মসীহ্‌ সম্বন্ধে আপনি কী চিন্তা করেন?

লেখক: আবদ-আল-মসীহ্‌

অনুবাদ: মসীহী জামাত

প্রকাশক: মসীহী জামাত

প্রকাশকাল: অক্টোবর ২০০১


সূচিপত্র

মসীহ্‌ সম্বন্ধে আপনি কতটুকু জানেন?
মসীহের অলৌকিক জন্ম সম্বন্ধে আপনি কী চিন্তা করেন?
মসীহের অলৌকিক জন্ম
মসীহের বেগুনাহ্ জিন্দেগী সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?
মসীহের শিক্ষা থেকে আপনি কী বুঝেছেন?
মসীহের ক্ষমতা সম্বন্ধে আপনি কী চিন্তা করেন?
মসীহের দুঃখভোগ সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?
আপনি কি মৃত্যুর উপর মসীহের বিজয় উপলব্ধি করেছেন?
আল্লাহ্-পাকের কাছে মসীহের আরোহণ সম্বন্ধে আপনার কী ভাবনা?
মসীহের পৃথিবীতে-প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?
মসীহের নাম ও উপাধি থেকে আপনি কী বুঝেছেন?
মসীহের দাওয়াতের প্রতি আপনার কী প্রতিক্রিয়া?
পরিশেষে
পাঠক-পাঠিকার জন্য প্রশ্ন


মসীহ্‌ সম্বন্ধে আপনি কতটুকু জানেন?

জগৎ দ্রুততালে চূড়ান্ত লক্ষ্যপানে ধাবমান্। সকল বস্তুর ধ্বংস অতি নিকটে। প্রত্যেক অনুরাগী ও ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি জানেন যে, ঈসা-মসীহ আল্লাহ-পাকের কাছ থেকে আবার আসছেন। অবিশ্বাসীরা ভয়ে বিচলিত হয়ে যাবে। কারণ, ঈসা-মসীহ্ ও তাঁর প্রকৃত ক্ষমতাকে তারা অবহেলা করেছে।

আপনিও সেই মুহুর্তে অনুভব করবেন যে, আপনার এখনকার ও আখেরাতের জিন্দেগী এই চূড়ান্ত প্রশ্নের উপর নির্ভরশীলঃ “মসীহের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক কী”?

আপনি যদি মসীহের ব্যক্তিত্বের প্রকৃত ও বাতেনী অস্তিত্বকে হৃদয়ঙ্গম করে থাকেন, তাহলে তা প্রকাশ করুন, আনন্দে পরিপূর্ণ হোন- দেখবেন, আপনার জীবনের সব-কিছু সচল হয়ে উঠেছে, কেননা ঈসা-মসীহ্ সমস্ত জ্ঞান ও বিচক্ষণতার গোপন আধার। তিনি মহিমার সঙ্গে আসবেন। তিনি আপনাকে জিজ্ঞাসা করবেন, “আমার সম্বন্ধে তুমি কী চিন্তা করেছিলে?”

সময় থাকতে আমাদের সঙ্গে তাঁর জীবন সম্বন্ধে ধ্যান করুন- তাহলে আপনি তাঁর রহমৎ ও মহব্বতের মাধ্যমে আপনার হৃদয়ে সান্ত¦না পাবেন এবং আপনার সব সমস্যার সমাধান পাবেন।

মসীহের অলৌকিক জন্ম সম্বন্ধে আপনি কী চিন্তা করেন?

ঈসা-মসীহের মতো অন্য-কেউ কখনও আর জন্মগ্রহণ করেননি। কারণ, তিনি মরিয়মের পুত্র।

ইসমাইলকে বলা হয় ইব্রাহীমের পুত্র, ইয়াহিয়া-নবীকে বলা হয় জাকারিয়ার পুত্র, মুহম্মদকে বলা হয় আবদুল্লাহর পুত্র। এমনি করে সকল মানুষ পিতার কাছ থেকে নাম পায়। তবে কেন শুধু ঈসার নাম তাঁর মায়ের নামানুসারে রাখা হল? এর কারণ, অন্যান্য পিতার মতো তাঁর কোন পিতা ছিল না। তিনি একজন কুমারীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আল্লাহ-পাকের ক্ষমতা ও বেহেশ্‌তী উদ্দেশ্যের উপর নির্ভরশীল ছিল।

মসীহের জন্মের সাত শো বছর পূর্বে তাঁর জন্মের বৃত্তান্তের উপর ইশায়া-নবী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এই বলে:

“একজন কুমারী মেয়ের গর্ভ হইবে, আর তাঁহার একটি ছেলে হইবে; তাঁহার নাম রাখা হইবে ইম্মানুয়েল (এই নামের অর্থ এই- ‘আমাদের সঙ্গে খোদা’)।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ১৪:৭)

আল্লাহ্-পাক তাঁর ওয়াদা পূরণ করেছিলেন; কেননা তিনি বিশ্বাসী ও ন্যায়পরায়ণ, এবং তাঁর পক্ষে কোন-কিছুই অসম্ভব নয়।

আপনি কি জানেন যে, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ আল্লাহ্-পাকের কালাম? ইঞ্জিল শরীফের অনুপ্রাণিত বাণী পাঠ করুণ:

“প্রথমেই কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহ্-পাকের সঙ্গে ছিলেন … এবং সেই কালামই মানুষ হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন এবং আমাদের মধ্যে বাস করিলেন।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১: ১, ১৪

আল্লাহ-পাকের পবিত্র কালামের মধ্যে কর্মরত সমস্ত সৃষ্টিধর্মী ক্ষমতা মসীহ-রূপী সম্বন্ধে মনে মনে ধ্যান করলে আপনি বিস্ময়াভিভূত হয়ে যাবেন।

মসীহের অলৌকিক জন্ম

কারণ, কোন মানুষই মরিয়মের পুত্রের মতো নয়, তাঁর সঙ্গে তুলনীয় কেউ নেই। জন্মের দিক দিয়ে তিনি অদ্বিতীয়।

আপনার কি স্মরণ আছে যে, আদমকে মাটি দিয়ে পয়দা করা হয়েছিল? আমরা সবাই আদমের সন্তান, এবং এমন কি নারীরাও এই মাটি থেকেই সৃষ্ট। আমরা সবাই জাগতিক- নিচু থেকে সৃষ্ট; কিন্তু মসীহের জন্ম উপর থেকে। কারণ, তিনি বেহেশ্ৎ থেকে নিচে নেমে আসেন। তিনি পবিত্র, নির্দোষ ও পরিষ্কার- তুষারের মতো ধপধপে। কিন্তু আমরা সবাই অপবিত্র, দোষী, গুনাহে পূর্ণ। কারণ, আমরা জাগতিক, এবং কেউই আমরা রূহুল কুদ্দুস থেকে জন্মগ্রহণ করিনি।

কিতাবুল মুক্কাদ্দাসে আমরা একটা বিস্ময়কর বিবরণ দেখতে পাই যে, ঈসা-মসীহ জগতে আসেন গুনাহ্গারদের নাজৎ দেবার উদ্দেশ্যে। কেউই মসীহের স্থান নিতে পারে না। কারণ, আমরা সবাই মাটির তৈরী। কিন্তু ঈসা-রুহুল্লাহ্ সরাসরি আল্লাহ্-পাক থেকে পয়দা হন। তা সত্ত্বেও আমাদের মতো বিরক্তিকর মানুষকে তিনি অস্বীকার করেননি। বরং, এমন কি নাজাৎ-প্রদানের জন্য তিনি আমাদেরকে বাছাই করেন। আমাদের এই দুঃখময় জগতে তিনি আগমন করেন সেজন্যই। সুতরাং ঈসা-মসীহের, অলৌকিক জন্মের জন্য আমরা সবাই কৃতজ্ঞ- এজন্য আল্লাহ-পাকের হাজার শুক্রিয়া।

মসীহের বেগুনাহ্ জিন্দেগী সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?

ঈসা-মসীহ্ রুহুল কুদ্দুস থেকে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মাবধি তিনি ছিলেন বেগুনাহ্ ও পবিত্র। কখনও তিনি গুনাহ্ করেননি, একবারও না। কখনও তিনি কর্তব্যচ্যুত হননি। আমাদের মতো তিনি কখনও আল্লাহ্-পাকের কাছে মাগ্ফেরাৎ কামনা করেননি।

আমাদেরকে অবশ্যই নিজেদের গুনাহ্ স্বীকার করতে হবে। অন্যথায় আল্লাহ্-পাক এবং আমাদের নিজেদেরকে প্রতারণা করা হবে। আমরা তো আমরা-দাউদ-নবী অশ্রু-জলে বিগলিত হয়ে আল্লাহ্-পাকের কাছ মাগফেরাৎ কামনা করেছিলাম। ইব্রাহীম নবীও স্বীয় গুনাহের জন্য আল্লাহ্-পাকের দরবারে ক্রন্দন করেছিলেন। কিন্তু আপনি কিতাবুল মুকাদ্দাস বা কোরান শরীফ অনুসন্ধান করলে এমন কোন আয়াত বা নিদর্শন দেখতে পাবেন না, যাতে বলা হয়েছে যে, ঈসা-মসীহ্ মাগফেরাৎ কামনা করেছেন। না, একবারও না।

এখন বুঝতে হবে যে, যেহেতু তিনি ছিলেন নিখুঁত, নিষ্পাপ, তাই তাঁর নিজের সংশোধিত হয়ে দোষমুক্ত হবার কোন প্রশ্ন ওঠে না। তিনি তাঁর শত্রুদের খোলাখুলি প্রশ্ন করেছিলেন:

“আপনাদের মধ্যে কে আমাকে গুনাহ্গার বলিয়া প্রমাণ করিতে পারিবেন?”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ৮:৪৬

কিন্তু তাদের মধ্যে কেউই তাঁর কথায় বা কাজে কোন দোষ বের করতে পারেন নি। তাঁর বিচারের সময়ও রোমান উকিলের সামনে বিচারক আইনতঃ তিনবার স্বীকার করতে বাধ্য হন:

“আমি ইহার কোন দোষ দেখিতে পাইতেছি না।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৮:৩৮; ১৯:৪,৬

এমন কি একজন ভূতে-পাওয়া লোকের মধ্যে আশ্রিত ভূতও মসীহের আগমনে ভয়বিহ্বল হয়ে চীৎকার দিয়ে উঠেছিল:

“ওহে নাসরতের ঈসা,…. আপনি আমাদিগকে ধ্বংস করিতে আসিয়াছেন। আমি জানি, আপনি কে; আপনি তো খোদার সেই পবিত্র লোক!”

ইঞ্জিল শরীফ, মার্ক ১: ২৪

সুতরাং আজকের পৃথিবীতে এবং আখিরাতে বিচারের দিনে সবারই ভালভাবে জানা আছে যে, মসীহ্ স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে খাঁটি, পরিপূর্ণ ও পবিত্র। আর-কেউ তাঁর মতো নাই। কারণ, তিনি ছাড়া সবাই গুনাহ্ করেছে।

মসীহের শিক্ষা থেকে আপনি কী বুঝেছেন?

সকল নবী, রসূল ও সুসংবাদদাতা আল্লাহ্-পাকের কালাম-দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কিন্তু ঈসা-মসীহ্ হলেন স্বীয় অস্তিত্বে নিজেই আল্লাহ-পাকের কালাম। তাঁকে কেন্দ্র করেই আল্লাহ্-পাকের সমস্ত সৃষ্টিশীল ক্ষমতা ও মহব্বতের শক্তি আবর্তিত। তাঁর কথা শুধু মুখের কথা নয়- বরং তিনি যা বলতেন, তাই করতেন। তাঁর জীবনে কোন অন্তর্দ্বন্দ্ব বা ব্যক্তিতের কোন দ্বিধার ছোঁয়াটুকু পর্যন্ত পাওয়া যায় না। তাঁর কথায় ও কাজে আল্লাহ্-পাকের মহান্ ক্ষমতা স্পষ্টভাবে প্রতিভাত এবং তাঁর কথা ও কাজ পরস্পর-সম্পূরক।

বহু দৃষ্ঠান্তে তাঁর সম্বন্ধে অমরা এই প্রকারের বয়ান দেখতে পাই:

“যখন মসীহ্-ঈসা কথা বলা শেষ করিলেন, তখন লোকেরা তাঁহার কথায় আশ্চর্য হইয়া গেল, কারণ তিনি আলেমদের মতো শিক্ষা দিতেছিলেন না; বরং যাঁহার অধিকার আছে, সেই রকম লোকের মতোই শিক্ষা দিতেছিলেন।”

মথি ৭:২৮-২৯

যখন ঈসা-মসীহের বিরোধীরা তাদের চাকরদের সাহায্যে মসীহ্ কে আটক করতে চেষ্ট করে, তখন তারা তাঁর কথার দ্বারা বিচলিত হয়ে পড়ে এবং তাদের বিবেক কম্পিত হয়ে ওঠে। তাঁর কাছে ঘেঁষবার সহাসটুকু পর্যন্ত তারা হারিয়ে বসে। নিজেদের নেতাদের কাছে ফিরে এসে তারা বিড়বিড় করে বলতে থাকে:

“লোকটি যেভাবে কথা বলে, সেইভাবে আর তো কেউ কখনও বলে নাই।”

ইউহোন্না ৭: ৪৬

ঈসা-মসীহের কয়েকটি বাণী শুনুন, যা তিনি পূর্ণ বিনয়ের সঙ্গে উচ্চারণ করেন:

আমিই দুনিয়ার নূর; যে আমার পথে চলে, সে কখনও অন্ধকারে পা ফেলিবে না, বরং জীবনের নূর পাইবে।

ইউহোন্না ৮:১২

আমিই সেই জীবন-রুটি। যে আমার নিকট আসে , তাহার কখনও ক্ষুধা পাইবে না। যে আমার উপর ঈমান আনে, তাহার কখনও পিপাসাও পাইবে না।

ইউহোন্না ৬:৩৫

তোমাদের শত্রুদেরও মহব্বৎ করিও। যাহারা তোমাদের উপর অত্যাচার করে, তাহাদের জন্য মুনাজাতৎ করিও।

মথি ৬:৪৪

তোমরা অন্যের দোষ ধরিয়া বেড়াইও না, যেন তোমাদেরও দোষ ধরা না হয়; কারণ যেভাবে তোমরা অন্যের দোষ ধরো, সেইভাবে তোমাদেরও দোষ ধরা হইবে। আর যেভাবে তোমরা মাপিয়া দাও, সেই ভাবে তোমাদের জন্যও মাপা হইবে। তোমার ভাইয়ের চোখে যে কুটা আছে, কেবল তাহাই দেখিতেছ, অথচ তোমার নিজের চোখের মধ্যে যে কড়িকাঠ আছে, তাহা লক্ষ্য করিতেছ না কেন? যখন তোমার নিজের চোখেই কড়িকাঠ রহিয়াছে, তখন কেমন করিয়া তোমার ভাইকে এই কথা বলিতেছ, ‘এসো, তোমার চোখ হইতে কুটাটি বাহির করিয়া দিই’? ভণ্ড! প্রথমে তোমার নিজের চোখ হইতে কড়িকাঠটি বাহির করিয়া ফেলো, তাহাতে তোমার ভাইয়ের চোখ হইতে কুটাটি বাহির করিবার জন্য ষ্পষ্ট দেখিতে পাইবে।

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ৭:১-৫

তোমরা যাহারা ক্লান্ত ও বোঝা বহিয়া বেড়াইতেছ, সকলে আমার নিকট এস- আমি তোমাদের বিশ্রাম দিব। আমার জোয়াল তোমাদের উপর তুলিয়া লও এবং আমার নিকট হইতে শিখো, কেননা আমার স্বাভাব নরম ও নম্র। ইহাতে তোমরা অন্তরে বিশ্রাম পাইবে। কারণ, আমার জোয়াল বহন করা সহজ ও আমার বোঝা হাল্কা।

মথি ১১:২৮-৩০

আপনি যদি এ সব কালামের গভীরে প্রবেশ করেন তাহলে বুঝতে পারবেন যে, ঈসা-মসীহ্ই জগতের নূর, এবং যারা তাঁর কালাম মেনে চলে, তাদের তিনি অনন্ত শান্তি ও প্রকৃত জীবন দান করেন।

অন্য সকল নবী বেহেশতী নূরের অংশমাত্র নিয়ে এসেছিলেন, যা আমাদের অন্ধকার পৃথিবীকে চন্দ্রালোকের মতো মোলায়েম আলো দিয়েছে। অর্ধচন্দ্রের আলোর মতো তাঁরা ম্লান হয়ে গেছেন। কিন্তু ঈসা-মসীহের প্রজ্বলিত সূর্যের মতো, যা তার আলোর সমস্ত শক্তিসহ দীপ্তিমান্। সূর্য যখন দীপ্তিমান, তখন আমরা কেমন করে চাঁদের অনুসরণ করি? মসীহ্ই প্রকৃত নূর। কারণ, তিনিই আল্লাহ্-পাকের বাণী সম্পন্ন করে এবং নতুন শরীয়ৎ প্রকাশ করেন, যা ছিল মহব্বতে পূর্ণ ।

তিনি নিজেই মহব্বত, যিনিমানবরূপ ধারণ করেন। আর তাই তিনি যথাথই বলতে পারেন:

“আপই পথ, সত্য আর জীবন। আসমান ও জমিন শেষ হইবে, কিন্তু আমার কথা চিরদিন থাকিবে।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৪: ৬

মসীহের ক্ষমতা সম্বন্ধে আপনি কী চিন্তা করেন?

যিনি ঈসা-মসীহের কাজকর্ম নিয়ে ভাবেন, তিনি অনুধাবন করতে পারেন যে, তাঁর ক্ষমতা অসীম, কেননা সমস্ত বেহেশতী ক্ষমতা ও অধিকার তাঁকে সম্পূর্ণভাবে দেওয়া হয়ে। খোলাখুলিভাবে তিনি আল্লাহ্-পাকের কাজ নিষ্পন্ন করেন এবং তিনি যে কাজ করেন, কেউই তা করতে পারেনি।

তিনি তাঁর মুখের কথায় কুষ্ঠরোগীকে সুস্থ করে তোলেন, এবং তাঁর রহমতের দ্বারা অন্ধের চোখ খুলে যায়। ভয়ানক ঝড়কে তিনি কেবল তাঁর মুখের কথায় শান্ত করে দেন। ভৎসনা করে শয়তানদের তিনি তাড়িয়ে দেন এবং মাত্র পাঁচখানা রুটি ও দু’টি মাছ দিয়ে পাঁচ হাজার লোককে তৃপ্ত করেন। কেউ পূর্বে আর কখনও এমন কাজ করতে পারেনি।

কোন কোন নবী নিজের প্রভুর নামে সীমিত অলৌকিক কাজ করেছেন বটে, কিন্তু, ঈসা-মসীহ যা করেছেন, তা তিনি নিজের নামে নিজেরই অভিভূতকারী অধিকার বলে করেছেন।

লাসার নামের একটি লোকের কথা শুনুন। সে মারা গিয়েছিল এবং তাকে কবর দেওয়া হয়েছিল। তার ক্রন্দনরত আত্মীয়-স্বজন মসীহের কাছে সাহায্যের জন্য আসে। তিনি যেদিন তাদের গ্রামে গিয়ে পৌঁছান, তার চারদিন আগেই লাসারকে কবর দেওয়া হয়েছিল। লাসারের কবরের কাছে গিয়ে মসীহ্ খুব জোরে চীৎকার করে: “লাসার, বেরিয়ে এস” এবং মৃত ব্যক্তি সত্যই বেরিয়ে আসে।

আপনি যখন জীবনদানকারী বেহেশতী বাণী শুনবেন, শুনাহের দ্বারা আপনার যে রুহানী মৃত্য, তার থেকে আপনিও তখন জেগে উঠবেন। কারণ, মসীহ্ বলেছেন:

“আমিই পুনরুত্থান ও জীবন।”
ইউহোন্না ১১: ২৫

এমন একদিন আসবে, যখন সমস্ত মৃত-ব্যক্তি তাঁর বাণী শুনতে পাবে এবং আল্লাহ্-পাকের সঙ্গে বসবাসের জন্য কিংবা ভয়ঙ্কর একটা বিচারের জন্য জেগে উঠবে। আপনি যদি নিজের হৃদয়-মন মসীহের বাণীর জন্য খুলে দেন, তাহলে আনন্দময় ধামে প্রবেশ করে আপনিও অমর জীবন যাপন করতে পারবেন।

মসীহের দুঃখভোগ সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?

ঈসা-মসীহ্ যে মৃতুবরণ করেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। অনেক দুঃখভোগের পর তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি অগেই জানতেন, কেমন করে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। এ সম্বন্ধে তিনি প্রকাশ্যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন।

আপনি কি জানেন, আপনি কোথায় মারা যাবেন? আপনার নিজের শহরে, না রাস্তায়, না আপনার শয্যায়- কোথায় আপনার মৃত্যু হবে, কেউ কি তা বলতে পারে? আপনি কি দুর্ঘটনায় মরবেন, না স্বাভাবিক মৃত্যৃ হবে আপনার? কত বয়সে, কোন মাসে, কোন দিনে আপনি মারা যাবেন? আপনার মৃত্যুর পর আপনার আত্মীয় স্বজনের কী হবে?

