ঈসায়ীদের মধ্যে প্রধান প্রধান দলগুলো কী কী?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

ঈসায়ীদের মধ্যে প্রধান প্রধান দলগুলো হলো: খ্রিস্টান, ঈসায়ী, ঈসায়ী মুসলমান ও মুসলমান।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

বিশ্বব্যাপী হজরত ঈসা মসীহের উম্মতেরা বিভিন্ন পরিচয়ে পরিচিত। এ দেশে নিজেদের পরিচয় দিতে গিয়ে, হজরত ঈসার উম্মতেরা চারভাবে পরিচিত: খ্রিস্টান, ঈসায়ী, ঈসায়ী মুসলমান এবং মুসলমান।

খ্রিস্টান: এদেশে হজরত ঈসার ধর্মমত প্রচারের ইতিহাস প্রায় ৩০০ বছরের। প্রায় দুই’শ বছর আগে ব্রিটিশরা আসার আগেও ইউরোপিয়ানরাসহ অন্যান্য দেশ এবং জাতির লোকেরাও এই অঞ্চলে ব্যবসা করতে আসতো। আর সেই ব্যবসার সাথে সাথে ধর্মের সাথেও যুক্ত হতো আমাদের এদেশের লোকেরা। ব্রিটিশরা পাক-ভারতে আসার পর ব্যাপকভাবে হজরত ঈসার সুখবর প্রচার ও প্রসার ঘটে। তবে সেই সময় কিছু সাধারণ হিন্দু ছাড়া বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিম্নবর্ণের হিন্দু এবং আদিবাসীরা এই ধর্ম গ্রহণ করে এবং পাশ্চাত্যের প্রভাবে ও হিন্দু এবং আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতির মিশ্রণে তারা খ্রিস্টান পরিচয় লাভ করে। নিজের নামের সাথে একাধিক বিদেশী নাম যুক্ত করে তারা পূর্বেকার ধর্মীয় লোকদের থেকে নিজেদের আলাদা করে নেয়। তারা ইংরেজি ‘চার্চ’ শব্দকে মণ্ডলী, আল্লাহকে ঈশ্বর, ঈসাকে যিশু ইত্যাদি শব্দে অনুবাদ করে, দলগতভাবে বসবাস ও উপাসনাদি পালন করতে থাকে। মুসলমানদের মধ্য থেকেও কিছু লোক ঈসাকে বিশ্বাস করে এইরূপ মণ্ডলীর সাথে যুক্ত হয়। তারাও তাদের নাম ও মুসলিম ধর্মীয় রীতিনীতি পরিবর্তন করে, হিন্দু ধর্মীয় ভাষা-সংস্কৃতি ও রীতিনীতিতে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। পঞ্চাশের দশকে পাক-ভারত স্বাধীন হয়, ইংরেজরা এদেশ ছেড়ে চলে যায় কিন্তু তাদের স্থাপিত মণ্ডলীগুলো থেকে যায়। বেশিরভাগ রোমান ক্যাথলিক মণ্ডলীর লোকদের সাপোর্ট অভ্যাহত থাকে। বৃটিশ শাসনামলে রোমান ক্যালিক ও চার্চ অফ বাংলাদেশ মণ্ডলী স্থাপনের পাশাপাশি বেশকিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে। ফলে তাদের দ্বারা গণসংযোাগও হয় বেশি। খ্রিস্টান বলতে এদেশের মানুষ তাদেরকেই চেনে। লুথারেন, এ্যাংলিকান, প্রেসবিটারিয়ান ও ব্যাপ্টিস্ট চার্চগুলো মণ্ডলী স্থাপন করলেও তাদের এরূপ প্রতিষ্ঠান খুব একটা না থাকার কারণে, সমাজে তাদের পরিচিতি কম। যেভাবেই হোক না কেন বৃহত্তর সমাজ থেকে আগত লোকেরা খ্রিস্টান নামেই পরিচিতি পায়।

