্মশাস্ত্র পড়া এবং প্রার্থনা করা যায় শুধু সংস্কৃতে; তার মানে ঈশ্বর শুধু সংস্কৃত গ্রহণ করে, বাংলা নয়।

 

ঐশীভাষাচিন্তাধারার ফলাফল

এই সব ক্ষেত্রে, মাতৃভাষা অস্বীকারের ফলাফল খুব ক্ষতিকর। এক দিকে ঐশী ভাষা একটি ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ রাখার কৌশল হয় এক জাতি অন্য জাতির প্রতি। বিদেশী ধর্মীয় পেশাদাররা এবং তাদের দালালরা শক্তভাবে ধর্মের শিক্ষার অধিকার ধরে রাখে এবং সাধারণ মানুষের শাস্ত্র-অজ্ঞতা শোষণ করে বা সুযোগ লয়ে। যেহেতু মানব-জাতির ক্ষমতা অপব্যবহার করার একটি প্রবণতা আছে, সেহেতু আমরা ইতিহাসে বারবার দেখি ‘ঐশীভাষা’র কারণে ধর্মের মাধ্যমে সত্যকে ঢেকে রাখা, যেমন ব্রাহ্ম্যবাদে আর্যরা যেভাবে দেশী “ম্লেচ্ছ”-দের আয়ত্ত করেছেন। অপরঞ্চ, অনেক ধর্মীয় নেতারা তাদের ধর্মগ্রন্থের বিভিন্ন অরুচিকর অংশ ঢেকে রাখে। তাদের নিজের মর্যাদা বা প্রভাব যেসব অংশ অস্বীকার করে বা তাদের ধর্মীয়ধারার দুর্বলতা প্রকাশ করে এমন ধর্মীয়গ্রন্থের অংশ তারা ঐশীভাষার মাধ্যমে জনগণের কাছে ঢেকে রাখে এবং অস্বীকার করে।

ইতোমধ্যে, সাধারণ মানুষ ধর্মীয়গ্রন্থ সম্পর্কে অজ্ঞ থাকে এবং কিতাবের মূলশিক্ষাগুলো না বুঝে অবুঝ বাহ্যিক সম্মান দেখায়। এই ধরণের ঐশীভাষা চিন্তা বিশ্বজগতে যেখানেই থাকে সেখানে জনগণ মনে করে যে ধর্মীয়গ্রন্থের মূল ব্যবহার হচ্ছে যাদু হিসাবে, মন্ত্র হিসাবে, তাবিজ হিসাবে এবং সঠিক উচ্চারণে পড়ে সওয়াব পাওয়ার জন্যে, বুঝে পালন করার জন্য নয়। তারা কখনও বুঝতে পারে না যে সত্য ধর্ম হচ্ছে সৃষ্টিকর্তার সাথে সম্পর্ক রেখে তার প্রত্যেক কথার অনুসারে সৎভাবে জীবন যাপন করা। ধর্মযাজকের শিক্ষায় তারা মনে করে যে ধর্মের কাজ হল উপাসনার সমস্ত ক্রিয়া বিদেশী ভাষায় সঠিকভাবে উচ্চারণ করা। সৃষ্টিকর্তা যে প্রার্থনা বা উপাসনা গ্রহন করেন, তা যান্ত্রিকভাবে মুখস্থ-করা মন্ত্র নয়, তা হল অন্তরের কথার প্রকাশ, এবং অন্তরের কথা প্রকাশ হয় শুধু মাতৃভাষাতে। ঐশীভাষা-বিশ্বাসীরা অসংখ্য বছরের অধ্যয়ন নষ্ট করেছেন তাদের ঐশীভাষার রহস্যকর অক্ষরের ঐশী গুহ্যের সন্ধানে, সংস্কৃত হউক, আরবি হউক, বা চৈনিক-ভাষা হউক। এমনকি এই চিন্তার কারণে অনেকে সেই ঐশীভাষার সংকৃতি অনুসারে কাপড়-চোপর পরে সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করার লক্ষ্যে। ব্যঙ্গার্থে তাদের নিজের ভাষা একদম আশাহীন নিম্ন ভাষা যার উৎকর্ষের কোনো লাভ নেই।  যেমন বর্তমান সিরিয়াবাসীরা তাদের ঐতিহ্যিক ফিনিশীয় মাতৃভাষা ত্যাগ করে এখন শুধু আরবীতে কথা বলে যুদিও তারা বংশগত আরব-জাতির লোক নয়। উত্তর আফ্রিকা এবং পালেস্টাইনের অধিকাংশ “আরবী” লোক সত্যিকারের আরবী লোক নয়—এরা তাদের আদী মিশরীয়, ফিনিশীয়, ক্যালডীয় মাতৃভাষা ত্যাগ করে এখন আরবী গ্রহণ করেছেন।                          

আবার ধর্মে বিবর্তন বা পরিবর্তন সহজে ঢুকে যায় যখন মাতৃভাষার অনুবাদের অস্বীকার করা হয়। ধর্মগ্রন্থের জ্ঞান শুধু ধর্ম পেশাদারদের ব্যাখ্যার মারিফতে পাওয়া যায়, জনসাধারণ মানুষ যারা সেই ঐশীভাষা ভালোভাবে আয়ত্ব করতে পারি না তারা সহজে ধর্মপেশাদারদের সব কথা বিশ্বাস করে, যদি তা কোন এক ঐশীভাষার বাক্য দিয়ে বলা হয়।  বাংলাদেশের সাহিত্যিক সৈয়দ মুজতবা আলী বলতেন যে মুঘল রাজ্য এমনভাবে ফারসি ভাষা আমাদের বাঙালীদের উপর চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করতেন বার বার।

বৌদ্ধধর্মে এইরকম হয়েছে আজকাল, কারণ তারা মাতৃভাষার ধর্মীয় ব্যবহার অস্বীকার করেছেন। অধিকাংশ বৌদ্ধধর্মাবলম্বীরা বর্তমানে যে ধর্ম করে তা গৌতম বৌদ্ধ যদি আজকাল বেঁচে থাকতেন তিনি চিনতে পারতেন না। সাধারণ মানুষ যদি প্রাচীন পালি ভাষায় ধর্মগ্রন্থ না পড়ে মাতৃভাষায় গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা পড়তেন তাহলে তারা বুঝতে পারতেন কীভাবে বোদ্ধধর্মের কেন্দ্রস্থল পরিবর্তন হয়ে গেছে – ব্যাক্তিগত ত্যাগের মাধ্যমে মুক্তি থেকে এখন শুধু ভিক্ষুসমাজ সংঘের সেবার মাধ্যমে মুক্তি পাওয়া। আজকাল বোদ্ধ সমাজে যত মর্তিপুজা হয়, জনগণ যদি মাতৃভাষায় ধর্মগ্রন্থ পড়তেন তাহলে তারা বুঝতে পারতেন যে গৌতম বুদ্ধ মূর্তিপুজা অপচন্দ করতেন। কিন্তু ঐশীভাষার আড়ালে ধর্মপেশাদার সমাজ শত শত বছর ধরে তাদের নিজের স্বার্থে এই অজ্ঞতা রক্ষা করেছেন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।