সত্যি, আমাদের মৃত্যু সম্বন্ধে আমরা কিছুই জানি না। আমরা তো আমরা নবীরাও নিজেদের মৃত্যুর নির্ধারিত সময় জানতেন না। কিন্তু খোদবন্দ মসীহ্ জানতেন এবং পূর্বেই বলে দিয়েছিলেন যে, ইহুদী বিচারক ও পৌত্তলিক রোমানদের দ্বারা বিচারের পর এবং অনেক কষ্টভোগের পর জেরুজালেমে তিনি মৃত্যুবরণ করবেন। কখন মৃত্যুবরণ করবেন, সে সম্বন্ধে নিজের স্বাধীন ইচ্ছায় নিজেই সিদ্ধান্ত নেন।

দিনই ছিল ইহুদীদের ভোজন-পর্বের দিন। লোকেরা ঐ দিন ভেড়া কোবারানী করত, যেন রক্ত ঝড়ার ফলে আল্লাহ্-পাকের গজব তাদের উপর আপতিত না হয়।

সুতরাং, সেই দিন আল্লাহ্-পাকের মেষ-শাবক আমাদের কলুষিত কর্মফল নিজের উপর বহন করে, সারা জগতের গুনাহের বোঝা নিজের কাঁধে চাপিয়ে নিয়ে কোরবানী হন, যেন তাঁর উপর যিনি ঈমান এনেছেন, তেমন প্রত্যেক ব্যক্তির উপর থেকে আল্লাহ্-পাকের গজব সরে যায়। যিনি মসীহের উপর ঈমান আনেন, তিনি পূত-পবিত্র হয়ে যান, বেগুনাহ্ ও নির্দোষ প্রতিপন্ন হন এবং অনন্তকালের জন্য মুক্তিলাভ করেন।

ঈসা-মসীহ যে কেবল তাঁর মৃতুর দিন-ক্ষণ এবং তার অর্থ ও তাৎপর্য সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তাই নয়- বরং তিনি তার উম্মৎদেরকে পূর্ণ নিশ্চয়তা দেন যে, তিনি তিনদিন পর মৃত্যু থেকে পুনরুত্থান করবেন, কেউ তাঁর এই বিজয়দীপ্ত পুনরুত্থানে বাধা দিতে পারবে না। এবং যথার্থ তাই-ই হয়েছিল।

ঈসা-মসীহ্ আরও বলেছেন:

“কেহই আমার প্রাণ আমার নিকট হইতে লাইয়া যাইবে না, কিন্তু আমি নিজেই তাহা দিব। প্রাণ দিবার ক্ষমতা আমার আছে, আবার প্রাণ ফিরাইয়া লইবার ক্ষমতাও আমার আছে। এই ক্ষমতা আমি আমার পিতার নিকট হইতে পাইয়াছি।”
ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১০:১৮

কোন মানুষেরই তার মৃত্যুর নির্ধারিত সময় সম্বন্ধে ধারণা নেই এবং নিজের ব্যক্তিগত উদ্যোগে পুনরুত্থানেরও কোন শক্তি নেই। কিন্তু ঈসা-মসীহে্র তা ছিল। মসীহ্ মৃত্যুকে সম্পূর্ণরূপে স্বীকার করে, জগতের গুনাহ্ বহন করে আমাদের নাজাতের জন্য স্বেচ্ছায় মৃত্যুবরণ করেন এবং মৃত্যু থেকে জীবিত হন। তাই তিনিই একমাত্র ব্যক্তিসত্তা, যিনি তাঁর উপর ঈমান-আনয়নকারী সকলকৈ নিজের রুহানী জিন্দেগী দিয়ে জীবিত করেন। আমরা ইহজগতে এমন কাউকে আদৌ দেখিনা যিনি মসীহের মতো মৃত্যুর পর পুনর্জীবিত হয়েছেন। মসীহের মৃত্যু সকল মানুষের জন্য আল্লাহ্-পাকের অশেষ মেহেরবানি।

আল্লাহ-পাকের সমস্ত নবী ও রসূল মৃত্যুবরণ করেছেন। তাঁদের শবদেহ ক্ষয়প্রাপ্ত ও জীর্ণ অবস্থায় এখনও তাঁদের কবরে আছে। কিন্তু মসীহ্ জীবন্ত তিনি মৃত্যুঞ্চয়ী।

আপনি কি মসীহের মৃত্যু-থেকে পুনরুত্থানের অর্থ হৃদয়াঙ্গম করতে পেরেছেন?

সলীবের উপর তাঁর আত্মকোরবানীর এই মহান কর্মের দ্বারা প্রমাণ হয়েছে যে, যিনি সলীবের উপর স্বেচ্ছায় কোরবান হন, আল্লাহ-পাক তাঁকে মহব্বৎ করেন এবং জগতের জন্য তাঁর এই কোরবানী আল্লাহ্-পাক কবুল করেছেন।

আপনি কি মৃত্যুর উপর মসীহের বিজয় উপলব্ধি করেছেন?

মসীহ বাস্তবিকই শাহাদাৎ বরণ করেন এবং কঠিন পাথরের কবরে সমাহিত হন। কবরের দরজায় তাঁর শত্রুরা বিশালাকার এক খন্ড পাখর চাপা দেয় এবং তার উপর সেই সময়ের সবচাইতে বৃহৎ সম্প্রদায়ের মোহর মেরে দ্বার রুদ্ধ করে দেওয়া হয়, তাঁর উম্মতেরা যাতে রাতের বেলায় লাশ চুরি করতে না পারেন। সশস্ত্র প্রহরীও কবরের দরজায় মোতায়েন রাখা হয়।

কিন্তু তিনদিন বাদে ঈসা-মসীহ্ মৃত অবস্থায় থেকে জীবিত হন এবং কবর থেকে বেরিয়ে আসেন। তাঁর উম্মতেরা পরে কবর খালি দেখতে পান। তাঁরা জীবন্ত মসীহের সাক্ষাত পেয়ে তাঁকে ভূত ভেবে ভয়ে-বিস্ময়ে কাঁপতে থাকেন। কিন্তু তিনি তাঁদের সঙ্গে মহব্বতের ভাষায় কথা বলেন এবং তাঁদেরকে নিজের হাত-পায়ে পেরেকের ক্ষত-চিহ্ন দেখান। তাদের সামনে তিনি খাদ্য গ্রহণ করেন এবং তাঁকে স্পর্শ করতে তাঁদের অনুমতি দেন, যাতে তাঁরা নিশ্চিত হতে পারেন যে, তিনি সত্যিকার ভাবে পুনরুত্থিত হয়েছেন এবং তাঁর এই পুনর্জীবিত দেহ বাস্তব সত্য।

আল্লাহ্-পাকের কাছে মসীহের আরোহণ সম্বন্ধে আপনার কী ভাবনা?

যারা ঈসা-মসীহের মাধ্যমে প্রচারিত আল্লাহ্-পাকের মহব্বত অস্বীকার করে, তারা প্রকৃতপক্ষে নিজেদেরকেই অস্বীকার করে ও ধিক্কৃত করে। আল্লাহ্-পাকের রহমতকে যে অস্বীকার করে, মেই অস্বীকৃতির জন্য সে আল্লাহ্-পাকের গজবের মধ্যে থাকে; কারণ তাঁর দেওয়া নাজাত-প্রাপ্তির একমাত্র উপায়কে বার-বার সে অস্বীকার করেছে।

ঈসা-মসীহের পূনরুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত গুনাহের শাস্তিজনিত মৃত্যু ছিল মানুষের প্রধার শত্রু। কিন্তু মসীহ্ মৃত্যুকে পরাভূত করেন এবং পুনরায় জীবন্তরূপে হাজির হন। অনন্তকাল পর্যন্ত তিনি আর কখনও মৃত্যুবরণ করবেন না। যারাই তাঁর সংলগ্ন থাকবে, তারা প্রত্যেকে তাঁর জীবনের ক্ষমতার অংশীদার হবে এবং অন্যায়কে পরাস্ত করতে পারবে।

আপনি কি মসীহের পুনরুত্থানের আশীর্বাদ উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং আপনি কি তা গ্রহণ করেছেন? এই তো সময়, এখনই তা গ্রহণ করুন।

মসীহের পৃথিবীতে-প্রত্যাবর্তন সম্বন্ধে আপনি কী জানেন?

ঈসা-মসীহ্ নিজেই মহব্বৎ। তিনি সকল মানুষকে মহব্বত করেন, বিশেষতঃ করেন যাঁরা তাঁর মহব্বতের স্পৃহায় লালিত, তাঁদেরকে। তাঁরা মহব্বতের পূর্ণ হয়ে, ক্ষমা সুন্দর হয়ে বেড়ে ওঠেন এবং আল্লাহ্-পাক তাঁদের ক্ষমা করে দেন। তিনি আমাদের প্রতীক্ষায় আছেন এবং সর্বদা আমাদেরকে তাঁর কাছে রাখতে চান।

ঈসা-মসীহ্ নিজের মৃত্যু ও পুনরুত্থান সম্বন্ধে যেমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, তেমনি তাঁর দ্বিতীয়বার আগমনের বিষয়েও খোলাখুলিভাবে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তিনি মহা-মহিমায় আসবেন, এই কথা জানবার পর প্রত্যেক বুদ্ধিমান লোকই তাঁর সঙ্গে সাক্ষাত করতে নিজেকে প্রস্তুত করবেন। তাঁর দেওয়া নাজাত যাঁরাই গ্রহণ করেছেন, মসীহ্ তাঁদেরকে সেই সব লোকদের থেকে আলাদা করবেন, যাদের হৃদয় কঠিন, যারা অহঙ্কারী এবং যারা স্বীকার করে না যে, তারা গুনাহগার, আর সেজন্য মসীহের তরফ থেকে মাগ্ফেরাতের প্রয়োজন রয়েছে।

প্রিয় ভ্রাতা, অবিলম্বে ঈসা-মসীহকে গ্রহণ করুন, যাতে আপনি আখেরাতের বিজারের কঠোর অবস্থার মধ্যে নিপতিত না হন। কারণ, তিনিই একমাত্র ব্যক্তি স্বত্তা, যিনি আপনাকে ভবিষ্যত গজব থেকে রক্ষা করতে পারেন।

সব খাঁটি ঈমানদার অবিরাম প্রত্যাশা নিয়ে মসীহের আগমন কামনা করেছেন। এমন কি ইহুদী ও মুসলমানগণও জানেন যে, তিনি শীঘ্রই আসছেন। কেউ কেউ বিশ্বাস করে যে, ঈসা-মসীহ্ চল্লিশ বছর পৃথিবীতে রাজত্ব করবেন। কারও অনুমান, তাঁর রাজত্বকাল হবে এক শো বছর। অন্যেরা নিশ্চিত যে, এই কাল হবে এক হাজার কছর। কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দসে এই বলে আমাদের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে যে, ঈসা-মসীহ্ সব রাজার রাজা (রাজাধিরাজ), তিনি প্রভুদের প্রভু এবং তাঁর কোন শেষ নেই। তাঁর সাম্রাজ্য চিরদিনের। তিনি কলেছেন:

“আমি রাজা-সত্যের পক্ষে সাক্ষ্য দিবার জন্য আমি আসিয়াছি, আর সেই জন্যই আমি দুনিয়াতে আসিয়াছি। যে কেহ সত্যের, সে আমার কথা শুনে।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৮:৩৭

মসীহের নাম ও উপাধি থেকে আপনি কী বুঝেছেন?

কোন কোন নবীর বিশেষ বিশেষ উপাধি আছে। ইব্রাহীম আল্লাহ্-পাকের দোস্ত, মূসা আল্লাহ্-পাকের মুখপাত্র এবং ঈসা-মসীহ আল্লাহ-পাকের কালাম বা তিনি কালেমাতুল্লাহ্ ও রুহুল্লাহ্ কিন্তু ইঞ্জিল শরীফে আমরা সরাসরি এই কালাম পাঠ করি, যা বেহেশতী কন্ঠে আমাদের কাছে এসে পৌঁছায়:

“ইনিই আমার প্রিয় পুত্র (রূহানী), ইহার উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট। তোমরা ইহার কথা শুন।”

মথি ১৭:৫

“আল্লাহ্‌র পুত্র” বলতে কী বোঝায়? কোর সন্তান স্বভাবতঃ তার পিতার প্রতিবিম্ব। একইভাবে আমরা ঈসা-মসীহের মধ্যে আল্লাহ-পাকের গুণাবলী প্রত্যক্ষ করি, যেমন মসীহ্ তাঁর সাহাবীদের বলেছিলেন:

“যে আমাকে দেখিয়াছে, সে পিতাকেও (রবকেও) দেখিয়াছে।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৪:৯

খোদা-না-খাস্তা, আপনি হয়তো বলবেন, তিনি নবী-মাত্র। কিন্তু আমরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করি, আপনি তাহলে কেন তাঁর আহ্কাম পালন করেননি? আপনি যদি প্রায়শ্চিত না করে থাকেন এবং কথায় ও কাজে পরিবর্তিত না হয়ে থাকেন, তাহলে ইতিমধ্যেই আপনার বিচার হয়ে গেছে।

অতীব রহস্যের বিষয় যে, ঈসা-মসীহ্ আল্লাহ্-পাকের গোলাম হয়ে এসেছিলেন গুনাহের গোলামদের মুক্ত করতে। সত্যিকার মানবতা কী, আমাদের তা দেখাবার জন্য তিনি একজন সামান্য, বিনীত মানুষ হিসাবে জগতে আসেন। সুতরাং, শক্তি, মহিমা বা বিত্তের দম্ভ নয়-একমাত্র মসীহের মহব্বতই পারে আমাদের রক্ষা করতে।

যে ব্যক্তি সঙ্গে একটা তলোয়ার বহন করে, তাকে মনে হয় বেশ শক্তিশালী লোক বলে; কিন্তু যিনি নিজেকে জয় করেছেন, তিনি নিশ্চয় আরও বেশী শক্তিশালী। সবার জন্য যিনি নিজের জীবন কোরবানী দেন, তিনিই সর্বোত্তম। এই কারণে হযরত ইউহোন্না স্বীকার করেছেন এই বলে:

“সেই কালামই মানুষ হইয়া জন্মগ্রহণ করিলেন এবং কিছুকাল আমাদের মধ্যে বাস করিলেন। পিতা-খোদার একমাত্র পুত্র (কালেমাতুল্লাহ্) হিসাবে তাঁহার যে মহিমা, সেই মহিমা আরা দেখিয়াছি। তিনি রহমত আর সত্যে পূর্ণ।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১:১৪

ঈসা-মসীহ্ রক্ত মাংসের মানবদেহে আগমন করেন ও অবস্থান করেন, যেন আমরা বুঝতে পারি যে আল্লাহ্-পাকই সেই পিতা (রব), যিনি রহমত ও মহব্বতে পূর্ণ এবং মাগ্ফেরাতদাতা-তিনি যোদ্ধা বা ধ্বংসকারী বিজেতা নন, কিংবা কোন উদাসীন ব্যক্তিসত্তা নন। এমনি করে ঈসা-মসীহ্ আল্লাহ্-পাকের সম্বন্ধে আমাদের মধ্যে নতুন ধারণা ও উপলব্ধি এনে দিয়েছেন। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ আমাদেরকে যে কেবল বেহেশতী গুণাবলী শিক্ষা দিয়েছেন, তাই নয়-

উপরন্তু আল্লাহ্-পাকের মহব্বতে আমাদের সামনে ও সঙ্গে বাস করেছেন, যাতে আমরা নয়া জিন্দেগীর এমন একটা বিধান বুঝতে পারি, যে বিধান হল অনন্ত বেহেশতী মহব্বত।

“আমার ভেড়াগুলি আমার ডাক শুনে। আসি তাহাদের জানি আর তাহারা আমার পিছনে পিছনে চলে। আমি তাদের অনন্ত জীবন দিই। তাহারা কোনমতেই বিনষ্ট হইবে না এবং কেহই আমার হইতে তাহাদের কাড়িয়া লইবে না।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১০:২৭-২৮

“আমার পিতার সমস্ত-কিছুই আমার হাতে দিয়াছেন। পিতা ছাড়া পুত্রকে কেহ জানে না এবং পুত্র ছাড়া পিতাকে কেহ জানে না। আর পুত্র যাহার নিকট পিতাকে প্রকাশ করিতে ইচ্ছা করেন, সেই-ই তাঁহাকে জানে।”

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ১১:২৭

“আমিই আসল আঙ্গুর গাছ আর আমার পিতা মালী।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৫:১

মসীহের দাওয়াতের প্রতি আপনার কী প্রতিক্রিয়া?

আল্লাহ্‌র পুত্র ঈসা-মসীহ্ বিনম্র কণ্ঠে আপনাকে বলেছেন:

“তোমরা যাহারা কলান্ত ও বোঝা বহিয়া বেড়াইতেছ, তোমরা সকলে আমার নিকটে এস- আমি তোমাদের বিশ্রাম দিব। আমার জোয়াল তোমাদের উপর তুলিয়া লও এবং আমার নিকট হইতে শিখো। কারণ, আমার স্বভাব নরম ও নম্র। ইহাতে তোমরা অন্তরে বিশ্রাম পাইবে। কারণ, আমার জোয়াল বহণ করা সহজ এবং আমার বোঝা হালকা।”

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ১১:২৮-৩০

যখন মসীহ্ তাঁর সাহাবীদের এমনি ভাষায় ডাকতেন, তখন তাঁরা উঠে দাঁড়াতেন এবং তাঁর কথার উপর ভরসা করে ঘর-বাড়ী, মাতা-পিতা, চাকরী-বাকরী ছেড়ে তাঁর অনুগামী হতেন। তাঁরা তাঁকে অনুসরণ করেছিলেন, তাঁকে বুঝতে পেরেছিলেন, তাঁর উপর ঈমান এনেছিলেন, নিজেদের জীবন তাঁর কাছে সমর্পণ করেছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁরা রুহুল কুদ্দুস- এর ক্ষমতায় পরিপূর্ণ হয়েছিলেন।

মসীহ্ আজও জীবিত এবং আপনার কাছ থেকেও তিনি একই প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় আছেন। কারণ, তিনি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে সব-কিছু ত্যাগ করে তঁকে অনুসরণের দাওয়াৎ দিয়েছেন। সেই দাওয়াৎ কবুল করলে আপনি আরও বেশী করে তাঁকে চিনতে পারবেন এবং তাঁর রহমতের কছে নিজেকে সমর্পণ করতে পারবেন। প্রতিদানে তিনি তাঁর পাক-রূহের দ্বারা আপনাকে অভিষিক্ত করবেন, যেন কথায় ও কাজে আপনি একজন পরিবর্তিত মানুষ হয়ে গড়ে উঠতে পারেন। তখন আপনি হবেন সত্যবাদী, কর্মোপযোগী, সদাশয়, বিনয়ী ও মহব্বতে পূর্ণ সুপ্রিয় ব্যক্তি। তখন সমস্ত উপলব্ধির সেরা উপলব্ধি যে আল্লাহ্-পাকের রহমত, সেই রহমত আপনার হৃদয়-মনকে ঈসা-মসীহের পুনরাগমন পর্যন্ত পবিত্র ও পূর্ণ করে রাখবে।

এবং তাঁর সেই পুনরাগমণ অতি-নিকটে।

পরিশেষে

সুতরাং, কালেমাতুল্লাহ্ সম্বন্ধে আপনি কী চিন্তা করেন?

প্রিয় বন্ধু, আপনি হয়তো ইঞ্জিলের বক্তব্যের সঙ্গে একমত, কিংবা হয়তো বেহেশতী সুসংবাদ আপনি অস্বীকার করেন। এ দুইয়ের যেটাই সত্য হোক, আমরা ঈসা-মসীহ সম্বন্ধে আপনার মতামত জানতে আগ্রহী। এখন, আপনি যদি দয়া করে আপনার মতামত আমাদের জানান, তাহলে আমরা আপনাকে আপনার জিজ্ঞাসা অনুযায়ী আরও তথ্য দিতে চেষ্টা করব।

এই পুস্তকের ২ পৃষ্ঠায় দেওয়া ঠিকানায় মূূল প্রকাশকের সঙ্গে (ইংরেজীতে) কিংবা ৩০ পৃষ্ঠায় দেওয়া ঠিকানায় সরাসরী আমাদের সঙ্গে (বাংলায়) যোগাযোগ করতে পারেন।

পাঠক-পাঠিকার জন্য প্রশ্ন

প্রিয় পাঠক- পাঠিকা,

এই পুস্তিকার অন্তর্গত প্রশ্নোত্তরসমূহ মনোযোগসহকারে পাঠ করে থাকলে আপনি নিচের প্রশ্নগুলিরও উত্তর দিতে পারবেন। আপনি এ ব্যাপারে আগ্রহী হলে এবং আপনার পাঠানো উত্তর। অন্ততঃ ৭০%সঠিক হলে আমাদের জামাতের পক্ষ থেকে আপনার পছন্দমত একটি পুস্তক (আমাদের প্রকাশিত) শুভেচ্ছার নিদর্শন স্বরূপ আপনার কাছে আমরা পাঠাবো।

  1. ঈসা-মসীহের জন্মের মধ্যে কী অলৌকিকতা লক্ষ্য করা যায়?
  2. ঈসা-মসীহ্ কেন সব সময়ই নিষ্পাপ?
  3. ঈসা-মসীহের বাণীর রহস্য কী?
  4. ঈসা-মসীহের কোন্ কাজ আপনাকে সর্বাধিক প্রভাবিত করেছে?
  5. ঈসা-মসীহের মৃত্যুর মধ্যে বিস্ময়কর কী দেখতে পাওয়া যায়?
  6. ঈসা-মসীহের মৃত্যু থেকে পুনরুত্থানের হেতু কী?
  7. ঈসা-মসীহ্ এখন কোথায় অবস্থান করছেন ও কী করছেন?
  8. ঈসা-মসীহের দ্বিতীয় আগমন সম্বন্ধে আপনি কী বুঝেছেন?
  9. আল্লাহ্-পাক ঈসা-মসীহকে তাঁর পুত্র বলেন কেন?
  10. আপনি নিজে ঈসা-মসীহ্ সম্বন্ধে কী চিন্তা করেন?

ইসলাম ও মসীহী মতে পাপ ও পাপের ক্ষমা

লেখক: ইস্কান্দার জাদীদ

অনুবাদ: মসীহী জামাত

প্রকাশক: মসীহী জামাত


সূচিপত্র

ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ
মসীহী মতে পাপ
জগতে পাপের আগমন
ইসলামের দৃষ্টিতে কাফফারা
ধার্মিকতা পাপ মোচন করে
ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমা
মসীহীয়াতে কাফফারা
কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়ের প্রয়োজনের পক্ষে যুক্তিসমূহ
উসংহার


ইসলামের দৃষ্টিতে পাপ

কোরান শরীফে পাপ সম্পর্কে বহু উক্তি রয়েছে। তার মধ্যে প্রধান কয়েকটি নিম্নরূপ:

১। ذَنْبِ আয-যাম্ব্ (দোষ, ত্রুটি, অপরাধ, অপকর্ম)। এই বিষয়ের উপর কোরান শরীফে ৩৯টি আয়াত পাওয়া যায়। তার মধ্যে নিচের উক্তিটিকে প্রতিনিধিস্থানীয় বলে মনে করা যায়:

إِنَّا فَتَحْنَا لَكَ فَتْحًا مُّبِينًا لِيَغْفِرَ لَكَ اللَّهُ مَا تَقَدَّمَ مِن ذَنبِكَ وَمَا تَأَخَّرَ وَيُتِمَّ نِعْمَتَهُ عَلَيْكَ وَيَهْدِيَكَ صِرَاطًا مُّسْتَقِيمًا

“আল্লাহ্ তোমার (মুহম্মদের) জন্য অবধারিত করিয়াছেন নিশ্চিত বিজয়। ইহা এই জন্য যে তিনি তোমার অতীত ও ভবিষ্যৎ ত্রুটি সমূহ (আয্-যাম্ব্)মার্জনা করিবেন……।”

সূরা ফাতহ ১-২

২। الْفَوَاحِشَ আল্-ফাহ্শ্ (অশ্লীলতা, ব্যভিচার)।-বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ব্যভিচারজনিত পাপ বোঝাবার জন্য শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে এবং কোরান শরীফে তা হারাম ঘোষিত হয়েছে।:

قُلْ تَعَالَوْاْ أَتْلُ مَا حَرَّمَ رَبُّكُمْ عَلَيْكُمْ أَلاَّ تُشْرِكُواْ بِهِ شَيْئًا وَبِالْوَالِدَيْنِ إِحْسَانًا وَلاَ تَقْتُلُواْ أَوْلاَدَكُم مِّنْ إمْلاَقٍ نَّحْنُ نَرْزُقُكُمْ وَإِيَّاهُمْ وَلاَ تَقْرَبُواْ الْفَوَاحِشَ مَا ظَهَرَ مِنْهَا وَمَا بَطَنَ وَلاَ تَقْتُلُواْ النَّفْسَ الَّتِي حَرَّمَ اللّهُ إِلاَّ بِالْحَقِّ ذَلِكُمْ وَصَّاكُمْ بِهِ لَعَلَّكُمْ تَعْقِلُونَ

“…..প্রকাশ্যে হউক কিংবা গোপনে হউক, অশ্লীল আচারণের (মূলে আছে বহুবচনে:‘ফাওয়াহিশ’)নিকটেও যাইবে না;…..”