পরিবর্তন! ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করলেও ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত পাকিস্তান আলাদা হয়ে যায়। আর এই আলাদা হওয়ার মূলমন্ত্র ছিল ধর্ম ও সংস্কৃতি। হিন্দু ধর্মের ভাষা ও সংস্কৃতি মুসলমানদের ভাষা ও সংস্কৃতির সাথে কোনভাবেই মেলে না। পাকিস্তানবাসীরা সবাই ভেবেছিল একই ধর্মীয় লোক হয়ে তারা একই ভাষা-সংস্কৃতি চর্চা করে, নিজেদের উন্নতি করবে। কিন্তু এও ছিল ভুল। কারণ পাকিস্তান অখণ্ড ভৌগলিক সীমায় না থাকার কারণে এবং দুই অংশের দূরত্বের কারণে এখানেও আলাদা কৃষ্টি-সংস্কৃতি, রাজনীতি ও ভাষার সমস্যা দেখা দেয়। পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্বপাস্তিানিদের নিগৃহীত করে। এই সময় পাকিস্তানি ভাবধারায় এমনভাবে ইসলাম চর্চা হতো যে, কোন মুসলমান ইসলাম ছেড়ে অন্য ধর্ম গ্রহণ করবে তা কল্পনাই করা যেত না। তাই অতি সঙ্গোপনে যারা ঈসার পথে আসতো, তারা তাদের পরিচয় সম্পূর্ণ মুছে ফেলতো, নামধাম পরিবর্তন করে, একেবারে খাঁটি খ্রিস্টান হয়ে যেতো। মুসলমান থেকে খ্রিস্টান হবার পর, স্বাভাবিক কারণেই তাদের সাথে তাদের নিজের পরিবারের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে যেতো। হিন্দু সংস্কৃতি লালন পালনের কারণে, অনেকে খ্রিস্টান নাম নিয়ে মা-বাবা, আত্মীয়-পরিজন থেকে চিরদিনের জন্য আলাদা হয়ে যেতো এবং এখনও অনেকে আলাদা হয়ে আছে।

ঈসায়ী-অগ্রগতির প্রথম সোপান: উগ্র মৌলবাদিতা ও ধর্মান্ধতার কারণে পাকিস্তানি শাসনের ২৪ বছর ধরে, একই ধরণের সমস্যা চলছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর থেকে পরিবর্তনের হাওয়া লাগে। ভাষা-সংস্কৃতির প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের সংবিধানে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার কারণে ধীরে ধীরে আরো বেশি লোক ঈসার উপর ঈমান আনে। আর এভাবে খ্রিস্টান মণ্ডলীগুলোতেই সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে আগত লোকের সংখ্যা ক্রমে বৃদ্ধি পেতে থাকে। তবে যেভাবে বাড়া দরকার ছিল সেভাবে বাড়েনি বরং যারা আসতো তারাও বাহ্যিক পরিবর্তনের ভয়ে, অনেকে ফিরে যেতো এবং অনেকে অনেকটা আত্মগোপন করার মতো খ্রিস্টান সমাজে বর্ণচোরা হয়ে থাকতো। কালক্রমে এই নতুন সমাজে আগত লোকেরাই আবিস্কার করল যে, তাদের ভাষা সংস্কৃতির বিষয় ভাবতে হবে। প্রচলিত চিন্তাধারা বাদ দিতে হবে। আর এই ভাবনা থেকেই শুরু হয় ইসলামি ভাষায় কিতাব অনুবাদের কাজ। অবশ্য ছোট ছোট অনুবাদের কাজ পাকিস্তান আমলের শেষদিকে কিছুকিছু শুরু হয়েছিল। নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। স্বাধীনতার পর অনুবাদের কাজ দ্রুত চলতে থাকে। প্রথমে ইঞ্জিল শরিফের আলাদা আলাদা খণ্ড বের হয় এবং শেষে ১৯৭৬ সালে পূর্ণ ইঞ্জিল শরিফ প্রকাশিত হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল থেকে আসা লোকদের জীবনে নতুন সূর্য দেখা দেয়। তারা ঈসায়ী হিসাবে পরিচিতি লাভ করে।

ঈসায়ী মুসলমান: প্রায় সকল নবিগণ ইহুদি ধর্ম থেকে আসলেও মুসলমানরা প্রায় সকল নবিদেরই তাদের নবি হিসেবে মানে এবং সকল নবিকেই মুসলমান দাবি করে। এতে নবিদের উম্মতেরা মুসলমান দাবি করতেই পারেন। নবিদের কথা কোরান শরিফে অনেকবার উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষত হজরত ঈসার কথা, তাঁর মা বিবি মরিয়মের কথা এবং হজরত ঈসার দুনিয়াতে প্রথম আগমন, কাজ, বেহেশতে চলে যাওয়া এবং দ্বিতীয় আগমনের কথা বহুবার বহুভাবে কুরান শরিফে উল্লেখ করা হয়েছে। যেহেতু বৃহত্তর সমাজ থেকে আগত ভাইবোনেরা আগে থেকেই হজরত ঈসার উপর ঈমান রাখে এবং মুসলমান হিসেবে পরিচিত, সেহেতু অনেকে নিজেদের ঈসায়ী মুসলমান হিসেবেও পরিচয় দেয়। একথা পরিষ্কার যে, হজরত ঈসার উপর ঈমানদার ঈসায়ীদের বিশ্বাস এবং মুসলমানদের বিশ্বাস আলাদা। কারণ ঈসায়ীরা হজরত ঈসাকে কেবল নবি হিসেবে বিশ্বাস করে না বরং নাজাতদাতা, মসীহ ও প্রভু বলে বিশ্বাস করে। ফলে ঈসার উপর এই আলাদা বিশ্বাসের কারণে ঈসায়ী; আবার আংশিক ইসলামি বিশ্বাস, রীতিনীতি ইত্যাদির কারণে নিজেদের ঈসায়ী মুসলমান দাবি করে।