সূরা আন’আম ৬:১৫১

৩। الوِزْر আল্-ভিয্র্ (ভারী বোঝা হিসাবে পাপ,দায়)। কোরান শরীফে রয়েছে:

“আমি কি তোমার বক্ষ প্রশস্ত করিয়া দিই নাই? আমি লাঘব করিয়াছি তোমার ভার (ভিয্র্), যাহা ছিল তোমার জন্য অতিশয় কষ্টদায়ক।”

সূরা আ-ইনশিরাহ ১-৩

এই উক্তির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আল্-ফখ্র্ আর-রাযী বলেছেন যে, জিব্রাইল ফেরেস্তা মুহম্মদ কাছে এলেন, তাঁর বুক ফেড়ে ফেললেন, তাঁর হৃৎপিন্ড বের করে নিলেন, সেটাকে ধুয়ে-মুছে গুনাহ্-খাতা থেকে পাক সাফ করলেন, তারপর সেটাকে জ্ঞান আর ঈমান দিয়ে ভরাট করলেন।

মুহম্মদ ইবনে ইসহাক্ব থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে হিশাম এর ব্যাখ্যা দান করেছেন এই বলে:

“মুহম্মদের একদল সাহাবী একবার তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল, আপনার নিজের কথা আমাদের কিছু বলন, তিনি উত্তর দিলেন, ‘বনী-সা’দের মধ্যে আমি লালিত। একদিনের কথা- আমার পালিত- ভাইদের সঙ্গে আমাদের বাড়ীর পেছনে ছিলাম, পশুর পাল চরাচ্ছিলাম। তখন সাদা পোশাক-পরা দুজন লোক আমাদের কাছে এলেন।তাঁদের একজনের হাতে তুষারে ভরা একটা সোনালী গামলা। তাঁরা আমাকে নিয়ে গেলেন, আমার দেহ ফাঁক করে ফেললেন আর ভেতর আর ভেতর থেকে এক দলা কালো রক্ত বের করে দূরে ফেলে দিলেন। তারপর, সেই তুষার দিয়ে তাঁরা আমার হৃদপিন্ড আর শরীর ধৌত করলেন। তাঁদের একজন অন্যজনকে বললেন,তাঁকে (মুহম্মদকে) তাঁর দশজন লোকের বিপরীত ওজন করো। অন্যজন তাই করলেন, আর আমি তাঁদের চাইতে বেশী ভারী হলাম। তারপর তিনি বললেন তাঁকে তাঁর একশজন লোকের বিপরীতে ওজন করো। তিনি তাই করলেন,আর আমার ওজন তাদের চাইতে বেশী হল। তারপর তিনি বললেন, তাঁকে তাঁর একহাজার লোকের বিপরীতে ওজন করো। তিনি তাই করলেন, আর আমি এবারও তাদের চাইতে বেশী ভারী হলাম। তখন তিনি বললেন, তাঁকে যেতে দাও, কেননা আল্লাহ্‌র কসম, তাঁকে যদি তাঁর সমস্ত লোকের বিপরীতে ওজন করা হয়, তাহলেও তিনি সবার চাইতে বেশী ভারী হবেন।’”

৪। আয-যালাল ( (পথ ভ্রষ্ট হওয়া, বিভ্রান্তি)। কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“তোমার (মুহম্মদের) প্রতিপালক তো তোমাকে অনুগ্রহ দান করিবেনই এবং তুমি সন্তুষ্ট হইবে। তিনি কি তোমাকে পিতৃহীন অবস্থায় পান নাই এবং তোমাকে আশ্রয়দান করেন নাই?”

وَلَسَوْفَ يُعْطِيكَ رَبُّكَ فَتَرْضَى أَلَمْ يَجِدْكَ يَتِيمًا فَآوَى

সূরা আয-যুহা ৯৩:৫-৬

আল-কালবী“পিতৃহীন অবস্থা” বলতে “ঈমানহীনতা” বুঝিয়েছেন।

৫। الكفر আল-কুফ্‌র্ (আল্লাহে অবিশ্বাস, নাস্তিক্য)।-কোরান শরীফে ঈমানদারদের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে:

وَاعْلَمُوا أَنَّ فِيكُمْ رَسُولَ اللَّهِ لَوْ يُطِيعُكُمْ فِي كَثِيرٍ مِّنَ الْأَمْرِ لَعَنِتُّمْ وَلَكِنَّ اللَّهَ حَبَّبَ إِلَيْكُمُ الْإِيمَانَ وَزَيَّنَهُ فِي قُلُوبِكُمْ وَكَرَّهَ إِلَيْكُمُ الْكُفْرَ وَالْفُسُوقَ وَالْعِصْيَانَ أُوْلَئِكَ هُمُ الرَّاشِدُونَ

“……….আল্লাহ……….সত্যপ্রত্যাখ্যান (কুফ্‌র্),সত্যত্যাগ (ফুসূক্ব) ও অবাধ্যতাকে (’ইসয়ান) করিয়াছেন তোমাদিগের নিকট অপ্রিয় (ঘৃণ্য-(‘র্কারাহা)।”

সূরা আল-হুজরাত ৪৯:৭

আয-যামাখশরী এই আয়াতের তফসীরে বলেছেন,“এখানে তিনটি বিষয় রয়েছে: কুফ্‌র্ অর্থাৎ আল্লাহ্কে অস্বীকার করা, ফুসূক্ব অর্থাৎ অসত্যতা, ও ’ইস্য়ান অর্থাৎ অবাধ্যতা।”

৬। ظلم আয-যুল্ম্ (অন্যায়,অবিচার ,অন্যায্যতা)।-বলা হয়েছে:

وَإِذْ نَادَى رَبُّكَ مُوسَى أَنِ ائْتِ الْقَوْمَ الظَّالِمِينَ

“যখন তোমার প্রতিপালক মূসাকে ডাকিয়া বলিলেন, তুমি সীমা লঙ্ঘনকারী (আয-যালিমীন) সম্প্রদায়ের নিকট যাও।”

সূরা আশ-শু’আরা ২৬:১০

৭। আল-ইথ্ম (অপরাধ, অপকর্ম, পাপ)।-কোরআন শরীফে রয়েছে:

وَذَرُواْ ظَاهِرَ الإِثْمِ وَبَاطِنَهُ إِنَّ الَّذِينَ يَكْسِبُونَ الإِثْمَ سَيُجْزَوْنَ بِمَا كَانُواْ يَقْتَرِفُونَ

“তোমার প্রকাশ্য এবং প্রচ্ছন্ন পাপ (ইথ্ম্) বর্জন কর; যাহারা পাপ (ইথ্ম্) করে, তাহাদিগকে তাহাদিগের পাপের সমুচিত শাস্তি দেওয়া হইবে।”

সূরা আন’আম ৬:১২০

৮। আল-ফুজূর (নীতিবিগর্হিত কাজ, চরিত্রহীনতা)।-কোরান শরীফে বলা হয়েছে।:

وَإِنَّ الْفُجَّارَ لَفِي جَحِيمٍ يَصْلَوْنَهَا يَوْمَ الدِّينِ

“এবং দুষ্কৃতকারীগণ (আল-ফুজ্জর) তো থাকিবে জাহান্নামে। উহারা কর্মফল দিবসে উহাতে প্রবেশ করিবে।”

সূরা আল ইনফিতার ৮২:১৪-১৫

৯। আল-খাতী’আ (পাপ, দোষ)।-কোরান শরীফে রয়েছে:

وَمَن يَكْسِبْ خَطِيئَةً أَوْ إِثْمًا ثُمَّ يَرْمِ بِهِ بَرِيئًا فَقَدِ احْتَمَلَ بُهْتَانًا وَإِثْمًا مُّبِينًا

“কেহ কোন দোষ (খাতী’আ) বা পাপ (ইথ্ম্) করিয়া পরে উহা কোন নির্দোষ ব্যক্তির প্রতি (উপর) আরোপ করিলে সে [নিজেই] মিথ্যা অপবাদ (বুহ্তান) ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।”

সূরা আন-নিসা ৪:১১২

এই আয়াতে পাপের জন্য যে তিন প্রকারের অভিধা ব্যবহৃত হয়েছে, ইমাম আর-রাযী তার উপর নিম্নরূপ পার্থক্য নির্ধারণ করেছেন:

  1. ১। আল-খাতী’ আ হচ্ছে ছোট পাপ আর আল-ইথ্ম্ বড় পাপ।
  2. ২। আল-খাতী’আ হচ্ছে এমন দোষ, যা স্বয়ং পাপীকেই ভোগায়, কিন্তু আল-ইথ্ম্ এমন অপরাধ যা সঙ্ঘটিত হয় অন্যদের বিরুদ্ধে, যেমন অবিচার, হত্যা ইত্যাদি।
  3. ৩। আল-খাতী’অ এমন দোষ, যা পূর্ব পরিকল্পিতও হতে পারে, আবার ভুলক্রমেও হতে পারে, কিন্তু তা করা উচিৎ নয়; আর ইথ্ম্ এমন পাপ, যা ইচ্ছাকৃতভাবে করা হয়।
  4. ৪। অন্যদিকে আল-বুহ্তান (অপবাদ) হচ্ছে কোন নির্দোষ লোককে অন্যায়ভাবে সন্দেহ করা। অপবাদ-রচনাকারীকে এই দুনিয়ায় কঠোরভাবে তিরস্কৃত করাএবং আখেরাতেও রয়েছে তার জন্য কঠোর শাস্তি।

১০। شَرًّا আশ্-শার্‌ (অনাচার)।- কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

وَمَن يَعْمَلْ مِثْقَالَ ذَرَّةٍ شَرًّا يَرَهُ

“এবং কেউ অণু পরিমাণ অসৎকর্ম করলে তাও দেখতে পাবে।”

সূরা যিলযাল ৯৯:৮

‘আব্দ্-আল্লাহ্ বিন ‘আম্র্ বিন’ আল-’আস-এর কাছ থেকে শুনে আবী ’আব্দ্ আর-রহমান আল-হুবালী, তাঁর কাছ থেকে শুনে ইয়াহ্-ইয়া বিন ’আব্দ্-আল্লাহ্ তাঁর কাছ থেকে শুনে ইবনে ওয়াহাব, তার কাছ থেকে শুনে ইউনুস বিন ’ আব্দ-আল-আ’লার দেওয়া বর্ণনা উদ্ধৃত করে আবু জাফর আৎ-তাবারী বলেছেন:

“এই সূরা যখন নাযেল হয়, তখন আব্ক্রু সিদ্দীক্ব বসেছিলেন। তিনি কাঁদতে লাগলেন। আল্লাহ্‌র রসূল জানতে চাইলেন, ‘আবুবকর, আপনি কাঁদছেন কেন?’ তিনি বললেন, আপনি যদি পাপ না করে থাকেন আর কোন ভুল না করে থাকেন, তাতে আপনি আল্লাহ্‌র ক্ষমা পাবেন। আবার আল্লাহ্ এমন সব লোকও সৃষ্টি করবেন, যারা পাপ করবে, ভুল করবে,তবু আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমা করে দেবেন?”

১১। আস্-স্ইয়েআহ্ (অপকর্ম, অপরাধ)।- কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“যে কেহ মন্দকর্ম (আস-ইয়েআহ্)করিবে তাহাকে অধোমুখে নিক্ষেপ করা হইবে অগ্নিতে…।”

সূরা আন-নাম্ল্ ৯০

ইবনে ‘আব্বাস বলেছেন:

“আয়াতটি দেওয়া হলে-পর ঈমানদারগণ একে অসহনীয় বলে মনে করলেন। তাঁরা হযরত মুহম্মদকে বললেন, “আমাদের মধ্যে কে এমন আছে, যে মন্দ কর্ম করেনি? তাহলে কীভাবে আমরা তার খেসারত দেব?’ মুহম্মদ উত্তর করলেন, ‘একটি সৎকর্মের জন্য আল্লহ দশটি পুরষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আর একটি মন্দকর্মের জর‌্য একটি শাস্তির। সুতরাং হিসাবের খাতায় যার একটি মন্দকমর্ জমা হয়েছে, তার দশটি পুরষ্কারের একটি কাটা যাবে, তারপরও আরও নয়টি পুরষ্কার অবশিষ্ট থাকবে।’”

১২। আস-সূ’(কুকর্ম, ভাগ্যবিড়ম্বনা)। বলা হয়েছে:

“তোমাদের খেয়ালখুশী ও কিতাবীদের খেয়ালখুশী অনুসারে কাজ হইবে না; কেহ মন্দ কাজ (সূ’) করিলে তাহার প্রতিফল সে পাইবে না।”

সূরা আন-নিসা ১২৩

১৩। আল-ফাসাদ (অশান্তি, দুর্নীতি)। কোরআন শরীফে বলা হয়েছে:

“যখন সে (মুনাফিক্ব) তোমার নিকট হইতে ] প্রস্থান করে, তখন সে পৃথিবীতে অশান্তি সৃষ্টি করে (লিয়ুফসিদা) এবং শস্যক্ষেত্র ও জীবজন্তুর বংশনিপাতের চেষ্টা করে; কিন্তু আল্লাহ্ অশান্তি (আল-ফাসাদ) পছন্দ করেন না।”

সূরা বাকারা ২০৫

১৪। আল-ফিস্‌ক্ব (বদভ্যাস,নৈতিক অধঃপতন)। কোরান শরীফে লিখিত হয়েছে:

“এবং নিশ্চয় আমি তোমার প্রতি স্পষ্ট নিদর্শন (আয়াত) অবতীর্ণ করিয়াছি। সত্য ত্যাগীগণ (ফাসিকূর-অন্য অনুবাদ: ‘উচ্ছৃঙখল ফাসিক’হাকীম আবদুল মান্নান, ‘কোরান শরীফ’ তরজমা, ’তাজ কোম্পানী লিঃ) ব্যতীত অন্য কেহ তাহা প্রত্যাখ্যান করে না।”

সূরা বাকারা ৯৯

তফসীরকারগণ বলেছেন যে, আল্লাহ্ যা সীমাবদ্ধ করে দিয়েছেন, তার বাইরে চলে যাওয়াই হচ্ছে আল-ফিসক্ব এবং ফাসেক্ব ঈমানহীন।

১৫। আল-বুহতান (অপবাদ, অসত্যাচারণ)।-বলা হয়েছে:

“এবং তোমরা যখন ইহা শ্রবণ করিলে, তখন কেন বলিলে না, এ বিষয়ে বলাবলি করা আমাদিগের উচিৎ নহে; আল্লাহ্ পবিত্র মহান্। ইহা তো গুরুতর অপবাদ !’”

সূরা আন-নূর-আলোক ১৬

এমনিভাবে পাপের বর্ণনা দেবার জন্য কোরআন শরীফে আরও বহু শব্দ রয়েছে। কিন্তু সেই রকমের সমস্ত শব্দ আর তার তফসীরের বিবরণের জন্য স্থান-সঙ্কুলান এখানে সম্ভব নয়। তবে পাপ সম্পর্কে কথা শেষ করার আগে অবশ্যই বলা দরকার যে, “কোরান শরীফে মৌলিক” পাপ এর অস্তিত্বের বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে; এই পাপ সৃষ্টি হয়েছে হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার বেহেশ্‌ত থেকে বহিষ্কৃত হবার কারণে, এবং এই বক্তব্যের প্রমাণ রয়েছে। তার মধ্যে সব চাইতে স্পষ্ট ও সহজ আয়াত ক’টি হচ্ছে নিম্নরূপ:

“এবং আমি বলিলাম, ‘হে আদম ! তুমি ও তোমার সঙ্গিনী (‘যাউজুকা’-অন্য অনুবাদ:‘তোমার স্ত্রী’, হাকীম আবদুল মান্নান, পূর্বোক্ত) জান্নাতে বসবাস কর এবং যথা ও যেথা ইচ্ছা আহার কর, কিন্তু এই বৃক্ষের নিকটবর্তী হইও না; হইলে তোমরা অন্যায়কারীদের (আয-যালিমীন) অন্তর্ভুক্ত হইবে।’ কিন্তু শয়তান উহা হইতে তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল এবং তাহারা যেখানে ছিল, সেখান হইতে তাহাদিগকে বহিস্কৃত করিল। আমি বলিলাম, তোমরা একে অন্যের শত্রু রূপে নামিয়া যাও (‘ইহ্বিতু’) পৃথিবীতে কিছুকালের জন্য তোমাদের বসবাস ও জীবিকা রহিল।’ অতঃপর আদম তাহার প্রতিপালকের নিকট হইতে কিছু বাণী প্রাপ্ত হইল। আল্লাহ্ তাহার প্রতি ক্ষমাপরবশ হইলেন। তিনি অত্যন্তক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।”

সূরা বাকারা ৩৫-৩৭

পতনের বা নেমে যাবার আগে হযরত আদম ও বিবি হাওয়া প্রকৃত কোথায় অবস্থান করছিলেন, তাই নিয়ে আরবি আলেমদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।

আবু ক্বাসিম আল-বালখী ও আবু মুসলিম আল-ইসফাহানী বলেছেন যে, ফেরদৌস (উদ্যান) ছিল পৃথিবীতে। তাঁদের অনুযায়ী, পতন বা নেমে যাওয়া (আল-ইহ্বাৎ’) হচ্ছে এক যায়গা থেকে অন্যত্র স্থানান্তর, কেননা কোরান শরীফে অপসারণ অর্থে নেমে যাওয়া (ইহবাৎ)ক্রিয়াপদটি ব্যবহৃত হ্রয়ছে। যেমন, এক স্থানে [হযরত মূসার উম্মতদের প্রসঙ্গে] বলা হয়েছে যে, ‘তোমরা মিসরে নেমে যাও ’ (কিংবা ‘তোমরা কোন শহরে নেমে যাও’-‘ইহবিতু মিসরান’)। (দ্রষ্টব্য সূরা বাকারা ৬১

কিন্তু আজ-জাব্বাঈ বলেছেন যে, ফেরদৌস (উদ্যান) রয়েছে সপ্তম আসমানে, তাই ‘সেখান থেকে নেমে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে যে, এই প্রসঙ্গে কোরান শরীফের উক্তি তওরাত শরীফের পয়দায়েশ-খন্ডের বিবরণের সঙ্গে মিলে যায়। তওরাত শরীফেও ফেরদৌসের নির্দিষ্ট কোন গাছের ফল খাওয়াকে হযরত আদমের অবাধ্যতা বলে দেখানো হয়েছে।

যাই হোক, এই গাছের ব্যাপারে মুসলিম আলেমগণ মতভেদ পোষণ করেছেন। তাঁরা বহু বিবরণ দিয়েছেন এবং সব বিবরণই প্রস্তুত হয়েছে হাদীস শরীফের প্রমাণের ভিত্তিতে। যেমন:-

‘আব্দ আর রায্যাক্বের উদ্ধিৃতি দিয়ে ইসহাক্ব বলেছেন: “ইবনে ‘উয়াইনা ও ইবনে মুবারক ও আল-হাসান বিন, ‘আমারা ও মিনহাল বিন ‘আমরূ ও সা’ঈদ বিন জুবাইর ও ইবনে ‘আব্বাস আমাদের জানিয়েছেন যে, হযরত আদম ও তাঁর স্ত্রীকে আল্লাহ্ যে গাছ নিষিদ্ধ করে দিয়েছিলেন, তা হচ্ছে শস্যের একটি শিষ।”

‘ইবনে হামিদ বলেছেন, ইবনে ইসহাক্ব, ইয়ামানের কিছু লোক, ও ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ্ আল-ইয়ামানীর উদ্ধিৃতি সালামা তাঁকে জানান যে, সেটা ছিল গম; কিন্তু এই গমে একটি মাত্র দানা আকারে ছিল গাভীর একটা গুর্দার সমান আর তা ছিল মাখনের চাইতে নরম, মধুর চাইতে মিষ্টি।

*কথিত আছে, আবু বক্র সিদ্দিক্ব আল্লাহ্‌র রসূলের কাছে গাছটি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বললেন, “এই জান্নাতী গাছ হচ্ছে শস্যের একটি শিষ।”

*সালামা বলেছেন, মুহম্মদ বিন ইসহাক্ব ও ইয়াকুব বিন ‘আতাবা তাঁকে জানান যে, ফেরেশতারা এই গাছকে ঘর্ষণ করে অমরত্ব দান করেছিলেন।

*ইবনে ওয়াকীঅ’ বলেছেন, তিনি ‘আব্দ্ আল্লাহ্‌র কাছ থেকে যিনি ইসরাঈলের কাছ থেকে, যিনি আস-সাদ্দীর কাছ থেকে, যিনি ইবনে ‘আব্বাসের কাছ থেকে জানতে পারেন যে, সেটা ছিল আঙুর-গাছ।

*মুজাহিদ ও ক্বাতাদা বলেছেন, গাছটা ছিল ডুমুর-জাতীয়।

*আর-রবীঅ’ইবনে ঊনস্ বলেছেন যে, সেই গাছের ফল যে খাবে, তার দাস্ত হবে, আর ফেরদৌস এমন জায়গা, যেখানে মল ত্যাগ করা উচিৎ নয়।

শয়তানের প্ররোচনায় হযরত আদম ও বিবি হাওয়া নিষিদ্ধ ফল খাবার জন্য সেই গাছের কাছে গিয়েছিলেন, কোরান শরীফের এই বর্ণনাও তৌরাত শরীফের পয়দায়েশ-খন্ডের বর্ণনার সঙ্গে মিলে যায় এবং এখানে কোরান শরীফের বিবরণে রয়েছে, “শয়তান তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল” “আযাল্লা-হুমাষ-শাইতান”)।

ইবনে ‘আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে জুরাইজ বলেছেন, “শয়তান তাহাদের পদস্খলন ঘটাইল” বলতে বুঝতে হবে “শয়তান তাদেরকে পলুব্ধ করে বিপথে চালিত করল”।

কোরান শরীফের শিক্ষা-অনুযায়ী হযরত আদম ছিলেন নবী, আর ইসলামের শিক্ষায় নবীরা হলেন অভ্রান্ত।এর ফলে হযরত আদমের “পতনে’র ব্যাপারটা সমসার সৃষ্টি করেছে। তফসীরকারেরা তাই এ সমসার সমাধান করেছেন পলায়নবাদী মনোভব পোষণ করে। তাঁরা বলেছেন যে, হযরত আদম যখন আল্লাহ্‌র আদেশ অমান্য করেন, তখন তিনি নবী হননি, বরং পরে নবী হয়েছিলেন।কিন্তু এই মত সর্বসম্মত নয়। অন্যান্য তফসীরকার বলেছেন, হযরত আদম প্রথম থেকেই নবী ছিলেন, কিন্তু অন্যমনস্কতার কারণে তাঁর পতন ঘটে। দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তাঁরা বলেছেন, যেমন রোযা রেখে কেউ ভুলবশতঃ কিছু খেয়ে ফেলেন, কেননা তাঁদেরকে জীবনের অন্যান্য কাজে লিপ্ত থাকতে হয়। এমন মতও রয়েছে যে বিবি হাওয়া হযরত আদমকে মদ পান করিয়েছিলেন এবং নেশাগ্রস্ত অবস্থায় তিনি এই পাপে লিপ্ত হন।

এই ব্যাখ্যা কেমন করে গ্রহণযোগ্য হতে পারে, আমরা তা বুঝতে পারি না। কারণ, কোরান শরীফে রয়েছে:

“অতঃপর আদম তাহার প্রতিপালকের নিকট হইতে কিছু বাণী প্রাপ্ত হইল। আল্লাহ্ তাহার প্রতি ক্ষমাপরবশ হইলেন। তিনি অত্যন্ত ক্ষমাপরবশ, পরম দয়ালু।”

সূরা বাকারা ৩৭

তিনি পাপ না করে থাকলে আল্লাহ্‌র ক্ষমার প্রশ্ন উঠত না। সুতরাং তিনি নিশ্চয় জেনেশুনে পাপ করেছিলেন। অবশ্য কিতাবুল মুক্বাদ্দসে বলা হয়েছে যে, এই পাপের জন্য বিবি হাওয়াকে তিনি দায়ী করতে চেষ্টা করেন।

অন্যদিকে বহু আলেমের মত হচ্ছে, হযরত আদম ইচ্ছাকৃতভাবে সেই নিষিদ্ধ গাছের ফল খান। যেমন:-

ইউনিস ‘আবদ্-আল-আ’লা ও ওয়াহাব ও ইবনে বাইদের উদ্ধৃতি দিয়ে আবু জা’ফর আৎ-তাবারী “আদম কর্তৃক আল্লাহ্‌র কিছু বাণী লাভ” কথাটার ব্যাখ্যায় বলেছেন, “এই আয়াতের মাধ্যমে আল্লাহ্ তাঁদেরকে বলতে শিখিয়েছেন,‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমরা অন্যায় করেছি; তুমি যদি আমাদের ক্ষমা না করো, আমাদের উপর রহম না করো তাহলেতো নিশ্চয় আমরা তলিয়ে যাব।”

“আম্র্ বিন হাম্মাদ ও আসবাৎ ও আস-সাদ্দীর উক্তি উদ্ধৃত করে মূসা বিন হারুন কোরান শরীফের এই একই আয়াতের এইরূপ ব্যাখ্যা দিয়েছেন:“আদম আল্লাহ্কে বললেন, ‘তুমি কি নিজের হাতে আমাকে তৈরী করোনি? ‘উত্তর এল, ‘হ্যা।’ ‘তুমি কি তোমার রূহ আমার মধ্যে ফুকে দাওনি?’ ‘উত্তর এল, ‘হ্যাঁ।’ ‘তোমার রহমত কি তোমার ক্রোধের গজবকে ছাড়িয়ে যায় না?’ উত্তর এল, হ্যাঁ।’ হে আল্লাহ্ আমি যে, এই পাপ করব, তুমি কি তা আগে থেকেই স্থির করে রেখেছিলে?’ উত্তর এল, ‘হ্যাঁ’ তখন আদম জানতে চাইলেন, ‘আমি যদি তওবা করি আর সংশোধিত হই তুমি কি আবার আমাকে ফেরদৌসে (উদ্যানে) ফেরত পাঠাবে না?’ আল্লাহ্ বললেন, ‘হ্যাঁ’। তারপর, আল্লাহ্ তার তওবা কবুল করলেন, তাঁর উপর সন্তুষ্ট হলেন এবং তাঁকে চালিত করলেন।

আর একটি বিবরণ দিয়েছেন মুহম্মদ বিন বাশ্শার, যিনি তা উদ্ধৃত করেছেন ‘আব্দ্-আর-রহমান বিন মাহ্দী থেকে, মাহদী তা জেনেছেন সুফিয়ানের কাছ থেকে, সুফিয়ান তা পেয়েছেন ‘আবদ্-আল-আযীয বিন রফীঅ’র কাছ থেকে, রফীঅ’ আবার তা জানতে পেরেছেন এমন এক ব্যক্তির কাছ থেকে, যিনি বলতে শুনেছেন ‘উবাইদ বিন “উমাইরকে যে, আদম বললেন, “হে আল্লাহ্, আমি যে পাপ করেছি, সেটা কি আগে থেকেই তুমি স্থির করে রেখেছিলেন, নাকি তা আমারই নিজের সৃষ্টি?” “আল্লাহ বললেন, “তুমি যদি আগে থেকেই আমার জন্য তা স্থির করে রেখে থাকো, তাহলে আমাকে ক্ষমা করে দাও।” তখনকার এই উপলক্ষে আয়াতটি আসে যে, আদম আল্লহার কাছ থেকে কিছু বাণী লাভ করলেন।

হযরত আদম যে স্বেচ্ছায় পাপ করেছিলেন, এই সত্য কিন্তু এত সব ব্যাখ্যা থেকে খারিজ হয়ে যাচ্ছে না। আল-ফখ্র্ আর-রাযীও ঠিক তাই মনে করেছেন। তাঁর ভাষায়ঃ-

“মানুষের ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে যে সব আয়াতের সম্পর্ক বলে আলেমরা মনে করেন, তার সংখ্যা অনেক। তার মধ্যে আদমের ঘটনাকে নিয়ে লেখা আয়াতটিই হবে প্রথম। এর উপর সাতটি মত রয়েছেঃ

  1. “তিনি অবাধ্য ছিলেন, আর অবাধ্যতা দুইভাবে মহাপাপ। প্রথমতঃ, কোরানের চাহিদা হচ্ছে, সর্বশক্তিমানের কথা-অনুযায়ী আদমকে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে, কেননা আল্লাহ বলেছেন, ‘আল্লাহ্ ও তাঁর রসূলের যে অবাধ্যতা করে, জাহান্নামের আগুন তার প্রাপ্য।’ দ্বিতীয়তঃ, ‘অবাধ্য’ কথাটা এমনই অসম্মানজনক যে, মহা পাপিষ্ঠ ছাড়া অন্য কারো উপর তা আরোপ করা উচিৎ নয়।
  2. “আদমের ঘটনা থেকে দেখা যায় যে, তাঁকে প্রলোভিত করা হয়েছিল, কেননা কোরআন শরীফেই আছে যে, তাঁকে প্রলোভিত করা এবং প্রলোভিত হওয়া সদাচারের পরিপন্থী।
  3. “তিনি অনুতপ্ত হন, তওবা করেন, আর অনুতাপকারীও অপরাধী। অনুতাপ আসে অপরাধের অনুশোচনা থেকে। এইভাবে যার মনে অনুশোচনা এসেছে, সেই ব্যক্তিই নিজেকে অপরাধী বলে স্বীকার করে। যদি স্বীকারোক্তিতে কেউ মিথ্যা বলে, তাহলে মিথ্যাচারের অপরাধেও সে অপরাধী, আর সত্য বললে সে নিজেই তার অপরাধের প্রমাণ দিচ্ছে।
  4. “আল্লাহ্ যা করতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন, আদম ঠিক সেইটাই করেছেন। আল্লাহ্ বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদের দুজনের জন্যই ঐ গাছ নিষিদ্ধ করে দিইনি?’ তিনি আরও বলেছেন, ‘আমি কি বলিনি, ঐ গাছের কাছে যেও না? ঠিক যেটা নিষিদ্ধ করা হয়েছে, সেইটাই করা মারাত্মক অপরাধ।
  5. আল্লাহ্ নিজেই আদমকে ‘সীমা লঙ্ঘনকারী’ বলেছেনঃ ‘তাহলে তুমি সীমা লঙ্ঘনকারীদের মধ্যে গণ্য হবে।’ এই আয়াতে আদমও নিজেকে সীমা-লঙ্ঘনকারী বলেছেনঃ “হে পরওয়ারদেগার, আমরা নিজেরাই সীমা লঙ্ঘন করেছি। আল্লাহর কথাতেই দেখা যায় যে,সীমা-লঙ্ঘনকারী অভিশপ্ত। ‘সত্যই সীমা-লঙ্ঘনকারীর উপর আল্লাহ্‌র অভিশাপ থাকবে।’ যে ব্যক্তি এহেন অভিশাপ অর্জন করেছেন, তিনি নিশ্চয় মহা-পাপিষ্ঠ।
  6. “আদম স্বীকার করেন যে, আল্লাহ্ যদি তাঁকে ক্ষমা প্রদর্শন না করেন, তাহলে, যারা সব-কিছু হারিয়েছে, তিনি তাদের একজন হবেন। এইভাবে তিনি নিজেই নিজেকে মহা-পাপিষ্ঠ ঘোষণা করেন।
  7. “শয়তানের শঠতার কারণে তাঁকে ফেরদৌস থেকে বহিস্কার হতে হয়। শয়তানের বশ্যতা স্বীকার করার ক্ষতিপূরণ হল তাঁর এই অধঃপতন। এর থেকেই স্পষ্ট হয় যে, তিনি মহাপাপ করেছিলেন।”

শয়তান কীভাবে ফেরদৌসে (উদ্যানে) প্রবেশ করে এবং হযরত আদমকে প্রলোভিত করতে সক্ষম হয়, সেই নিয়েও আলেমদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়।

ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ্ ও আস-সাদ্দী ও ইবনে ‘আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে আল-ক্বাস্সাস বলেছেন: “শয়তান ফেরদৌসে প্রবেশ করতে গেলে ফেরেশ্‌তা-প্রহরীদের দ্বারা সে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তখন সে জীব-জন্তুদের সহায়তায় প্রবেশের চেষ্টা করলে সবাই তাকে প্রত্যাখ্যান করে। এরপর সে সরীসৃপের শরণাপন্ন হয়। চারপায়ে দ্রুত হাঁটতে সক্ষম এই প্রাণী এগিয়ে আসে সাহায্য করতে। সুতরাং শয়তানকে সে গিলে, পেটের মধ্যে লুকিয়ে নিয়ে গোপনে ফেরদৌসে প্রবেশ করে। সরীসৃপের পেট থেকে বের হয়ে শয়তান অতি-দ্রুত কুমন্ত্রণা ছড়াতে থাকে ফেরদৌসের মধ্যে। বলা বাহুল্য, সরীসৃপ অভিশপ্ত হয়ে চারটি পা-ই হারায় এবং বুকে হাঁটা অভ্যাস করতে হয় তাকে। জীবন ধারণের উপায় খুঁজে বেড়াতে হয় ধুলো মাটির মধ্যে এবং পরিণত হয় আদম-সন্তানের শত্রুতে।

আৎ-তাবারী তাঁর “জামীঅ’ আল-বয়ান” গ্রন্থে আল-হাসান আবী ইয়াহ্ইয়া ও আব্দ-আর-রায্যাক্বের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন:

“আমরা ‘আম্র্ বিন‘আবদ্-আর-রহমান বিন মুহাররিবের কাছ থেকে জেনেছি, তিনি ওয়াহাব বিন মুনাব্বিহ্কে বলতে শুনেছেন যে, আল্লাহ্ যখন আদম ও তাঁর বংশধরদের ফেরদৌসে রাখলেন, তখন তিনি তাঁদেরকে নির্দিষ্ট গাছটার কাছে যেতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। গাছটার পাকানো-পেঁচানো অনেক ডালপালা আর সেই ডালপালায় অনেক ফল। ফেরেশতারা সেই ফল খান অমরত্বলাভের উদ্দেশ্যে। আল্লাহ্ এই ফল খেতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন আদম ও তাঁর স্ত্রীকে। শয়তান যখন চাইল, তাঁদের পতন হোক, তখন সে সরীসৃপের পেটের মধ্যে ঢুকল। এই সরীসৃপের চারটি পা, আর আল্লাহ্ তাকে সৃষ্টি করেছিলেন অতি-উত্তমভাবে হাঁটতে সক্ষম প্রাণী হিসেবে। সরীসৃপ ফেরদৌসে প্রবেশ করলে তার পেট থেকে শয়তান বেরিয়ে এল এবং নিষিদ্ধ গাছের ফল পেরে নিয়ে গেল হাওয়ার কাছে। বলল, দেখ, কী চমৎকার এই ফলের গন্ধ, কী মজাদার এই ফল খেতে, আর কী সুন্দর এর রং!’ তাই শুনে হাওয়া তা খেলেন, আর নিয়ে গেলেন আদমের কাছে। বললেন, ‘দেখ, কী চমৎকার এই ফলের গন্ধ, কী মজাদার এই ফল খেতে, আর কী সুন্দর এর রং !’ তাই শুনে আদমও খেলেন সেই ফল এবং তাদের মধ্যে লজ্জানুভূতি দেখা দিল। আদম গাছের গর্তের মধ্যে লুকালেন। আল্লাহ তখন তাঁকে ডাকলেন, ‘কোথায় তুমি, হে আদম?’ তিনি উত্তর করলেন, ‘হে পরওয়ারদেগার, এই যে, আমি এখানে।’ আল্লাহ্ প্রশ্ন করলেন, ‘তুমি কি আর ওখান থেকে বের হয়ে আসবে না?’ আদম বললেন, হে পরওয়ারদেগার, আমি তোমার সামনে বের হতে বিব্রত বোধ করছি।’ তখন আল্লাহ্ বললেন, ‘যে মাটি দিয়ে তোমাকে তৈরী করা হয়েছে, অভিশাপ সেই মাটির উপর, আর এই অভিশাপ, এর ফল-কে পরিণত করুক কাঁটায়।’(ফেরদৌসে কিংবা পৃথিবীতে এই ফলের তুল্য কিছুই আর ছিল না, যা ছিল কলা ও পদ্মের চাইতে সরেস।) তারপর আল্লাহ্ বললেন, হে হাওয়া, তুমি আমার দাসকে প্রবঞ্চিত করেছ। তীব্র অনিচ্ছা-ভাব ছাড়া তুমি কখনও অন্তসত্ত্বা হবে না, আর যখন তুমি সন্তান প্রসব করতে চাইবে, তখন তোমার মরণদশা দেখা দেবে প্রায়ই।, সরীসৃপকে তিনি বললেন, ‘সর্বাধিক অভিশপ্তকে (শয়তানকে) তুমিই নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেরদৌসে নিয়ে এসেছিলে আমার দাসকে প্রবঞ্চিত করার জন্য। সুতরাং তুমি সর্বাংশে অভিশপ্ত। তোমার পা-গুলি তোমার পেটের মধ্যে সেঁধিয়ে যাক। ধূলো-মাটির মধ্যে ছাড়া আর কোথাও তোমার জীবন ধারণের কোন উপায় থাকবে না। তুমি মানুষের শত্রু আর মানুষ হোক তোমার শত্রু। মানুষ দেখা-মাত্র তুমি তাকে ছোবল মারবে আর তোমাকে দেখা-মাত্র মানুষ তোমার মাথা গুড়িয়ে ফেলবে।’”

ইসলামী শরীয়তের অন্য বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, আদম ও হাওয়া ফেরদৌসের সদর দরজার দিকে যাচ্ছিলেন- এমন সময় কাছাকাছি ওৎ পেতে-থাকা শয়তান এসে উপস্থিত হল আর কুমন্ত্রণা দিয়ে তাঁদেরকে বশীভূত করল।

যাইহোক, হযরত আদম পাপ করেছিলেন কিনা, কোরান শরীফ তা নিশ্চিত করে নির্ধারণ করে দিয়েছে, এবং সেখানে রয়েছে এই আয়াত দুটি:

“অতঃপর শয়তান তাহাকে (আদমকে) কুমন্ত্রণা দিল; সে বলিল, ‘হে আদম ! আমি কি তোমাকে বলিয়া দিব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা?’ অতঃপর তাহারা (আদম ও হাওয়া) উহার ফল ভক্ষণ করিল; তখন তাহাদিগের লজ্জাস্থান তাহাদিগের নিকট প্রকাশ হইয়া পড়িল এবং তাহারা উদ্যানের বৃক্ষপত্র-দ্বারা নিজদিগকে আবৃত করিতে লাগিল। আদম তাহার প্রতিপালকের অবাধ্য হইল, ফলে সে পথভ্রষ্ট হইল।”

সূরা তাহা ১২০-১২১

“ফলে সে পথভ্রষ্ট হইল” (“ফা-‘গাওয়া”)– এই উক্তির অন্তর্গত “পথভ্রষ্ট” শব্দটির উৎস-শব্দের অর্থ “ভ্রম”। আর-রাযী “পথভ্রষ্ট” শব্দের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, এটি “ভ্রম” শব্দের সমার্থক। “ভ্রান্তির” বিপরীতার্থক শব্দ হবে “চরিত্রের সুদৃঢ়তাঃ। এই ধরনের পাপ কেবল এমন কলুষিত চরিত্রের লোকের দ্বারা সংঘটিত হতে পারে, যে অসৎ জীবনযাপনে ফিরে গেছে।

আবু ইমাম আল-বাহিলী বলেছেন:

“আদমের ঘটনাটা ছিল অতি-বিশেষ। আল্লাহ্ আদমের মধ্যে অবিরত বিশ্রাম আর সুশৃঙ্খল জীবনধারার আগ্রহ জাগিয়ে দিয়েছিলেন। কারণ, আল্লাহ্ বলেছেন; ‘সে (শয়তান) যেন কিছুতেই তোমাদিগকে জান্নাত (উদ্যান) হইতে বাহির করিয়া না দেয়, দিলে তোমরা দুঃখ-কষ্ট পাইবে।’‘ (ঐ:১১৭), ‘ এবং সেথায় (উদ্যানে) পিপাসার্ত হইবে না ও রৌদ্রক্লিষ্টও হইবে না।’ (ঐ :১১৯)

বিপরীতক্রমে শয়তানও আদমের মনে অবিরত সুখ আর সুস্থির জীবনের আগ্রহ এনে দিয়েছিল: ‘আমি কি তোমাকে বলিয়া দিব অনন্ত জীবনপ্রদ বৃক্ষের কথা ও অক্ষয় রাজ্যের কথা? ’ আল্লাহ্ আদমের মধ্যে যে আগ্রহ জাগিয়ে তোলেন, শয়তানও তাঁর মধ্যে জাগিয়ে তোলে সেই একই আগ্রহ। কিন্তু আল্লাহ্ সেজন্য শর্ত দেন যে, এই গাছের ফল স্পর্শ করবে না, বিপরীত পক্ষে শয়তান সেই নিষিদ্ধ ফলই খেতে আদমকে উদ্বুব্ধ করে। তাহলে, যখন দেখা যাচ্ছে যে, আদমের খঁাঁটি মন ছিল আর এই জ্ঞান ছিল যে, আল্লাহ্ তাঁর পরওয়ারদেগার, শিক্ষক আর সহায় এবং শয়তান তাঁর চরম শত্রু, তখন কেমন করে তিনি সেই শয়তানেরই কুমন্ত্রনা মেনে নিলেন আর আল্লাহ্‌র উপদেশ অগ্রাহ্য করলেন?”

সত্য বটে যে, তফসীর কারেরা তাঁদের ব্যাখ্যায় হযরত আদমের পাপ খন্ডন করতে পারেননি। কারণ, আমরা আগেই দেখেছি, কোরআন শরীফে তাঁর পাপের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে এই ভাষায়:

“আদম তাহার প্রতিপালকের অবাধ্য হইল, ফলে সে পথভ্রষ্ট হইল।”

তফসীরকারেরা সবাই কোরান শরীফের আয়াতসমূহের উপর নির্ভর করে একমত যে, আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা অপরাধ, এই অবাধ্যতা আল্লাহ্কে অবজ্ঞা করার সমতুল্য এবং এর চাইতে বড় পাপ আর হয় না। সুতরাং যে ব্যক্তি এই প্রকারের কঠোর শাস্তি পাবার উপযুক্ত পাপ করেছে, তাকে “মহা-পাপিষ্ঠ” নামে আখ্যায়িত না করবার কোন কারণ দেখা যায় না।

মসীহী মতে পাপ

মানবজাতির ইতিহাসে পাপের প্রকাশ সুস্পষ্ট। আমরা সবাই যদি নিজের নিজের অন্তঃকরণের খোঁজ নিই কিংবা অন্যের আচরণ লক্ষ্য করি, তাহলে অবশ্যই এই পাপ আমরা প্রত্যক্ষ করব। সকল মানুষ, এমন কি যাদের উপর আল্লাহ্‌র ওহি এসেছে, তাঁরা নিজেদের পাপ সম্বন্ধে সচেতন। তাঁরা স্বীকার করেন যে, তাঁরা পাপ করেছেন, তাঁদের মধ্যে ত্রুটি রয়েছে এবং নিজেদের উপর অর্পিত নৈতিক দায়িত্ব সম্পূর্ণরূপে পালন করতে তাঁরা অক্ষম।

অনেকে মনে করেন, পাপ খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। আসলে, পাপ কেবল লজ্জাজনক নয়, তার চাইতে অনেক বেশি কিছু।

পাপ আল্লাহ্-পাকের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়াও বটে, যে আল্লাহ্-পাক হচ্ছেন আমাদের চরম, পরম ও একমাত্র লক্ষ্যস্থল। এই দূরে-সরে-যাওয়া কেবল যে মন্দের প্রতি ঝোঁক তাই নয়- বরং ভাল কাজ থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।

অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে, পাপের ক্ষমতা সম্পর্কে আর আমাদের মধ্যে পাপের প্রভাবের শক্তি সম্পর্কে একজন স্বাভাবিক মানুষের (ঘধঃঁৎধষ সধহ) উপলব্ধি থাকে না। ঈমানদার বান্দা ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র কাছ পর্যন্ত পৌঁছাবার উপায় হিসেবে আল্লাহ্-পাকের শরীয়ত অনুসরণ করেন। মসীহ্ তাঁকে রহমত দান করেছেন এবং সেই বান্দা জানেন যে, পথভ্রষ্ট করবার জন্য বাস্তবে পাপের কী মোহময় ক্ষমতা রয়েছে। সেজন্য তাঁর ক্ষেত্রে আল্লাহ্‌র রহমত আর কাফফারার জন্য রক্তের চাহিদার যে উপযোগিতা রয়েছে, তিনি সে ব্যাপারে সচেতন হয়ে ওঠেন।

সাধারন ভাবে পাপের অর্থ “খোদার শরীয়ত অমান্য করা”। (১ ইউহোন্না ৩:৪)। পাপীর বক্তব্য যা-ই থাকুক আর পাপ যতই ক্ষুদ্র হোক না কেন, আল্লাহ্ পাপ-মাত্রকেই অপছন্দ করেন।

জগতে পাপের আগমন

কিতাবুল মুক্বাদ্দস ইঞ্জিল শরীফের রোমীয়-খন্ডের ৫:১২ আয়াতে আমরা পড়ি:

“একটি মানুষের (আদমের) মধ্য দিয়া পাপ দুনিয়ায় আসিয়াছিল ও সেই পাপের মধ্য দিয়া মৃত্যুও আসিয়ছিল। সমস্ত মানুষ পাপ করিয়াছে বলিয়া এইভাবে সকলের নিকটই মৃত্যু উপস্থিত হইয়াছে।”
ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ৫:১২

এখানে বলতে চাওয়া হয়েছে যে, সকল মানুষের পাপী হবার কারণ মানবজাতির পিতা হযরত আদম। “একটি মানুষের মধ্য দিয়া” কথাটা ব্যবহার করতে গিয়ে হযরত পৌল হযরত আদম ও বিবি হাওয়াকে একক-সত্তা হিসেবে দেখেছেন। তওরাত শরীফের পয়দায়েশ-খন্ডেও (৫:২) সেই উল্লেখ পাওয়া যায়। হযরত পৌলের বর্ণনায় সরীসৃপের প্রলোভন বা বিবি হাওয়ার অবাধ্যতার উল্লেখ নেই। কারণ, তাঁর কেবল এইটুকু দেখানো উদ্দেশ্য ছিল যে, পরবর্তী সকল বংশধরের প্রতিনিধি হযরত আদম।