মুসলমান: ঈসা নবির উম্মতদের প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট হলো আত্মসমর্পণ। এই আত্মসমর্পণের অনন্য উদাহরণ যিনি সৃষ্টি করেন তিনি হলেন হজরত ইব্রাহিম (আ.)। হজরত ঈসার উম্মতেরা ঈমানের দিক থেকে হজরত ইবরাহিমকে তাদের রুহানি পিতা বলে ডাকে। যে কোরবানি তিনি দিয়েছিলেন, তা দিয়ে তিনি প্রমাণ করেছিলেন যে, মানুষ ঈমান দ্বারাই নাজাত পায়, কোন ধর্মকর্মের মধ্যদিয়ে নয়। আসলে হজরত ইবরাহিমের আমলে কোন প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মকর্মই ছিল না। আল্লাহর প্রতি বাধ্য হয়ে জীবন কোরবানির (ঈমান-বাধ্যতা) মাধ্যমেই তিনি দেখিয়েছিলেন যে, মানুষকে ঈমানের মধ্যদিয়েই নাজাত পেতে হবে। আর সেই ধারা হজরত ঈসার শিক্ষার মধ্যেও রয়েছে। মসীহের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিজেকে সঁপে দেবার মধ্যদিয়েই ঈসায়ীদের নতুন জীবন শুরু হয়। আর জীবন চলে প্রতিদিনের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। ইঞ্জিল শরিফ বলে, “তোমরা তোমাদের দেহকে জীবিত, পবিত্র ও আল্লাহর গ্রহণযোগ্য কোরবানি হিসেবে আল্লাহর হাতে তুলে দাও।” মুসলমান শব্দের অর্থ আত্মসমর্পণকারী। হজরত ঈসা মসীহ নিজেও আল্লাহর প্রতি সমর্পিত হয়ে বেহেশত ছেড়ে দুনিয়াতে এসেছিলেন এবং নির্দোষ হয়েও দোষী মানুষের জন্য নিজের জীবন কোরবানি দিয়েছিলেন। একজন ঈসায়ীর জীবন হলো পরিপূর্ণ আত্মসমর্পণের জীবন। তাই একজন ঈসায়ী নিজেকে মুসলমান পরিচয় দেওয়ার মধ্যে কোন বাধা নেই বরং সত্য ও সুন্দরের ছোঁয়া আছে।

যারা মুসলমান হিসেবে পরিচয় দেয়, তাদের মধ্যে কেউ কেউ আছে, যারা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, পশু কোরবানিসহ মুহম্মদি মুসলমানদের মতো সব করে। তাদের মতে তারা এসব করে হজরত ঈসার নামে। এরূপ করার কারণ হিসেবে যা পাওয়া যায়, তা হলো- সামাজিক শান্তি রক্ষা, প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষা, সুখবর প্রচারের পরিবেশ তৈরি করা, অহেতুক ঝামেলা এড়ানো এবং ব্যাপক প্রচার ও প্রসার।

তাদের মতে, হজরত ঈসা নিজে ইহুদি পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, ভিন্ন ধর্মমত প্রচার করলেও এবং রুহানিভাবে আলাদা জীবনযাপন করলেও সামাজিকভাবে ইহুদির মতো চলতেন। দেখা যায়, তিনি ইহুদি সমাজঘরে যেতেন, শিক্ষা দিতেন এবং ইহুদিদের সাধারণ নিয়ম মানতেন। যদিও তাঁর ধর্মমত ইহুদি ধর্মমতের সম্পূর্ণ বিপরীত তবু তিনি তাঁর কোন সাহাবিকে ভিন্নতর সামাজিক জীবন যাপনে উৎসাহী করতেন না। যে বিষয়ে তিনি জোর দিতেন, তা হলো রুহানি পরিবর্তন। হজরত পৌলও নিজের জীবন দিয়ে শিক্ষা দিয়েছেন, ‘আমি ইহুদিদের কাছে ইহুদি এবং পরজাতির কাছে পরজাতির মতো হয়েছি’।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।