কোন কোন দর্শনবিদ বলেন যে, মানব-শিশুর জন্ম হয় নিষ্পাপ অবস্থায়, পরে পাপপূর্ণ পরিবেশে বাস করতে গিয়ে সে সেই পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয় এবং তার মধ্যে পাপ প্রবেশ করে। কিন্তু সত্য হচ্ছে যে, পাপের স্বভাব নিয়েই মানুষ জন্মগ্রহন করে। পাপপূর্ণ পরিবেশে পাপের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে বটে কিন্তু মানুষ নিজ অন্তঃকরণে মূলতঃই পাপী।

উত্তরাধিকার- সূত্রে পাপ

আমরা অভিজ্ঞতা থেকে জানি, কোন জীবন্ত প্রাণী নিজের প্রকৃতি থেকে ভিন্নতর অন্য কোন প্রাণীর জন্ম দিতে পারে না। ষাঁড় কখনও ভেড়ার জন্ম দেয় না। যেমন ঈসা কালেমাতুল্লাহ্ বলেছেন, “কাটাগাছে কখনও আঙ্গুর ধরে না।

মানুষের বেলায়ও এই বিধান প্রযোজ্য। মানবজাতির পিতা হযরত আদম আল্লাহ্‌র প্রতি অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে নিজের সদাচারী জীবন হারিয়ে বসেন। এই পাপের শাস্তি হিসাবে তাঁকে নেমে আসতে হয় অভিশপ্ত পৃথিবীর মাটিতে। পৃথিবীতে এসে তিনি সন্তান-সন্ততি জন্ম দেন। কালক্রমে তাঁর বংশধরদেরকে ফেরদৌসের পবিত্রতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ থাকতে হয়। হযরত দাউদের ভাষায় ইঞ্জিল শরীফে এই সত্যের উল্লেখ রয়েছে:

“দেখ, অপরাধে আমার জন্ম হইয়াছে, পাপে আমার মাতা আমাকে গর্ভে ধারণ করিয়াছিলেন।”

জবুর শরীফ ৫১:৫

হযরত পৌলও বলেছেন:

“নির্দোষ কেহ নাই, একজনও নাই; কেহ খোদার বিষয়ে বুঝিতে পারে না, আর কেহ তাঁহাকে খোঁজেও না। সমস্ত মানুষই খোদার পথ হইতে সরিয়া গিয়াছে, সকলে এক সঙ্গে অপদার্থ হইয়া গিয়াছে। ভাল কাজ কেহই করে না, একজনও না।”

ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ৩:১০-১২

অগাস্তাইন অধঃপাত সম্পর্কে আর পাপের উত্তরাধিকার সম্পর্কে কিতাবুল মুক্বাদ্দসের শিক্ষা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন:

  1. আল্লাহ্-পাক জ্ঞানে, সততায় ও পবিত্রতায় তাঁর নিজের মতো করে প্রথম মানুষটিকে সৃষ্টি করেন। তাঁকে তিনি সৃষ্টি করেন অমর করে। তাঁকে তিনি অন্যান্য প্রাণীর দায়িত্ব প্রদান করেন। আদমকে তিনি ভাল ও মন্দের মধ্যে পার্থক্য করবার ক্ষমতা দেন। এইভাবে আল্লাহ্-পাক আদমের শুদ্ধ নৈতিক প্রকৃতি গড়ে তোলেন।
  2. আদমকে নিজের পথে স্বাধীনভাবে চলবার ক্ষমতা দেওয়া হয়। কিন্তু শয়তানের প্ররোচনায় অন্যায় কাজ করে তিনি আল্লাহ্‌র বিরুদ্ধে পাপ করেন। যে জীবনের জন্য তাঁকে সৃষ্টি করা হয়েছিল, সেই জীবন থেকে তিনি পড়ে যান।
  3. তাঁর মধ্যে যে, আল্লাহ্‌র সাদৃশ্য ছিল, অবাধ্যতার কারণে তাঁকে তা হারাতে হয়। তাঁর সম্পূর্ণ প্রকৃতি দোষযুক্ত হয়ে যায়, তিনি তাবাহ্ হন। এখন রূহগতভাবে মৃত্যু হওয়ায় তিনি ভাল করবার অযোগ্য হয়ে পড়েন। দৈহিক মৃত্যুর যোগ্যতা অর্জন করায় এখন তিনি অনন্ত জীবন হারিয়ে বসেন এবং ইহজগতের সকল মন্দ ও অনন্ত মৃত্যুর বশীভূত হন।
  4. এইভাবে, গোটা মানবজাতির প্রধান হিসাবে আদমের জন্য যা-কিছু সত্য, তাঁর সকল বংশধরের জন্যও তাইই সত্য। তারা সবাই জন্মগতভাবে পাপী, আল্লাহ্‌র সাদৃশ্য থেকে মুক্ত, আর নৈতিকভাবে অধঃপতিত।
  5. আমল বা কাজের মাধ্যমে পাপ না করলেও উত্তরাধিকার-সূত্রে ব্যক্তিমাত্রই ত্রুটিপূর্ণ, দোষযুক্ত। সুতরাং, প্রত্যেক মানবসন্তান পাপী।
  6. আদমের পাপের কারণে মৌলিক সততা যে নষ্ট হয়ে যায় আর স্বভাবের মধ্যে যে দোষ দেখা দেয়, সেটাই হচ্ছে প্রথম পাপের শাস্তি।
  7. পুনরুদ্ধার হচ্ছে পাক-রূহের আশ্চর্যজনক কাজ। মানুষ এর লক্ষ্য-কর্তা নয়। ব্যতীক্রমহীনভাবে এর সম্পর্ক আল্লাহ্‌র অভিপ্রায়ের সঙ্গে। নাজাত বা মুক্তিই একমাত্র রহমত।

মানুষের উপর পাপের ফল

ইংরেজ বিজ্ঞানী হাক্সলী বলেছেন:

“এমন কোন গবেষণার কথা আমি জানি না, যে গবেষণা মানবজাতির বিবর্তনের চাইতে বড় কোন আত্মিক দুর্দশার বিষয় আবিষ্কার করতে পেরেছে। ইতিহাসের অন্ধকার প্রেক্ষাপট থেকে এই রকমই মনে করা যায় যে, মানুষ তার নিজের মধ্যে রক্ষিত এমন এক উপাদানের সম্পূর্ণ মুখাপেক্ষী, যে উপাদান ভয়ঙ্কর শক্তি দিয়ে তাকে দমিয়ে রাখছে। এমন কিছু তাড়না আছে, মানুষ যার অন্ধ ও দুর্বল শিকারে পরিণত, মানুষকে যা ধ্বংস করে ফেলেছে। সীমাহীন যত প্রবঞ্চনায় ভুগে প্রচন্ড মানসিক যন্ত্রণা তার জীবনের সম্বল হয়ে উঠেছে। ফলে তার বাইরের দেহটা দুশ্চিন্তা আর উত্তেজনায় ঝরঝরে, নড়বড়ে। হাজার হাজার বছর ধরে তার এই অবস্থা-সে লড়ছে, আর বধ করছে করছে তারই কোন সমগোত্রীয়কে, এবং ফিরে যাচ্ছে মৃতের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতে আর তার কবরের উপর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করতে।”

পাপের ফল বুঝবার জন্য কারও আর কী প্রমাণের প্রয়োজন থাকতে পারে? মানুষের পক্ষে তার নানা প্রবণতা আর খেয়ালখুশী আবিষ্কারের জন্য এবং নিজের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা পাপের উপস্থিতি টের পাবার জন্য নিজেরই অন্তঃকরণের গভীরে দৃষ্টি বুলিয়ে নেওয়াই কি যথেষ্ট নয়?

সকল মানুষের মধ্যে এই সত্য সম্পর্কে ধারণা পাবার জন্য মানব-সমাজের দিকে এক ঝলক নজর বুলিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট। জবুর শরীফে (১৪:১) বলা হয়েছে:

“তাহারা নষ্ট হইয়াছে, তাহারা ঘৃণার্হ কর্ম করিয়াছে।”
জবুর শরীফ ১৪:১

এবং ইশাইয়া- খন্ডের (৫৩: ৬) উক্তি:

“আমরা সকলে মেষগণের ন্যায় ভ্রান্ত হইয়াছি, প্রত্যেকে আপন আপন পথের দিকে ফিরিয়াছি।” অধঃপতিত হবার আগে আদম আল্লাহর যে সাদৃশ্য ধারণ করতেন, আমরা সবাই সেই সাদৃশ্য থেকে বিবর্জিত।

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৫৩:৬

প্রত্যেক মানষের মধ্যে পাপের বিদ্যমানতা অবিসংবাদিত। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগত মর্মপীড়া সত্ত্বেও নৈতিক আইন মেনে চলতে সে য অক্ষম, এই সত্য থেকেই মানুষের পাপাচারী স্বভাবটা স্পষ্ট। এ হচ্ছে তার অধঃপতন ও ব্যর্থতার প্রমাণ। তাকে অবশ্যই পাক রূহের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সাহায্য লাভ করতে হবে। আজকে আমাদের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট যে, প্রথম মানুষের পতনের আগে তাঁর মধ্যে মৌলিক সততার যে গুণ ছিল, তার পর মানুষের আত্ম সেই গুণ থেকে বিবর্জিত হয়েছে।

বহু বছর যাবত জমে-ওঠা অপরাধের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা যথেষ্ট পরিমাণ চূড়ান্ত-রকমের প্রমাণ পাই যে, মানুষ খোদাই স্বভাব হারিয়ে ফেলেছে এবং পাপের স্বভাব আয়ত্ত্ব করেছে। আদমের পুত্র কাবিলের মধ্যে এই কুপ্রবৃত্তি আমরা প্রথম দেখতে পাই। তিনি নিজের ভাই হাবিলকে হত্যা করেন। কেন হত্যা করেন? কাবিলের মধ্যে কুপ্রবৃত্তি প্রবেশ করেছিল বলে নয় কি? আমরা কেন একে অন্যের সাথে ঝগড়া করি? আমাদের মনের গভীরে অদম্য কুপ্রবৃত্তি প্রবেশ করেছে বলে নয় কি? কেন এক জাতি অন্যজাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে? সকল মানুষের পুঞ্জীভূত পাপের কারণে নয় কি?

পাপের মজুরী তৌরাত শরীফে রয়েছে, আল্লাহ্ আদমকে বলেন:

“নেকী-বদী জ্ঞানদায়ক যে বৃক্ষ, তাহার ফল খাইও না কেননা যেদিন তাহার ফল খাইবে, সেইদিন মরিবেই মরিবে।”

তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ২:১৭

হিজকিল-খন্ড ১৮:১০):

“যে প্রাণী পাপ করে, সেই মরিবে।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, হিজকিল ১৮:১০

ইঞ্জিল শরীফের রোমীয় ৬:২৩:

“পাপ যে বেতন দেয় তাহা মৃত্যু।”

ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ৬: ২৩

হযরত আদম ও বিবি হাওয়া পাপ করার সঙ্গে সঙ্গে রূহানী দিক্ দিয়ে মারা যান, আল্লাহ্‌র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন এবং আল্লাহ্‌র সঙ্গে পাক রূহের একাত্মতা হারিয়ে বসেন। শুধু তাই নয়- তাঁদের মধ্য থেকে আল্লাহ্‌র সান্নিধ্যলাভের ইচ্ছাও বিলুপ্ত হয় এবং তাঁর কাছ থেকে লুকাবার জন্য ফেরদৌসের গাছের আড়ালে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় (পয়দায়েশ-খন্ড ৩: ৮)। সম্ভবতঃ দৈহিক শক্তির অভাবের জন্য কিংবা কোন অসুস্থতার জন্য তাঁরা আল্লাহ্‌র এই সতর্ক বাণী মনে রাখতে পারেন নি যে, “যেদিন তাহার ফল খাইবে সেইদিন মরিবেই মরিবে।”

কারও পাপের ফলভোগ সামনাসামনি দেখতে পেলে সে হবে নিশ্চয় ভয়বহ অভিজ্ঞতা। কিন্তু প্রথম মানব পরিবার কি সত্যই সকল সুযোগ সুবিধা হারিয়েছিলেন? পাপের ফলস্বরূপ যে ফেরদৌস হারাতে হয়, মানবজাতির সেখানে পুনঃপ্রবেশের সকল আশা কি তাহলে চিরতরে তিরোহিত হয়েছে? তার পবিত্রতা কি চিরকালের জন্য তার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে? না। কারণ, আল্লাহ্পাক হচ্ছেন মহব্বত। তাঁর মহব্বত রহমতের পারাবার। তিনি ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। পাপিষ্ঠের মৃত্যুতে আল্লাহ্-পাক আনন্দিত হন না, কেননা অপার রহমতে তাঁর হৃদয় পরিপূর্ণ। তিনি ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র ব্যক্তিসত্তায় ধরা দেন মানবজাতির মহান ত্রাণকর্তা ও পাপক্ষয়কারী হয়ে, আর ঈসা মসীহ্ যিনি আল্লাহ্ পাকের কালাম তিনি তো প্রথমে আল্লাহ্‌র সঙ্গে ছিলেন। আল্লাহ্‌র মহব্বত প্রথম যে কাজটি করে, তা হচ্ছে হযরত আদম ও বিবি হাওয়ার নগ্ন তাকে ঢেকে দেওয়া, তাঁদের দেহে চামড়ার পোশাক পরিয়ে দেওয়া (পয়দায়েশ-খন্ড ৩:২১)। আর, এইভাবে, এই ব্যবস্থার মধ্যদিয়ে আল্লাহ্-পাক কাফফারার নীতিমালার সূচনা করেন।

ক্ষমা করো আমাদের ঋণের দেনা।আমরাও দেনাদারকে ক্ষমা করি।

ইসলামের দৃষ্টিতে কাফফারা

কাফফারার মাধ্যমে পাপমোচনের বিষয়ে কোরান শরীফে ১৪ টি আয়াত পাওয়া যায়। কোরান শরীফের সূরাহ্সমূহের মধ্যে পাপ মোচনের উপর আল্লাহ্‌র যে প্রথম কালামটি রয়েছে, তা হচ্ছে:

“তোমরা যদি প্রকাশ্যে দান কর, তবে উহা ভাল, আর যদি তাহা গোপনে কর এবং অভাবগ্রস্তকে দাও, তবে উহা তোমাদের জন্য আরও ভাল। এবং তিনি তোমাদের কিছু কিছু পাপ মোচন করেন:…..”

সূরা বাকারা ২৭১

ফক্বীহ্গণ কাফফারার মাধ্যমে যে পাপমোচন, তাকে আড়াল বা পর্দা হিসাবে ব্যাখ্যা করেছেন। এই ব্যাখ্যা নবীদের পুরাতন কিতাবে লিখিত বক্তব্যের কাছাকাছি যায়। সত্য বটে যে ইহুদী ধর্মের মতো ইসলামেও ব্যক্তিগত আমল বা কর্ম পাপমোচনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সব কাজের মধ্যে সবচাইতে বেশি গুরুত্ব সালাতের (নামাযের-প্রার্থনার)। তাই বলা হয়েছে:

“সালাত কায়েম করিবে দিবসের দুই প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে। সৎকর্ম অসৎকর্ম মিটাইয়া দেয়।”

সূরা হুদ ১১৪

তিরমিযী শরীফে রয়েছে, আবী, ‘আলিইয়ু বলেছেন:

“একজন স্ত্রীলোক আমার কাছে খেজুর কিনতে এল। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চুমু খেলাম। তাপর, মুহম্মদের কাছে গিয়ে,যা-কিছু ঘটেছে, সব তাঁকে বললাম। তিনি মাথা নীচু করে চিন্তায় মগ্ন হলেন; অনেক্ষণ পর বললেন, ‘সালাত কায়েম করিবে দিবসের দুই প্রান্তভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে। সৎকর্ম ও অসৎকর্ম মিটাইয়া দেয়।’ এর অর্থ, পাঁচ ওয়াক্তের নামায পাপ ধুয়ে দেয় ও মোচন করে। তখন সাহাবীরা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে আল্লাহ্‌র রসূল এটা কি শুধু এই ব্যক্তির জন্য, না আমাদের সবার জন্যও?” তিনি বললেন, ‘সবার জন্য’।”

‘আব্দ্-আল্লাহ্‌র দেওয়া এই ঘটনার বর্ণনা উদ্ধৃত করে মুসলিম বলেছেন:

“এক ব্যক্তি নবীজীর কাছে এসে বলল, হে আল্লাহ্‌র রসূল, শহরের বাইরে থেকে আসা একটি স্ত্রী লোককে আমি স্পর্শ করেছি আর আমার কাম-বাসনা চরিতার্থ করেছি যদিও সঙ্গম করিনি। আমি পাপ করেছি। এখন, যেমন খুশী, আপনি আমাকে শাস্তি দিন।’ ‘ উমর সেখানে উপস্থিত ছিলেন- বললেন,‘তুমি যদি ব্যাপারটা গোপন রাখতে, তাহলে তোমার এই গোপন কথা আল্লাহ্ই কেবল জানতেন।’ আল্লাহ্‌র রসূল কিছুই বললেন না। লোকটা চলে গেল। নবীজী আবার তাকে ডাকলেন এবং ‘সালাত করিবে।’ আয়াতটি তেলাওয়াত করলেন।”

আবু বকরের উদ্ধৃতি দিয়ে মুসলিম বলেছেন:

“আল্লাহ্‌র রসূলকে আমি বলতে শুনেছি, “আল্লাহ্‌র দাসদের মধ্যে কেউ হস্ত মুখাদি প্রক্ষালন করে (ওযু করে) দিগুণ নামায আদায় করলে আর আল্লাহ্‌র কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করলে আল্লাহ্ তাকে ক্ষমা করবেন না, এমন হতে পারে না।” নবীজী তারপর তেলাওয়াত করলেন : ‘যাহারা কোন অশ্লীল কার্য করিয়া ফেলিলে অথবা নিজেদের প্রতি জুলুম করিলে আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং নিজেদের প্রতি জুলুম করিলে আল্লাহ্কে স্মরণ করে এবং পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে, আল্লাহ্ ব্যতীত কে [ তাহাদের ] পাপ ক্ষমা করিবে? এবং তাহারা যাহা করিয়া ফেলে, জানিয়া শুনিয়া তাহাই করিতে থাকে না।’ (সূরা আল ইমরান-ইমরানের বংশধর: ১৩৫)

পাপমোচনের জন্য নেক আমল করা হলে তাতে যে সুফল পাওয়া যাবে সে ব্যাপারে সব চাইতে বেশি স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে কোরান শরীফের এই উক্তিতে:

“সেদিন ওজন ঠিক ভাবেই করা হইবে। যাহাদিগের পাল্লা ভারী হইবে, তাহারাই সফলকাম হইবে; আর যাহাদিগের পাল্লা হাল্কা হইবে, তাহারাই নিজদিগের ক্ষতি করিয়াছে যেহেতু তাহারা আমার নিদর্শনকে (আয়াতকে) প্রত্যাখ্যান করিত।”

সূরা আল-আ’রাফ ৮-৯)

আমল কীভাবে ওজন হবে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ইমাম আ-রাযী দুটি জিনিসের উল্লেখ করেছেন:

প্রথমতঃ, আল্লাহ্ হাশরের দিন দাড়িপাল্লা স্থাপন করবেন তাতে একটি নিক্তি কাঁটা থাকবে আর দুদিকে দুটো ওজন-পাত্র। তাতে ওজন করা হবে মানুষের আমল- ভাল কাজ আর খারাপ কাজ।

ইবনে ‘ আব্বাসের বলে উল্লেখিত উক্তিতে রয়েছে:

“ঈমানদারের নেক আমল সুন্দর করে সযত্নে পাল্লায় রাখা হরে। তাঁর ভাল কাজ খারাপ কাজের চাইতে ভারী হবে।”

আমল কেমন করে ওজন করা হবে, তাই নিয়ে অনেক মত রয়েছে। তার মধ্যে একটা হচ্ছে যে, ঈমানদারদের নেক আমল একটা লেফাফায় করে নিয়ে আসা হবে এবং ঈমানহীনদের বদ আমল আনা হবে অন্য লেফাফায় করে। সেই দুই লেফাফা ওজন করা হবে। আর একমত হচ্ছে, মানুষের আমলের হিসাব যে কাগজে লেখা হয়েছে, সেই কাগজ ওজন করা হবে।

মুজাহিদ ও আয-যাহ্হাক ও আল-আ’মান-এর কাছ থেকে পাওয়া দ্বিতীয় উক্তি হচ্ছে: দাড়িপাল্লার উদ্দেশ্য হবে ন্যায়বিচার হাশরের দিন যে ওজন হবে, সে ব্যাপারে হযরত মুহম্মদকে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন, আমলনামা ওজন করা হবে।

দাড়িপাল্লার নিক্তিকাঁটার দৈর্ঘ্য আর ওজন-পাত্রের প্রশস্ততা সম্পর্কে বিশেষ একটা কাহিনী প্রচলিত আছে। ‘আব্দ্-আল্লাহ্ ইবনে সালাম বলেছেন: “দুই ওজনপাত্রের যে কোন একটাতে গোটা পৃথিবী আর আকাশমন্ডলীকে চাপানো হলেও স্থান সঙ্কুলানে কোন অসুবিধা হবে না। জিব্রাইল সেই দাড়িপাল্লার হাতল ধরে থাকলে তিনি তার নিক্তিকাঁটার দিকে নজর রাখতে পারবেন।”

ওজনের পদ্ধতী সম্পর্কে আব্দ্-আল্লাহ্ ইবনে বলেছেন: আল্লাহ্‌র রসূল বলেছেন, ‘হাশরের দিন লোককে দাড়িপাল্লার কাছে নিয়ে আসা হবে। আমলের ৯৯টি খাতা তাকে দেওয়া হবে। সেই সব খাতা তার চোখের সামনে মেলে ধরা হবে আর সে তার সবই দেখতে পারবে। সে তাতে দেখতে পাবে তার যত পাপ আর অরাধের বিবরণ। এই সব বিবরণ দাড়িপাল্লার একদিকে চাপানো হবে। তারপর, তার কাছে আনা হবে আঙুলের মাথার সমান ছোট্ট এক টুকরো কাগজ। তাতে লেখা থাকবে সেই লোকের স্বীকারোক্তি: “আল্লাহ্ ব্যতীত অন্য কোন মাবুদ নাই, মুহম্মদ তাঁর প্রেরিত রসূল।” কাগজের টুকরোটিকে চাপানো হবে দাড়িপাল্লার অন্যদিকে এবং সেই দিকটা পাপের দিকের চাইতে ভারী হবে।’”

আর, কোরান শরীফে ওজনের বিষয়ের উল্লেখ রয়েছে এই ভাবে:

“এবং কিয়ামত-দিবসে আমি স্থাপন করিব ন্যায় বিচারের মানদন্ড। সূতরাং, কাহারও প্রতি কোন অবিচার করা হইবে না এবং কর্ম যদি তিল পরিমাণ ওজনেরও হয়, তবু উহা আমি উপস্থিত করিব। হিসাব গ্রহণকারীনূপে আমিই যথেষ্ট।”

সূরা আল-আম্বিয়া ৪৭)

তফসীরকারেরা বলেছেন যে, অন্তরের অভিপ্রায় মাপবার জন্য একটি, আর বাইরের আমল মাপবার জন্য আর-একটি দাড়িপাল্লা থাকবার সম্ভবনা রয়েছে।

আল-ফখ্র্ আর-রাযী একটি প্রচলিত কাহিনী বলেছেন, যা হচ্ছে এই রকম:

হযরত দাউদ তাঁর প্রতিপালককে সেই দাড়িপাল্লা দেখাতে বললেন। দেখা মাত্র তিনি মূর্ছা গেলেন। জ্ঞান ফিরে এসে তিনি বললেন, হে আল্লাহ্, কে এমন আছে, যে নেক কাজ দিয়ে এই এত বড় পাল্লা ভরাট করতে পারবে? আল্লাহ্ বললেন, হে দাউদ, আমার দাসের উপর যদি আমি সন্তুষ্ট থাকি, তাহলে আমিই তা নেক আঞ্জাম (সুফল) দিয়ে ভরাট করব।

হুদাইফার উদ্ধৃতি দিয়ে বিলাল বিন ইয়াহ্ইয়া বলেছেন:

“জিব্রাইল আলাইহিস্ সালাম হাশরের দিন দাড়িপাল্লার দায়িত্বে থাকবেন। আল্লাহ্ বলবেন, ‘হে জিব্রাইল, ওদের মধ্যে ওজন করো আর মজলুমের পাওনা চুকিয়ে দাও। জালেমের যদি কোন নেক কাজ না থাকে, তাহলে তার পাল্লায় মজলুমের পাটুকু চাপিয়ে দাও। তবেই জালেম বুঝতে পারবে, তার পাপের বোঝা কেমন পর্বতের মতো ভারী।’”

আবু জা’ফর বর্ণনা দিয়েছেন যে, মুহম্মদ বললেন, “দাড়িপাল্লায় চরিত্রের সততা যত ভারী হবে অন্য কোন কিছুই তত নয়।”

সর্বশেষ, ইবনে ‘আব্বাসের উদ্ধৃতি দিয়ে মুহম্মদ বিন সা’দ যে কথা বলেছেন, সেটাকে সমস্ত মন্তব্যের সারসংক্ষেপ বলা যায়। আর তা হচ্ছে:

“যে ব্যক্তি নেক আমল দিয়ে তার বদ কাজকে ঘিরে রাখতে পেরেছে, তার পাল্লা ভারী হবে অর্থাৎ তার ভাল কাজ খারাপ কাজকে হটিয়ে দেবে। আর, যার খারাপ কাজ নেক আমলকে ঘিরে রেখেছে, নিশ্চয় তার পাল্লা হালকা হবে অর্থাৎ সে জাহান্নামের সন্তান। তার খারাপ কাজ ভাল কাজকে হটিয়ে দেবে।”

ধার্মিকতা পাপ মোচন করে

আল্লাহ্-পাক বলেছেন:

“হে বিশ্বাসীগণ!যদি তোমরা আল্লাহ্কে ভয় কর, তবে আল্লাহ্ তোমাদিগকে ন্যায়-অন্যায় পার্থক্য করিবার শক্তি দিবেন, তোমাদিগের পাপমোচন করিবেন এবং তোমাদিগকে ক্ষমা করিবেন এবং আল্লাহ্ অতিশয় মঙ্গলময়।”

সূরা আল-আনফাল ২৯

আমরা এখানে লক্ষ্য করছি যে, আল্লাহ্কে ভয় করলে অর্থাৎ ধার্মিক হলে তার পুরষ্কার হবে ত্রিবিধ:-

  1. আল্লাহ্ আপনাকে ন্যায় অন্যয়ের তারতম্য করবার ক্ষমতা দেবেন।

    ইসলামী শরীয়তবিদ্গণ এর অর্থ করেছেন যে, কোনটা আল্লাহ্‌র পথ আর কোনটা নয়, সেইটা নিরূপণের ক্ষমতা লাভ করা যাবে। অর্থাৎ আল্লাহ্ আপনাকে সৎ নেতৃত্ব ও জ্ঞান দেবেন, আনন্দের প্রশান্তে দিয়ে আপনার মন-প্রাণ ভরে তুলবেন এবং অন্তঃকরণ থেকে বিদ্বেষ ও ঘৃণার বিষ মুছে ফেলবেন।

  2. আপনি যত খারাপ কাজ করেছেন, তেমন সমস্ত খারাপ কাজই আল্লাহ্ ঢেকে রাখবেন।
  3. তিনি আপনাকে ক্ষমা করবেন।

যারা ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণার্ত

ধার্মিকতার কারণে,

তারাই

আশিস্ ভাজন।

তারা পরিতৃপ্ত হবে।

ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমা

কোরান শরীফের আয়াতসমূহ মনোযোগ দিয়ে অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে,“কাফফারা” (প্রায়শ্চিত্ত) ও “ক্ষমার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তফসীরকারেরা এই পার্থক্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন যে, কাফফারার মাধ্যমে পাপমোচন ইহজগৎ নিয়ে, আর ক্ষমার অর্থ হচ্ছে কেয়ামতের দিন পাপ মুছে যাওয়া।

আমল ও ক্ষমা

ইসলামের শিক্ষা-অনুযায়ী পাপের ক্ষমা নেক আমলের উপর নির্ভর করে। যেমন কোরান শরীফে রয়েছে:

“….যাহারা ভালর দ্বারা মন্দের মোকাবিলা করে, ইহাদিগের জন্যই শুভ পরিণাম-স্থায়ী জান্নাত। উহাতে তাহারা প্রবেশ করিবে এবং তাহাদিগের পিতা-মাতা, পতি-পত্নী ও সন্তান-সন্ততিদিগের মধ্যে যাহারা সৎকর্ম করিয়াছে, তাহারাও।”

সূরা রা’দ ২২-২৩

বর্ণনা করা হয়েছে যে, হযরত মুহম্মদ মু’আদ বিন জবলকে বললেন,

“তুমি যদি কোন অসৎকর্ম করে থাকো, তাহলে তার সঙ্গে একটা সৎকর্ম করো তাহলে তা মুছে যাবে।”

যারা সৎকর্ম করেছে, তাদের বর্ণনা দিতে গিয়ে আল-হাসানও বলেছেন,

“তারা নিজেরা যখন সাহায্য থেকে বঞ্চিত ছিলেন, তখন অন্যকে তাঁরা সে সাহায্য দিয়েছেন, আর তাঁদের প্রতি যখন অন্যায় করা হয়েছে, তখন তারা উৎফুল্ল থেকেছেন।”

যুজাজ বলেছেন,

“বংশগত মর্যাদার সঙ্গে যদি নেক আমল না থাকে, তাহলে সে মর্যাদা কোনই কাজে আসবে না।”

ইবনে ‘আব্বসের উদ্ধৃতি দিয়ে আল-ওয়াহিদি ও আল-বুখারী বলেছেন,

“অনুগত বান্দার পুরষ্কারের অংশ হিসাবে আল্লাহ্ তাকে বেহেশতে নিজের পরিজনবর্গকে সঙ্গে নিয়ে বসবাসের সুখভোগ করতে দেন।”

এর থেকে আভাস পাওয়া যায় যে, যাঁর নেক আমল আছে, তিনি অনুগত বান্দার সম্মান নিয়ে বেহেশতে প্রবেশ করবেন। যদি তিনি এই নেক আমলের কারণে বেহেশতে প্রবেশ করেন, তাহলে এতে অনুগত বান্দা হওয়ায় সম্মানের কিছু থাকছে না, কেননা যিনিই নেক আমল করেছেন, তিনিই তো বেহেস্তে যাবেন।

সিয়াম (রোযা) ও ক্ষমা

সূরা আল-আহ্যাব (গোত্রসমূহ)-এর ৩৪ আয়াতে আছে যে, সিয়াম-পালনকারী পুরুষ ও সিয়াম-পালনকারী নারীর জন্য আল্লাহ্ ক্ষমা ও মহা পুরষ্কারের ব্যবস্থা রেখেছেন।

কোরান শরীফে বলা হয়েছে যে, হত্যাজনিত পাপের ক্ষমা পাওয়া যাবে যদি অবিরাম দুইমাস-কাল রোযা রাখা যায়। এতে রয়েছে:

“কোন বিশ্বাসীকে হত্যা করা কোন বিশ্বাসীর জন্য সঙ্গত নহে, তবে ভুলবশতঃ করিলে উহা স্বতন্ত্র: এবং কেহ কোন বিশ্বাসীকে ভুলবশতঃ হত্যা করিলে এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা এবং তাহার (নিহতের) পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ করা বিধেয়, যদি না তাহারা (নিহতের পরিজনবর্গ) ক্ষমা করে। যদি সে (নিহত) তোমাদের শত্রু পক্ষের লোক হয় এবং বিশ্বাসী হয়, তবে এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা বিধেয়। আর যদি সে এমন এক সম্প্রদায়ভুক্ত হয়, যাহার সহিত তোমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ, তবে তাহার পরিজনবর্গকে রক্তপণ অর্পণ এবং এক বিশ্বাসী দাস মুক্ত করা বিধেয়, এবং যে সঙ্গতিহীন, সে একাধিক্রমে দুইমাস সিয়াম পালন করিবে। তওবার জন্য ইহা আল্লাহ্‌র ব্যবস্থা এবং আল্লাহ্ সর্বজ্ঞ প্রজ্ঞাময়।”

সূরা আন-নিসা-স্ত্রীলোকগণ: ৯২

আয়াতটি প্রদত্ত হবার কারণ সম্বন্ধে যে সব মত রয়েছে, তার কয়েকটি নিম্নরূপ:-

‘উরওয়া বিন আয-যুবাইর বলেছেন: ওহোদের যুদ্ধের দিন হুদাইফা ইবনে আল-ইয়ামান আল্লাহ্‌র রসূলের সঙ্গে ছিলেন। মুসলিমগণ আল-ইয়ামানের পিতাকে কাফের মনে করে তাঁকে ধরলেন এবং তাঁর উপর তরবারির আঘাত হানলেন যদিও হুদাইফা তখন বলেছিলেন, “তিনি আমার পিতা”। কিন্তু তাঁরা হয়তো তাঁর কথা বুঝতে পারেননি এবং ততক্ষণে হত্যার কাজ সাঙ্গ হয়েছে। তখন হুদাইফা বললেন, “আল্লাহ্ তোমাদের ক্ষমা করুন। তিনিই শ্রেষ্ঠ ক্ষমাশীল।” আল্লাহ্‌র রসূল যখন এ কথা শুনলেন, তাঁর দৃষ্টিতে হুদাইফার মর্যাদা অনেক বেড়ে গেল, আর তখন এই আয়াত দেওয়া হল।

আয়াতটির জন্য আরও একটা ঘটনার বিরণ রয়েছে। একদল যোদ্ধার সঙ্গে থাকবার কালে আবু আদ-দারদা কোন কারণে একটু দূরে গেলেন। কয়েকটি ভেড়া চড়ানো অবস্থায় একটা লোককে তিনি সেখানে দেখতে পেয়ে তার উপর তরবারি দিয়ে আক্রমণ করলেন। লোকটা বলল,-“লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ্” “আল্লাহ্ ব্যতীত আর কোন মাবুদ নাই।” কিন্তু আবু আদ-দারদা তাকে মেরে ফেললেন আর তার ভেড়া গুলো নিয়ে চলে গেলেন। পরে তার অনুশোচনা হল এবং তিনি নবীজীকে ঘটনাটা জানালেন। নবীজী প্রশ্ন করলেন, “লোকটা অন্তরে মোমেন ছিল কিনা, সে ব্যাপারে তুমি কি কিছু জানতে পেরেছ?” আবু আদ-দারদা তখন অনুতাপ করলেন এবং তারপর এই আয়াত শোনা গেল।

কোরান শরীফে আরও রয়েছে যে, মিথ্যা শপথ জনিত গুনাহের ক্ষমা পেতে হলে তিনদিন রোযা রাখতে হবে। কোরান শরীফে লিখিত হয়েছেঃ

“তোমাদের নিরর্থক (অনিচ্ছাকৃত) শপথের জন্য আল্লাহ্ তোমাদিগকে দায়ী করিবেন না, কিন্তু যে সব শপথ তোমরা ইচ্ছাকৃতভাবে কর, সেই সকলেন জন্য তিনি তোমাদিগকে দায়ী করিবেন। অতঃপর ইহার প্রায়শ্চিত্ত (“কাফ্ফারাহ”): দশজন দরিদ্রকে মধ্যম ধরনের খাদ্যদান, যাহা তোমরা তোমাদের পরিজনদিগকে খাইতে দাও অথবা তাহাদিগকে বস্ত্র দান, কিংবা একজন দাস মুক্তি এবং যাহার সামর্থ নাই, তাহার জন্য তিনদিন সিয়াম পালন। তোমরা শপথ করিলে ইহাই তোমাদের শপথের প্রায়াশ্চিত্ত। তোমরা তোমাদের শপথ রক্ষা করিও। এইভাবে আল্লাহ্ তোমাদের জন্য তাঁহার নিদর্শন (আয়াত) বিশদভাবে বর্ণনা করেন যেন তোমরা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন কর।”

সূরা মায়িদাহ্ ৮৯

আল-ফখ্র্ আর-রাযী বলেছেন যে, যে কারণে আয়াতটি দেওয়া হয়, তা হচ্ছে: হযরত মুহম্মদের বেশ কিছু অনুসারী আহার, পোশাক পরিহার করে ফকীরী গ্রহণ করেন, আর শপথ নিয়ে তাঁরা তা করেন। তিনি যখন তাঁদেরকে তা করতে নিষেধ করে দেন, তখন তারা বললেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল, কিন্তু আমরা যে শপথ নিয়েছি- এখন আমরা কী করব?” তখন এই আয়াত দেওয়া হয়।

হজ্ পালন ও ক্ষমা

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“সাফা ও মারওয়া [পর্বত] আল্লাহ্‌র নিদর্শনসমূহের (শা’আয়ির) অন্যতম। সুতরাং যে কেহ কাবাগৃহে হজ্ব কিংবা ওমরা সম্পন্ন করে, এই দুইটি প্রদক্ষিণ করিলেন তাহার কোন পাপ নাই, স্বতঃস্ফূর্তভাবে সৎকার্য করিলে, আল্লাহ্ পুরস্কার দাতা, সর্বজ্ঞ।”

সূরা বাকারা ১৫৮

ইবনে আব্বাস বলেছেন:

“সাফা পর্বতে একটি ও মারওয়া পর্বতে একটি মূর্তি ছিল। জাহেল অবিশ্বাসীরা এই দুই জায়গায় সূর্তি দুটিকে তাওয়াফ করত ও স্পর্শ করত। ইসলামের আগমনের পর মুসলিমগণ এই ক্রিয়াকান্ড ও মূর্তি দুটির উপস্থিতিকে ঘৃণা করতে আরম্ভ করেন। সূতরাং আয়াতটি আসে।”

“তাহার কোন পাপ নাই।” কথাটার অর্থ, তার কোন অপরাধ নেওয়া হবে না আর স্বেচ্ছায় হজ্ব পালনকারীদের নেক কাজ আল্লাহ্ কবুল করবেন।

দান-খয়রাত ও ক্ষমা

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“যাহারা….. সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয়, তাহাদের পুরষ্কার তাহাদের প্রতিপালকের নিকট আছে, এবং তাহাদের কোন ভয় নাই এবং তাহারা দুঃখিতও হইবে না।”

সুরা বাকারা ২৭৭

এর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে ইবনে ’আব্বাস বলেছেন:

“কেয়ামতের দিনের পরিস্থিতিতে যে ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে, তার জন্য তাদেরকে দুঃখ পেতে হবে না।”

আল-আস’আম ব্যাখ্যা দিয়েছেন:

“সেই মহা দিবসে তাদের কষ্টভোগের কোন ভয় থাকবে না, কিংবা তাদেরকে দুঃখও পেতে হবে না, কেননা ইহকালে অন্যেরা যেমন সুখভোগ করেছে, তারা তা করেনি; আর এই দুনিয়ায় যে রেষারেষি, প্রতিদ্বন্দ্বিতা ঐ দুনিয়ায় তার কোন অস্তিত্ব নেই।”

আল্লাহ্‌র পথে-উদ্যম ও ক্ষমা

কোরান শরীফে রয়েছে:

“যাহারা বিশ্বাস করে (ঈমান আনে) এবং যাহারা আল্লাহ্‌র পথে স্বদেশ ত্যাগ করে (হিজরত করে) ও জিহাদ করে (উদ্যমী হয়), তাহারাই আল্লাহের অনুগ্রহ প্রত্যাশা করে। আল্লাহ্ ক্ষমা পরায়ণ, পরম দয়ালু।”

সূরা বাকারা ২১৮

‘আবদ্-আল্লাহ্ বিন জাব্‌শ-এর বিবরণ অনুযায়ী:

তিনি হযরত মুহম্মদকে প্রশ্ন করলেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল, ধরুন, আমরা যে সব খারাপ কাজ করেছি, তার যদি কোন শাস্তি না থাকে, তাহলে আমাদের ভাল কাজের জন্য আমরা কি কোন পুরষ্কার আশা করতে পারি?” তখন আয়াতটি প্রদত্ত হয়, কেননা ’আবদ্-আল্লাহ্ হিজরত করেছিলেন এবং আল্লাহ্‌র পথে উদ্যমী হয়েছিলেন (জেহাদ করেছিলেন)।

কোরান তেলাওয়াত ও ক্ষমা

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

যখন কুরআন পাঠ করা হয়, তখন তোমরা মনোযোগের সহিত উহা শ্রবণ করিবে এবং নিশ্চুপ হইয়া থাকিবে, যাহাতে তোমাদিগের প্রতি দয়া করা হয়।”

সূরা আ’রাফ ২০৪

তফসীর কারেরা বলেছেন যে, এই আয়াতের আগেও আল্লাহ্-পাক তাঁর কিতাবকে জগতের জন্য রহমতস্বরূপ বলে অভিহিত করেছেন। হাদীস শরীফে রয়েছে যে,

আবু যার আল-গিফারী হযরত মুহম্মদকে বললেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল, কোরান শিখতে আমি ভয় পাই যদি তার শিক্ষা অনুযায়ী কাজ না করি।” হযরত মুহম্মদ বললেন, “হে আবু যার, ভয় পেয়ো না। যে অন্তঃকরনে কোরানের বসবাস, আল্লাহ্ সেই অন্তঃকরনকে উৎপীড়িত করেন না।”

আনাস ইবনে মালিকের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে:

“রসূল আমার সঙ্গে কথা বলেছিলেন-তিনি বললেন, ‘ যে কোরান শোনে, জগতের যন্ত্রণা তার ধারে-কাছেও আসে না, আর যে নিজে কোরান তেলাওয়াত করে, আখেরাতের যন্ত্রণা থেকেও সে মুক্ত।’”

ইবনে মাস’উদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে,

“হযরত মুহম্মদ তাঁকে বললেন, যে ব্যক্তি কোরান তেলাওয়াত করে, হেফয করে আর তা মনে রাখে, আল্লাহ্ তাকে বেহেস্তে নিয়ে আসবেন এবং অবধারিত দোযখযাত্রী দশজনের পক্ষে তাকে সুপারিশ করবার অনুমতি দেওয়া হবে।”

আল্লাহ্-ও-রসূলের-পক্ষে-সাক্ষ্য ও ক্ষমা

আবু হুরাইরা বর্ণনা দিয়েছেন যে, আবু যার আল-গিফারী হযরত মুহম্মদের কাছে জানতে চাইলেন, “হে আল্লাহ্‌র রসূল, একজন মসলিম কীভাবে নাজাত লাভ করবে?” হযরত মুহম্মদ বললেন, “সে নাজাত পাবে যদি সে বলে:“আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, তিনি এক, তাঁর কোন অংশীদার নেই এবং আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহম্মদ তাঁর দাস ও প্রেরিত।”

আল্লাহ্‌র-অভিপ্রায় ও ক্ষমা

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“আসমান (আস্মানসমূহ) ও জমিনে যাহা কিছু আছে সমস্ত আল্লাহেরই। তিনি যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং যাহাকে ইচ্ছা শাস্তি দান করেন।…..”

সুরা আলে-‘ইমরান ১২৯

ফখ্‌র্‌ আর-রাযী এই আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন:

“আমাদের সহকর্মীরা আয়াতটির উপর এই অভিমত ব্যক্ত করে থাকেন যে, আল্লাহ্ যেহেতু সবার উপরে, সব-কিছুর ঊর্ধ্বে, সেহেতু নিজের বিচার ক্ষমতা প্রয়োগ করে সকল অবিশ্বাসী আর অবাধ্য-অনুগতকে বেহেস্তে নিয়ে আসবার এবং সকল ঈমানদারকে জাহান্নামে নিক্ষেপের অধিকার তাঁর রয়েছে; তিনি যদি তা করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার কোন সুযোগ নেই।”

এই ধরনের অভিমতে আর-রাযী আপত্তি করেন নি। তিনি বরং তা জোর সমর্থনই করেছেন এই বলে:

“আয়াতটি থেকে এই অর্থই স্পষ্ট হয়। বুদ্ধির দৃষ্টিতেও এ অর্থ সমর্থন লাভ করে। কারণ মানুষের কাজ আল্লাহ্‌রই অভিপ্রায়ের উপর নির্ভর করে, আর অভিপ্রায়ও আল্লাহ্‌রই সৃষ্টি।আল্লাহ্ যদি এমন অভিপ্রায় সৃষ্টি করেন, মানুষ যার প্রতি বাধ্য থাকে, তাহলে এবং তিনি যদি অন্য এমন আর-এক প্রকারের অভিপ্রায় সৃষ্টি করেন, মানুষ যার প্রতি অবাধ্য, তাহলে মানুষের সেই বাধ্যতা আর সেই অবাধ্যতা আল্লাহ্‌র কাছে একই। আল্লাহ্‌র কোন কাজই তাঁর নিজের বাধ্যতামূলক নয়। তাই মানুষের বাধ্যতা পুরষ্কারদায়ক হবেই, কিংবা অবাধ্যতা শাস্তি ডেকে আনবেই, এমন কোন কথা নেই। সব-কিছু আল্লাহ্‌র দিক থেকে আসে এবং সর কিছু ঘটে আল্লাহ্‌রই অভিপ্রায়ে, শাসন আর ক্ষমতার বলে।”

কিন্তু কিতাবুল মোকাদ্দসে এই মতের সমর্থন মেলে না। গুনাহের কাফফারা হিসাবে কোরবানির কথা তাতে জোর দিয়ে বলা হয়েছে। এই কোরবানি বাধ্যতামূলক সেই কোন্ সূচনাকাল থেকে, কেননা আমরা দেখতে পাই, কোরবানির রক্ত টকটকে রক্তিম সূতার মতো হয়ে কিতাবুল মোকাদ্দসের আরম্ভ হইতে শেষ পর্যন্ত প্রবাহিত। এই কিতাবে আমরা তাই পড়ি:

“রক্তপাত না হইলে পাপের ক্ষমা হয় না।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইবরানী ৯:২২

বস্তুত, আল্লাহ্-পাকের অভিপ্রায় কখনও এমন হতে পারে না যে, তিনি অভ্রান্ত হওয়ায়, তিনি সত্য ন্যায়পরায়ণ হওয়ায় মানুষের পাপ ক্ষমা হয়ে যাবে। তাই বলা হয়েছে:

“যে প্রাণী পাপ করে, সেই মরিবে।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, হিজকিল ১৮: ৪,২০

আল্লাহ্ যদি পাপীকে ক্ষমা করে দেন, তাহলে তার পেছনে এমন যুক্তি থাকতে হবে, যেন তাতে ন্যায়বিচারের চাহিদা পূর্ণ হয় এবং তৌরাত, জবুর ও নবীদের অন্যান্য কিতাবে সে চাহিদার পূর্ণতার বিধান রয়েছে ছাগল, গাভী, মেষ প্রভৃতি পশু-কোরবানির মাধ্যমে। এ কোরবানি ঈসা-কালেমাতুল্লার আত্ম-কোরবানির প্রতীকরূপ বলে আল্লাহ্ তা কবুল করেছেন। এই কোরবানির মহিমান্বিত ইঞ্জিল শরীফে বাস্তব রূপ লাভ করেছে, যার দ্বারা আল্লাহ্‌র শাশ্বত ইনসাফের চাহিদা পূর্ণ হয়েছে, যা সকল ঈমানদারকে খাঁটি করেছে এবং যার দ্বারা পূর্ণ হয়েছে জবুর শরীফে লিপিবদ্ধ এই বাণী:

“সত্য ও দয়া (হক ও রহমত) পরস্পর মিলিল, দ্বীনদারী ও সালামতী পরস্পর চুম্বন করিল।”

জবুর শরীফ ৮৫:১০

ইসলামের দৃষ্টিতে ক্ষমাহীন পাপসমূহ

১। আল্লাহ্‌র শরীক করা ক্ষমাহীন:

কোরান শরীফে রয়েছে:

“আল্লাহ্‌র শরীক করার অপরাধ তিনি ক্ষমা করেন না, ইহা ব্যতীত সব কিছু যাহাকে ইচ্ছা ক্ষমা করেন এবং কেহ আল্লাহের শরীক করিলে সে ভীষণভাবে পথভ্রষ্ট হয়।”

সূরা আন-নিসা ১১৬

তফসীরকারেরা বলেছেন যে, বহু আল্লাহে বিশ্বাসী ব্যক্তি আল্লাহ্‌র রহমত থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত,কেননা বহু আল্লাহ্‌রবাদ মহা কুফ্‌র।

কেউ কেউ বলেন, যারা ফেরেশতাদের পূজা করত এবং তাঁদেরকে আল্লাহ্‌র কন্যা বলে মনে করত, তাদের কারণে আয়াতটি আসে।

রাযী বলেছেন, যারা আখেরাতের জীবনে বিশ্বাস করে না, তারা ফেরেশতাদেরকে স্ত্রী হিসাবে বিবেচনা করে।

অন্যান্য তফসীরকারের মতে,যারা মূর্তি পূজা করত এবং বিশ্বাস করত যে,প্রত্যেক মূর্তির ভিতর একটা করে দৈত্য রয়েছে, যারা তাদের সঙ্গে কথা বলে, তাদের কারণে এই আয়াত দেওয়া হয়।

২। মোমিনকে হত্যা ক্ষমাহীন

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“কেহ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন বিশ্বাসীকে (মোমিনকে) হত্যা করিলে তাহার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হইবে এবং আল্লাহ্ তাহার প্রতি রূষ্ট হইবেন, তাহাকে অভিসম্পাত করিবেন, এবং তাহার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।”

সূরা আন-নিসা ৯৩

আবু হুনাইফা বলেছেন, “ইচ্ছাকৃত হত্যার কোন ক্ষমা নাই।”

ইবনে ’আব্বাস বলেছেন, “যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, তার তওবা কবুল হয় না।”

৩। দ্বীন ত্যাগ-ক্ষমাহীন

কোরান শরীফে বলা হয়েছে:

“বিশ্বাস করার পর (ঈমান আনার পর) যাহারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং যাহাদের সত্য প্রত্যাখ্যানের প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পাইতে থাকে, তাহাদের তওবা কখনও কবুল করা হইবে না। ইহারাই তাহারা, যাহারা পথভ্রষ্ট।”

সূরা আলে-‘ইমরান ৯০

তফসীরকারেরা বলেছেন যে, দ্বীন ত্যাগকারী ব্যতিত তার ঈমানহীনতাকে বহুগুণে বৃদ্ধি করে। অন্য কথায়, সে যে কেবল ঈমানহীন থাকছে তাই নয়-ঈমানহীনতাকে সে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। অর্থাৎ সে তার অবিশ্বাসের সঙ্গে যোগ করছে অবাধ্যতা।

আল-ক্বাফফাল ও ইবনে আল আমবারী বলেছেন, “একবার তওবা করে যে ব্যক্তি ঈমান এনেছে, সে ঈমান ত্যাগ করলে তার সেই তওবা বাতিল হয়ে যায়-যেন কখনও সে তওবা করেনি।”

মসীহীয়াতে কাফফারা

“কাফফারা” শব্দের অর্থ ঢেকে দেওয়া বা লুকিয়ে ফেলা। মসীহীয়াতে এর বিশেষ অর্থ হচ্ছে ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র কাজ। তিনি তাঁর সঠিক আনুগত্য দিয়ে সলিবে কোরবানির মাধ্যমে শরীয়তের অভিশাপ থেকে মানুষকে নাজাত দিয়েছেন এবং আল্লাহ্-পাকের সঙ্গে পুনর্মিলিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে হযরত পিতর বলেছেন:

“মসীহ্ পাপের জন্য একবারই মরিয়াছিলেন। খোদার নিকট আমাদের লইয়া যাইবার জন্য, সেই নির্দোষ লোকটি পাপীদের জন্য অর্থাৎ আমাদের জন্য মরিয়াছিলেন।”

ইঞ্জিল শরীফ, ১ পিতর ৩: ১৮

ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ যে আল্লাহ্‌র চিরন্তন পুত্র, এই সত্যের ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত তাঁর কাফফারার মূল্য।

বিভিন্ন দৃষ্টি কোন থেকে ঈসা-মসীহের কাফফারার বিষয়টি অবলোকন করা যেতে পারে। প্রথম, আল্লাহ্‌র মহব্বত, ইনসাফ ও পবিত্রতার প্রসঙ্গে তাঁর সঙ্গে কাফফারার সম্পর্ক এবং দ্বিতীয়, মানুষের কাজ ও মানুষের জন্য কাজ প্রসঙ্গে মানুষের সঙ্গে কাফফারার সম্পর্ক।

বলা হয়ে থাকে যে, মসীহীয়াতে কাফফারা হচ্ছে মানুষের পাপের প্রায়শ্চিত্ত। শরীয়তের অভিশাপ থেকে পাপীকে নাজাত দেবার জন্য আর তার লাঞ্ছনা দূর করবার জন্য ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র কোরবানি যে ফলপ্রসূ ছিল, মসীহী কাফফারা হচ্ছে তারই ঘোষণা। আরও বলা হয়ে থাকে যে, ঈসা কালেমাতুল্লাহ্‌র কাফফারা ছিল আল্লাহ্‌র তুষ্টির জন্য, তাঁর ইনসাফের পূর্ণতার জন্য অর্থাৎ আল্লাহ্‌র সন্তোষ আর প্রসন্নতার উপায় হিসাবে তা কাজ করেছে। পাপীর জন্য সুপারিশ গ্রহণ করতে গিয়ে আল্লাহ্-পাক যাতে শান্ত হন, তাঁর ক্রোধের গজব যাতে প্রশমিত হয়, সেজন্য ঈসা-মসীহের কোরবানির আকারে এই কাফফারা হচ্ছে ফলপ্রসূ একটা বহিঃপ্রকাশ।

আরও বলা হয়েছে যে, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র রক্তের আকারে এই কাফফারা হচ্ছে পাপীর জন্য আবরণস্বরূপ। তার কাছ থেকে আর প্রায়শ্চিত্ত চাওয়ার থাকে না। পাপীর সব পাপ মসীহ্ নিজের উপর নিলেন, পাপীর জন্য তিনি নিজে কোরবানি হলেন। হযরত ইউহোন্না কথাটাকে তুলে ধরেছেন এইভাবে:

“আমরা যে খোদাকে মহব্বত করেয়াছিলাম তাহা নয়, কিন্তু তিনিই আমাদের মহব্বত করিয়া তাঁহার পুত্রকে (রূহানী-অর্থে) পাঠাইয়া দিয়াছিলেন, যেন পাপের দরুন আমাদের উপর খোদার যে দাবী-দাওয়া ছিল, পুত্র (রূহানী-অর্থে) তাঁহার নিজের মৃত্যু দ্বারা তাহা পূরণ করেন।”

ইঞ্জিল শরীফ, ১ ইউহোন্না ৪: ১০

আরও বলা হয়েছে, আল্লাহ্‌র শরীয়তের প্রতি কোনরূপ অশ্রদ্ধা প্রদর্শন ছাড়াই এই কাফফারা আল্লাহ্-পাক ও মানুষের মধ্যে সুপারিশের দরজা খুলে দিয়েছে। হযরত পৌল তাই বলেছেন:

“….খোদা মানুষের পাপ না ধরিয়া মসীহের মধ্য দিয়া নিজের সংগে মানুষকে মিলিত করিতেছিলেন। আর সেই মিলনের খবর জানাইবার ভার তিনি আমাদের উপর দিয়াছেন।”

ইঞ্জিল শরীফ, ২ করিন্থীয় ৫: ১৯

আল্লাহ্-পাকের প্রকৃতি এবং তাঁর সৃষ্ট পাপী জীব সমূহের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ককে নিয়ে মানুষ অনেক অনেক দর্শন সৃষ্টি করেছে কিন্তু এ ব্যাপারে কখনও গোটা একটা সন্তোষজনক সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে দুনিয়ার দর্শনসমূহ যা ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ হয়েছে, কিতাবুল মোকাদ্দসে তা প্রাঞ্জল করে দেওয়া হয়েছে। ইঞ্জিল শরীফে বলা হয়েছে যে, আল্লাহ্ সঠিক ইনসাফই করেন এবং তার ইনসাফ হচ্ছে যে, পাপীকে শাস্তি পেতে হবে। কাজেই কাফফারা ছাড়া কোন সুপাবিশ চলতে পারে না। পাপ ঢাকবার জন্য কোরবারি যে ব্যবস্থা, তার সূচনা এই সত্য থেকেই। প্রথম মানব-মানবী আদম-হাওয়ার সময়ই ফেরদৌসে তা শুরু হয় আল্লাহ্ পাক যখন তাঁদের লজ্জা ঢাকবার জন্য চামড়ার আচ্ছদন তৈরি করে দেন, আর সেজন্যও পশু-কোরবানির প্রয়োজন হয়, যাতে কোরবানি হয়ে যাওয়া পশুর চামড়া সংগ্রহ করে সেই লজ্জা ঢেকে দেওয়া যায়।

কিতাবুল মোকাদ্দস থেকে আমরা জানতে পারি যে, হাবিলের দেওয়া যে কোরবানি আল্লাহ্-পাক কবুল করেন, তা ছিল প্রত্যাসন্ন খোদাবন্দের ছায়া কিন্তু সেই কোরবানি ছিল আশ্চর্যজনক প্রকাশ ও অনুপ্রেরণা (তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ৪: ৪)।

ঠিক একইভাবে ইব্রাহিমের পুত্র ইস্হাক্কে কোরবানগাহ থেকে মুক্ত করবার উদ্দেশ্যে তাঁর কাছে আল্লাহ্-পাক যে মেষ পাঠিয়ে দেন, সেও ছিল মসীহের কোরবানির মাধ্যমে এক ধরনের কাফফারা, যার পরিকল্পনা আল্লাহ্-পাক শুরু থেকেই করে রেখেছিলেন। (তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ২২: ১-১৪)।

তৌরাত শরীফের বিবরণ অনুযায়ী, মিসরে বনী-ইস্রাইলকে যে মেষ শাবক কোরবানির আদেশ আল্লাহ্-পাক দিয়েছিলেন (হিজরত-খন্ড ১২: ১-৪২, তা-ও ইঞ্জিল শরীফে বর্ণিত আল্লাহ্‌র মেষ-শাবককে (অর্থাৎ ঈসা কালেমাতুল্লাহ্কে) কোরবানি দেওয়ারই বিশিষ্ট একটা ধরন, হযরত পৌল যা এইভাবে উল্লেখ করেছেন:

“মেষ-শিশু মসীহ্কে কোরবানি দেওয়া হইয়াছে। সেইজন্য পুরাতন খামির অর্থাৎ হিংসা ও খারাপী দিয়া নয় বরং আস, আমরা খামিরহীন রুটি অর্থাৎ সরলতা ও সত্য দিয়া এই ঈদ পালন করি।”

ইঞ্জিল শরীফ, ১ করিন্থীয় ৫: ৭-৮

ইঞ্জিল শরীফে কোরবানির মাধ্যমে কাফফারাকে দেখানো হয়েছে পাপমোচনের উপায় হিসাবে, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ যা চরিতার্থ করেন সলিবের উপর, যেন পাপী মানুষের জায়গায় আল্লাহ্‌র শরীয়তের চাহিদা আর মানুষের নাজাতের চাহিদা পূর্ণ হয়ে যায়। তাঁর কষ্টভোগের মধ্যে এবং পরিপূরক (বদলি) মৃত্যুর মধ্যে কাফফারার অর্থ নিহিত, যেন মানুষের পাপের জন্য তার প্রাপ্য শাস্তিটা সম্পূর্ণ হয়। আল্লাহ্-পাকের ইনসাফের চাহিদা এতে যেমন পূর্ণতা লাভ করে, তেমনি যে পাপী ঈমান এনেছে আর তওবা করেছে, এর দ্বারা তার তওবাও কবুল হয়ে যায়।

কিতাবুল মোকাদ্দসের ভাষায় ঈসা-মসীহের পাপ ক্ষয়ের জন্য দেওয়া কোরবানিকে “রহমত” বলে প্রকাশ করা হয়েছে। কারণ, আসমানী পিতা পাপী মানুষের জন্য কোরবানির ব্যবস্থা করতে বাধ্য ছিলেন না কিংবা পুত্রও বাধ্য ছিলেন না নিজে কোরবানি হবার জন্য মানুষের আকৃতি ধারণ করতে। কিন্তু আল্লাহ্-পাক তাঁর মহান ভালবাসার কারণে অনন্ত রহমতে সমৃদ্ধ, তাই পাপী মানুষের জায়গায় মানবরূপে আবির্ভূত আল্লাহ্‌র কালাম (অর্থাৎ ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্) স্বেচ্ছায় বদলি (পরিপূরক) কষ্টভোগ কবুল করায় আল্লাহ্-পাক শরীয়তের শাস্তির অবসান ঘটান।

এই সত্যকেই কোরবানি- দানকারী ঈসা-রূহুল্লাহ্ প্রতিষ্ঠিত করেন যখন তিনি বলেন:

“আমি আমার ভেড়াগুলির জন্য প্রাণ দিব।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১০: ১৫)

এই উক্তির সঙ্গে আমরা তুলনা করতে পারি ইউহোন্নার (১৫: ১৩) এই উক্তির যে, “কেহ যদি তাহার বন্ধুদের জন্য নিজের প্রাণ দেয়, তবে তাহার চেয়ে বেশি মহব্বত আর কাহারও নাই।” এবং বুঝতে পারি, কী উদ্দেশ্যে আল্লাহ্-পাক নিজেকে খালি করতে, রক্তমাংসের মানুষ হতে, কষ্টভোগ করতে আর সলিবের উপর নিজের দেহে আমাদের পাপ বহন করতে প্রস্তুত হয়েছিলেন।

এই যে বদলি-কষ্টভোগ, এর প্রয়োজনের কথা হযরত পৌল রোমীয়দের কাছে লেখা চিঠিতে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন:

“…শরীয়ত যাহা করিতে পারে নাই, খোদা নিজে তাহা করিয়াছেন। তিনি পাপ দূর করিবার জন্য নিজের পুত্রকে (রূহানী অর্থে) একজন মানুষ করিয়া পাপী মানুষের চেহারায় পাঠাইয়া দিলেন, আর তাহা করিয়া মানুষের স্বভাবের মধ্যে যে পাপ আছে, সেই পাপের বিচার করিয়া তাহার শক্তিকে বাতিল করিয়া দিলেন। তিনি তাহা করিলেন যেন পাপ-স্বভাবের অধীন না চলিয়া পাক-রূহের অধীন চলিবার দরুন আমাদের মধ্যে শরীয়তের দাবী-দাওয়া পূর্ণ হয়।”

ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ৮:৩-৪

এর অর্থ পাপের যে মজুরী তা হচ্ছে চিরন্তন মৃত্যু, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ সেই মৃত্যু নিজের উপর গ্রহণ করেন এবং ইশায়া-নবীর এই ভবিষ্যদ্বাণী পূর্ণতা লাভ করে:

“…আমাদের শান্তিজনক শাস্তি তাঁহার উপর বর্তিল এবং তাঁহার ক্ষত সকল দ্বারা আমাদের আরোগ্য হইল।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৫৩:৫

কাফফারার মাধ্যমে ক্ষমার নিশ্চয়তা পাওয়া যায় এবং আল্লাহ্‌তে বিশ্বাসী মানুষের নাজাতের জন্য তা আশীর্বাদ বয়ে আনে, আর তা হয়ে থাকে দ্বিবিধ কারণে:-

প্রথমতঃ,ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র বাধ্যতা ও কষ্টভোগের ভিত্তিতে আল্লাহ্-পাক ঈমানদারদের গুনাহ্ মাফ করে দেওয়ার ওয়াদা করেছিলেন। হযরত পৌল বলেছেন:

“তাহা হইলে একটা পাপের মধ্য দিয়া যেমন সমস্ত মানুষকেই আযাব পাইবার যোগ্য বলিয়া ধরা হইয়াছে, তেমনই একটা ন্যায্য কাজের মধ্য দিয়া সমস্ত মানুষকেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করিবার ব্যবস্থাও করা হইয়াছে এবং তাহার ফল হইল অনন্ত জীবন। যেমন একজন মানুষের (আদমের) অবাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেকেই পাপী হইয়াছিল, তেমনই একজন মানুষের (ঈসা-মসীহের) বাধ্যতার মধ্য দিয়া অনেককেই নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করা হইবে।”

রোমীয় ৫:১৮-১৯

দ্বিতীয়তঃ, কাফফারার এই নীতি আল্লাহ্-পাকের ইনসাফের চাহিদা পূর্ণ করেছে, কেননা পিতা ও পুত্রের মধ্যকার চিরন্তরন চুক্তির ভিত্তির উপর এই ইনসাফ প্রতিষ্ঠিত। এই সত্য সম্পর্কে কারও মনে যদি কোন সন্দেহ থাকে, তাহলে সে সন্দেহ দূর করবার জন্য আসমানী কালাম আমাদের কাছে রয়েছে, যাতে বলা হয়েছে:

“মসীহ্ এই দুনিয়াতে আসিবার সময় খোদাকে বলিয়াছিলেন, ‘পশু কোরবানী ও অন্যান্য কোরবানী তুমি চাও নাই কিন্তু আমার জন্য একটা দেহ তুমি তৈরি করিয়াছ। বেদীর (কোরবানগাহের) উপর পশু-পোড়ান কোরবানিতে এবং পাপের জন্য কোরবানিতে তুমি সন্তুষ্ট হও নাই। পরে আমি বলিলাম, পাক-কিতাবে আমার বিষয়ে যেমন লেখা আছে, হে খোদা, দেখ, আমি সেইভাবেই তোমার ইচ্ছা পালন করিতে আসিয়াছি।’”

জবুর শরীফ ৪০: ৬-৭ ও ইবরানী ১০:৫-৭

সুতরাং, ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ পাপীর বিকল্প (বদলি) হবার জন্য আর মৃত্যুর শাস্তি ভোগ করবার জন্য মানুষের রূপ গ্রহণ করলেন। চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ায় লঙ্ঘনকারী পাপী মানুষের যা প্রাপ্য ছিল, তিনি তা নিজের উপর নিলেন।

হযরত পৌল এই বিষয় ব্যাখ্যা করে বলেছেন:

“কিন্তু খোদা যে আমাদের মহব্বত করেন, তাহার প্রমাণ এই যে, আমরা পাপী থাকিতেই মসীহ্ আমাদের জন্য প্রাণ দিয়েছিলেন। তাহা হইলে মসীহের রক্ত-দ্বারা যখন আমাদের নির্দোষ বলিয়া গ্রহণ করা হইয়াছে, তখন আমরা মসীহের মধ্য দিয়াই খোদার গজব হইতে নিশ্চয় রেহাই পাইব।”

রোমীয় ৫: ৮-৯

কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়ের প্রয়োজনের পক্ষে যুক্তিসমূহ

১। নাজাতের চাহিদা

পাপক্ষয় বা দায়মোচন কেবল যৌথ চাহিদা নয় বরং তা প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যকিতগত চাহিদাও বটে। প্রত্যেক মানুষের দন্ডিত হওয়া ও ধ্বংস হওয়া অবধারিত। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ একবার প্রশ্ন করেছিলেন:

“যদি কেহ সমস্ত দুনিয়া লাভ করিয়া তাহার সত্যিকারের জীবন হারায়, তবে তাহার কী লাভ? সত্যিকারের জীবন ফিরিয়া পাইবার জন্য তাহার দিবার মত কী আছে?”

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ১৬: ২৬

মানুষের কাছে এমন কিছুই নাই, যা দিয়ে সে তার নিজের বা তার কোন ভাইয়ের পাপ ক্ষয় করতে পারে, আত্মকে শান্তি দিতে পারে। আল্লাহ্ পাক দাউদ-নবীর মাধ্যমে বলেছেন:

“তাহাদের মধ্যে কেহই কোন মতে ভ্রাতাকে মুক্ত করিতে পারে না কিংবা তাহার কাফফারার জন্য আল্লাহ্কে কিছু দিতে পারে না।”

জবুর শরীফ ৪৯: ৭

অন্যদিকে তওবা বা অনুতাপের ব্যাপারে বলা যায়, মানুষের মনে স্বাভাবিক একটা স্বজ্ঞাত সচেতনতা থাকে যে, তওবা দিয়ে কখনও অতীতের পাপ মুছে ফেলা যায় না। তাহলে মাফ পাবার নিশ্চয় অন্য কোন পথ আছে, আর তা হচ্ছে কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়। অন্যথায়, স্মরণাতীত কাল থেকে যে কোরবানির প্রথা চলে আসছে আর বিশ্বের অধিকাংশ ধর্মের মধ্যে যে সেই প্রথার প্রচলন লক্ষ্য করা যায়, তার ব্যাখ্যা কী হবে? তার অর্থ এই নয় কি যে, পাপী মনে প্রাণে কাফফারার প্রয়োজন অনুভব করে থাকে? সত্য হচ্ছে যে, আমাদের নৈতিক স্বভাব পবিত্রতার দাবিকে সম্মান করতে শেখায়- এমন কি আমরা নিজেদের আচরণের মাধ্যমে তার বিরোধিতা করলেও আমরা সবাই অনুভব করি যে, পূর্বের পাপের ফলভোগ থেকে নাজাতলাভের উপায় নিয়ে আমাদের মধ্যে দুশ্চিন্তা রয়েছে। কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়ের যে ইনসাফ, একমাত্র তার দ্বারাই সে নাজাত সম্ভবপর হতে পারে।

২। মানুষের অধঃপতন: আল্লাহ্‌র পবিত্রতা

আল্লাহ্ পবিত্র, মানুষ পাপী। মানুষের পাপাচারের অবস্থান আল্লাহ্‌র পবিত্রতার ঠিক বিপরীতে। সুতরাং মানুষ ধিক্কৃত, আর এই ধিক্কার তুলে না নেওয়া পর্যন্ত তার মাফ নেই। তওবার মাধ্যমে যদি নতুন করে নিষ্পাপ জীবন লাভ সম্ভবও হয়, তবু তার সেই নিষ্পাপিতা অতীতের পাপ মুছে ফেলবে কেমন করে। আর আল্লাহ্-পাক যদি কাফফারা ছাড়াই মাফ করে দেন, তাহলে তো আল্লাহ্‌র শরীয়তের প্রতি কিংবা তাঁর পবিত্রতার প্রতি পাপীর কোন শ্রদ্ধা থাকবে না। সেইজন্যই এসেছে কাফফারার বিধান যেন পাপের লাঞ্ছনা দূর করা যায় এবং আল্লাহ-পাকের চূড়ান্ত নিস্কলঙ্ক মহিমা উদ্ভাসিত হয়।

৩। কাফফারা মানুষের নৈতিক চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ

মানুষের একটা নৈতিক স্বভাব রয়েছে। বিবেক তাকে ন্যায় আর পবিত্রতার শ্রেষ্ঠত্ব শিক্ষা দেয়। সে যদি পাপের দায়ে দোষী হয় আর কাফফারার মাধ্যমে পাপক্ষয়ের কিছুই তার জানা না থাকে, তাহলে তার বিবেক অশান্ত থাকবে, সে মর্মপীড়া অনুভব করবে। অথচ কাফফারার মাধ্যমে ক্ষমা পেয়ে তার বিবেক তৃপ্তি বোধ করবে আর তার নৈতিক চাহিদাও পাবে পূর্ণতা।

৪। কাফফারা শরীয়তের চাহিদা পূর্ণ করে

শরীয়তের বিধান পাপীর শাস্তি দাবি করে। কোন আইনে শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে সে আইন প্রয়োগ যোগ্য নয়। স্বতঃসিদ্ধ যে, সম্মানজনক আইন অবশ্যই অপরাধীর শাস্তি বিধান করবে। কেবল অথর্ব, ভেঙ্গে-পড়া কোন আইনেই কাফফারা ছাড়া অপরাধীকে ক্ষমা করবার বিধান থাকতে পারে। আর তা হবে ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্‌র এই কথার বিরোধিতা যে:

“আমি তোমাদের সত্যই বলিতেছি, আসমান ও জমিন শেষ না হওয়া পর্যন্ত, যতদিন না শরীয়তের সমস্ত কথা সফল হয়, ততদিন সেই শরীয়তের এক বিন্দু কি একমাত্রা মুছিয়া যাইবে না।”

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ৫:১৮

অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কাফফারা ছাড়া ক্ষমার কথা বলবার অর্থ হবে এমন কথা বলা যে, পাপীর শাস্তির কোন প্রয়োজন নেই, এবং তা হবে আল্লাহ্‌র ইনসাফ আর পবিত্রতার অবমাননা।

৫। আল্লাহ্‌র পাক-কালামে কাফফারার বিধান

কাফফারার যদি কোন প্রয়োজনই না থাকত, তাহলে আল্লাহ্-পাক তাঁর পাক কালামে তা অন্তর্ভূক্ত করতেন না। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ বলেছেন:

“মূসা যেমন মরু-এলাকায় সেই সাপকে উঁচুতে তুুলিয়াছিলেন, তেমনই মনুষ্য পুত্রকেও উঁচুতে তুলিতে হইবে, যেন যে কেহ তাঁহার উপর ঈমান আনে, সে অনন্ত জীবন পায়”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ৩:১৪-১৫

৬। নৈতিক বিধানের চাহিদা

আল্লাহ্-পাক নৈতিক বিচারক হওয়ায় তিনি নিশ্চয় বিচারের নিজস্ব বিধান পালন করবেন। যে নৈতিকতার জগতের ইপর তাঁর আধিপত্য, সেখানে অবাধ্যতা আর বিশৃঙ্খলার কোন অনুমতি থাকতে পারে না। তাঁর নির্দেশমালা ভঙ্গ করা হলে তিনি সেটাকে হালকাভাবে দেখতে পারেন না, বরং ভঙ্গকারীকে তিনি অবশ্যই জবাবদিহি করতে বলবেন এবং শাস্তি দেবেন। বস্তুতঃ, কাফফারার ব্যবস্থা করে তিনি পাপের প্রতি নিজের ঘৃণা আর কদাচারের প্রতি নিজের ক্রোধ ব্যক্ত করেছেন। অন্যদিকে তাঁর শরীয়ত মান্য করলে পাপীর জন্য তিনি আপোষের দরজা খুলে দিয়েছেন।

৭। বহু ধর্মে কাফফারার অস্তিত্ব রয়েছে

বহু ধর্মে কাফফারার যে ব্যবস্থা রয়েছে, তার থেকে বোঝা যায় যে, সমগ্র মানুষের বিবেক কাফফারা দিতে চায় এবং সে বিবেক পাপের জন্য কেবল তওবায় সন্তুষ্ট নয়। মানুষ পাপমোচন চায়, আর তা সম্ভব পাপীর রক্ত-ঝরানো কোরবানির মাধ্যমে।

এই সমস্ত যুক্তিই কাফফারার চাহিদা প্রমাণ করে।

নেক কাজ ক্ষমা

১। সৎকর্ম করা নৈতিক দায়িত্ব এবং অবশ্যই তা করতে হবে। কিন্তু সৎকর্ম করা হয়েছে বলে তা অতীতেরা অসৎকর্মের ক্ষতিপূরণ হতে পারে না, কখনও অতীত পাপের ক্ষমার উপায় বলে বিবেচিত হতে পারে না। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ এই সত্যই ব্যক্ত করেছেন পর তোমরা বলিও,

‘আমরা অপদার্থ গোলাম। যাহা করা উচিৎ আমরা কেবল তাহাই করিয়াছি।’”

ইঞ্জিল শরীফ, লূক ১৭: ১০

আর হযরত পৌল বলেছেন:

খোদার রহমতে ঈমান আনিবার মধ্য দিয়া তোমরা পাপ হইতে উদ্ধার পাইয়াছ। ইহা তোমাদের নিজেদের দ্বারা হয় নাই, ইহা খোদারই দান। ইহা কাজের ফল হিসাবে দেওয়া হয় নাই, যেন কেহ গর্ব করিতে না পারে।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইফিষীয় ২: ৮-৯

২। আমাদের যে সম্পত্তি আছে আর আমরা যে দেহ-মন স্বাস্থ্যের অধিকারী, তার সবই আল্লাহ্-পাকের কাছ থেকে পাওয়া-আমাদের উপর তা অর্পিত মাত্র। আমাদের সেই সম্পত্তি থেকে যে উদারভাবে দান করি কিংবা সেই দেহ-মন স্বাস্থ্য খাটিয়ে যে মানুষের সেবা করি, সে তো আমাদের নিজস্ব কোন কোরবানি নয়, কিংবা এমন কিছু তো নয়, যার জন্য আমরা পুরষ্কার দাবি করতে পারি।

দাউদ নবী এ সম্পর্কে বলেছেন যখন তিনি এবাদতগাহ্ নির্মাণের জন্য বহু অর্থ ব্যয় করন। তাঁর ভাষায়:

“কিন্তু আমি কে, আমার প্রজারাই বা কে যে, আমরা এই প্রকারে ইচ্ছাপূর্বক দান করিতে সক্ষম হই? সমস্তই তো তোমা হইতে আসে এবং তোমার হস্ত হইতে যাহা পাইয়াছি, তাহাই তোমাকে দিলাম।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ১ খান্দাননামা ২৯: ১৪

৩। আমরা যে আল্লাহ্-পাকের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁর অবাধ্যতা করেছি, তাঁকে অপদস্ত করেছি, এমন কোন নেক কাজ নেই, যা দিয়ে সেই অপরাধ আমরা মোচন করতে পারি। তাঁর পবিত্রতা মহত্ব ও সত্যবাদীতা সীমাহীন। কিন্তু কেবল নেক কাজ আমাদের জন্য ক্ষমার ব্যবস্থা করে দিতে পারে না।

৪। আল্লাহ্‌র দরবারে হাজিরা দেবার জন্য আমাদের মধ্যে থাকতে হবে পবিত্রতা। সম্পূর্ণ পাক-সাফ না হলে কেউ কখনও আল্লাহ্কে দেখতে পারে না। কেবল সৎকর্মের দ্বারা আমরা পাক-সাফ হয়ে উঠতে পারি না। পবিত্রতা আরোপিত হয়েছে একমাত্র সেই ঈমানদারের উপর, যাঁর জন্ম আল্লাহ্‌র রূহ থেকে। ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্ তাই বলেছেন:

“…পানি এবং পাক-রূহ হইতে জন্ম না হইলে কেহই খোদার রাজ্যে ঢুকিতে পারে না। মানুষ হইতে যাহা জন্মে, তাহা মানুষ, আর যাহা পাক-রূহ হইতে জন্মে, তাহা রূহ।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ৩: ৫-৬

এবাদত ও ক্ষমা

সন্দেহ নেই যে, আল্লাহ্-পাকের সঙ্গে কথা বলা আর তাঁর সত্তাকে নিয়ে ধ্যানের আকারে যে এবাদত, সেই এবাদতের মাধ্যমে আল্লাহ্‌র সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপিত হয়। কিন্তু পাপের জন্য পাপী যেহেতু আল্লাহ্‌র কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন, তাই তার এবাদত কবুল হতে পারে না। সে আল্লাহ্‌র কাছ থেকে কোন সাড়া পাবে না। ইশায়া-নবীর মাধ্যমে আল্লাহ্-পাক অন্ততঃ তাহাই এরশাদ করেছেন:

“তোমাদের অপরাধ তোমাদের ও তোমাদের আল্লাহ্‌র মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটাইয়াছে; তোমাদের পাপ তাঁহার মুখচ্ছবিকে ঢাকিয়া রাখিয়াছে, তাই তিনি তোমাদের কথা শুনেন না। বস্তুতঃ, তোমাদের করতল রক্তে ও তোমাদের অঙ্গুলি অপরাধে অপবিত্র হইয়াছে; তোমাদের ওষ্ঠ মিথ্যা কথা বলিয়াছে, তোমাদের জিহ্বা শয়তানীপূর্ণ কথা উচ্চারণ করে।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৫৯: ২-৩

দাউদ-নবীও এই সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। সত্য নবীর মাধ্যমে রূহের উক্তি:

“আমি যদি নিজ অন্তঃকরণে অপরাধ পোষণ করিতাম, তবে আল্লাহ্-পাক আমার কথা শুনিতেন না।”

জবুর শরীফ ৬৬: ১৮

রোযা ও ক্ষমা

রোযা রাখাও এবাদতের একটা অংশ। রোযা রাখার অর্থ আল্লাহ্-পাকের হুজুরে মানুষের হেয়তা ও অসহায়তা প্রকাশ করা। কিন্তু পাপের কারণে অধঃপতিত হবার আগে সে যে পবিত্র দশায় ছিল, কেবল রোযা রাখবার কারণে সেই দশায় ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। অন্যান্য এবাদতের মতো রোযাও আল্লাহ্‌র পবিত্রতার কাছে পাপের অপরাধ মুছে ফেলবার মতো কোন ক্ষতিপূরণ নয়। সুতরাং তা কখনও ক্ষমার উপায় বলে বিবেচিত হতে পারে না। জাকারিয়া-নবীর মাধ্যমে আল্লাহ্-পাক বলেছেন:

“….. যখন তুমি রোযা রাখিয়াছ ও কান্নাকাটি করিয়াছ, তখন তাহা কি আমার, আমার উদ্দেশ্যে করিয়াছ? আর যখন ভোজন কর ও পান কর, তখন কি নিজেরই জন্য ভোজন ও নিজেরই জন্য পান কর না?”

জাকারিয়া ৭: ৫-৬

উসংহার

  1. ১। মানুষের নাজাত কাফফারার ভিত্তিতে সম্ভব। এ কেবল দার্শনিক কোন তত্ত্ব নয়, বরং এমন প্রকৃত ঘটনা যে,অধঃপতিত মানুষের উপর থেকে পাপের বোঝা নামিয়ে ফেলবার জন্য এর অপরিহার্য প্রয়োজন রয়েছে।
  2. ২। আমরা সবাই স্বীকার করি যে, হযরত আদম পাপ করে পতিত হন এবং তাঁর এই পতন গোটা মানবজাতিকে জড়িয়ে ফেলে, কেননা আল্লাহ্‌র বিবেচনায় আদম ছিলেন মানুষের প্রতিনিধি। এই যুক্তিতে আল্লাহ্-পাক নিজের সুরতে সৃষ্ট মানুষকে মহব্বত বশতঃ পাপের শাস্তির হাত থেকে রক্ষার জন্য একটি বিকল্প বের করেন।

    এই বিকল্পকে অবশ্যই আল্লাহ্-পাকের ক্ষমতা আর মহব্বতের প্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হতে হবে যেন মানুষ নাজাত লাভ করতে পারে। আল্লাহ্-পাকের সেই মহব্বতের প্রকাশ অবশ্যই ঘটবে খোদা আল্লাহ্‌রই পক্ষ থেকে। সুতরাং মানবজাতির প্রতি সেই মহব্বতের নিদর্শনস্বরূপ। তিনি ইচ্ছা করলেন যে, ঈসা-রুহুল্লাহ্ রক্ত মাংসের মানুষ হয়ে মানুষের সঙ্গে যুক্ত হবেন এবং মানুষের এমন একটা খাঁটি বিকল্প হবেন, যে বিকল্পকে আমাদের একজন রসূল “দ্বিতীয় আদম” নামে অভিহিত করেছেন। এইভাবে প্রথম আদম মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন পতনের মধ্য দিয়ে, আর দ্বিতীয় আদম ছিলেন কাফফারার মধ্য দিয়ে পাপ-মোচনের জন্য মানুষের বিকল্প।

  3. ৩। এই প্রতিনিধির জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়ে দুনিয়ার বুক থেকে পাপ মুছে ফেলবার উদ্দেশ্যে পূর্ণ মূল্য-পরিশোধের। সলিবের উপর অকাতরে মৃত্যুবরণ করে ঈসা-রূহুল্লাহ্ সেই মূল্য পরিশোধ করেন এবং আমাদের সমস্ত পাপ তিনি নিজের দেহে নিয়ে নেন। এই ভাবে পুরনো কোরবানির রক্তের নযরানা থেকে সলিবের উপর এই নতুন কোরবানির চাহিদা সম্পর্কে আমরা বিশ্বাসী হয়ে উঠি, এবং এরই জন্য ঈসা-রূহুল্লাহ্কে বলা হয় “আল্লাহ্ মেষ”।
  4. তাঁর কোরবানির অনেক বৈশিষ্ট্যের এক বৈশিষ্ট হচ্ছে, এই কোরবানি কেবল যে, মানুষের পাপ মুছে ফেলে, তাই নয়-বরং মানুষের নৈতিক ব্যাধিও নিরাময় করে তোলে। সলিববিদ্ধ ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্কে যে ব্যক্তিই গ্রহণ করে, তারই জীবন তাজা হয়ে উঠে। তার মনের মধ্যে পাপের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। সলিব তার জ্ঞান চক্ষুকে এমনভাবে খুরে দেয় যে, পাপের ভয়াবহ চেহারা আর তার ভয়ঙ্কর শাস্তি সে স্পষ্ট দেখতে পায়।

    ঠিক এই পর্যায়ে হযরত ইউহোন্নার বাণী আমরা শুনতে পাই:

    “খোদা যেমন নূরে আছেন, আমরা যদি তেমনি নূরে চলি, তবে আমাদের মধ্যে যোগাযোগ-সম্বদ্ধ থাকে এবং তাঁহার পুত্র ঈসার রক্ত সমস্ত পাপ হইতে আমাদের পাক-পবিত্র করে।”

    ১ ইউহোন্না ১: ৭

    আল্লাহ্ পাক

    যে আমাদের মহব্বত করেন

    তাহার প্রমাণ এই যে

    আমরা পাপী থাকিতেই

    ঈসা-কালেমাতুল্লাহ্

    আমাদের জন্য প্রাণ দিয়াছিলেন।

আল্লাহ্ আমার জন্য ব্যবস্থা করেছেন অনন্ত জীবন

লেখক: হামরান আম্‌ব্রী

অনুবাদ: মসীহী জামাত

প্রকাশক: মসীহী জামাত

প্রকাশকাল: জানুয়ারী ১৯৯২

খোদা ব্যক্তিগত ভাবে আমার কাছে কথা বলেন

অতীতে কিছুকাল ধরে আমি ছিলাম একজন সক্রিয় মুসলমান, মুহম্মদিয়া আন্দোলনের একজন সংগঠক এবং ইসলাম ধর্মের একজন প্রচারক। ১৯৪৭ সনে আমি আমুনতায়ী-তে কালিমান্টান্ মুসলিম কংগ্রেস এর সভাপতি মনোনিত হই কে, এইচ্ ইদ্হাম খালিদের সঙ্গে। দ্বিতীয় লেফ্টেন্যান্টের মর্যাদাসহ আমি ব্যান্জারমাসিন-এ সামরিক বাহিনীতে মুসলমান ইমমি হই ১৯৫০-৫১ সনে। আমার লিখিত প্রবন্ধগুলো ছাপা হয়েছিল মুসলিম বিভিন্ন সাময়িকীতে, যেমন, সোলো-র মিন্জুয়ান আদিল-এ, জাকার্তার মিন্জুয়ান রিসালাহ্, জ্বিহাদ-এ এবং বান্ডুং-এর মিন্জুয়ান এন্টি কমিউনিজ সাময়িকীতে। ১৯৩৬ সন থেকে আমি আক্রমণাত্মক মসীহীয়াত (খ্রীষ্টধর্ম) বিরোধীদের সহযোগি ছিলাম মুয়ারা তেউয়েহ্-তে (বারিতো) এবং ১১৬২ সন পর্যন্ত আমি সেসব মুসলমান দল গোটা ইন্দোনেশিয়াতে মুসলমান শাসন কায়েম করতে সংকল্পবদ্ধ ছিল তাদের প্রতি সহানুভূতিপূর্ণ ছিলাম, যা স্বতঃসিদ্ধ ভাবেই খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়।

বস্তুতঃপক্ষে, ১৯৩৬ সন থেকে একটি বাইবেল আমার অধিকারভুক্ত ছিল। কিন্তু সত্য খুঁজে পাওয়ার জন্য আমি তা থেকে পাঠ করিনি, কিন্তু খ্রীষ্টান-বিরোধী মনোভাব নিয়ে আমার নিজ অস্থানের (দৃষ্টিভঙ্গির) সমর্থনে অংশ খুঁজে পাওয়ার জন্যই তা করেছিলাম, এবং এরূপে যেন মসীহী বিশ্বাসের উপর আরও সম্পূর্ণরূপে ঈসা মসীহের খোদাত্ব অস্বীকার করে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত আমি তাঁর অপযশকারী ছিলাম। উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে সত্য প্রত্যাখান করে সত্যের ব্যঙ্গ করতাম। কিন্তু আল্লাহ্‌র মহব্বত এতই মহৎ যে, তিনি আমার অন্বেষণ করেছিলেন, আমাকে খুঁজে পেয়েছিলেন এবং আমাকে রক্ষা করেছিলেন।

১৯৬২ সনে মসজিদে দেবার উদ্দেশ্যে একটি উপদেশ লেখার সময়ে সূরাহ্ আল-মায়িদাহ্, ৬৮ আয়াতের সম্বন্ধে গভীরভাবে চিন্তা করছিলাম, যেখানে লেখা ছিল ,

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّىَ تُقِيمُواْ التَّوْرَاةَ وَالإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ

“…বল, হে আহলে কিতাব ! তোমরা কোন পথেরই উপরে নহ, যে পর্যন্ত তোমরা তৌরাত, ইঞ্জিল ও তোমাদের প্রতিপালকের পক্ষ হইতে তোমাদের প্রতি কিতাবের পাবন্দি না কর।”

ইতিপূর্বে অন্ততঃ একশো বার এ আয়াতটি আমি পাঠ করেছিলাম, কিন্তু পরিশেষে খোদা আমার অন্তরের কানে কানে বলেছিলেন যে, কোরানে যে তৌরাত ও ইঞ্জিল সম্বন্ধে উল্লিখিত আছে, বর্তমানে বাইবেলে (কিতাবুল মোকাদ্দসে) দৃষ্ট তৌরাত ইঞ্জিল তার সঙ্গে অভিন্ন ও এক।

আমি বরাবরই চিন্তা করে আসছিলাম যে, তৌরাত ও ইঞ্জিল বাস্তবে আর অস্তিত্বমান নেই এবং ওগুলোর বিষয়বস্তু সারসংক্ষেপে কোরানে বিবৃত হয়েছে। আমি নিশ্চিত বলে ভাবতাম যে, বর্তমান বাইবেল যে তৌরাত ও ইঞ্জিল নিয়ে গঠিত সেসব মিথ্যে, এবং মৌলিক বিষয়বস্তু ভুলভাবে মানুষের দ্বারা বিন্যস্ত হয়েছিল, জাল করা হয়েছিল, বা তার সাথে কিছু যুক্ত করা হয়েছিল।

যা হোক আমার অন্তর বলেছিল যে, বর্তমানে উপস্থাপিত তৌরাত ও ইঞ্জিল সত্য। আমার মন অনবরত আমার অন্তঃস্বরের বিরোধীতা করছিল :“না ! বাইবেলের তৌরাত ও ইঞ্জিলের রদবদল (মিথ্যায়ন) করা হয়েছে।” আমার চিন্তাসমূহ আমার অন্তরাত্ম ও বিবেকের বিরোধীতা করছিল, আর কি ঠিক সে সম্বন্ধে আমি অনিশ্চিত ও সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছিলাম।

আমার বিবেকের শান্তি বিধোনের জন্য আমি সমস্যাটি খোদার দরবারে মধ্যরাত্রির এবাদতে (তাহ্জুদ নামাজে) উপস্থিত করলাম। এ মোনাজাত আল্লাহ্‌র কাছে সত্যের সুনির্দিষ্ট চিহ্নের জন্য বিনতি জানানো হয়। দুটি বিশ্বাসের মধ্যে কোনটি সঠিক তা উপলব্ধি বা চিহ্নিত করতে আল্লাহ্‌র সাহায্য কামনা করেছিলাম। আমার মোনাজাত ছিল এই:

“হে খোদা আসমান ও জমিনের মালিক, আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা, মুসলমান, খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধদের আল্লাহ্; উপত্যকা ও পর্বতরাজির , চন্দ্র ও তারকারাশির আল্লাহ্; বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের আল্লাহ্; দয়া করে কোরানে উল্লিখিত তৌরাত ও ইঞ্জিল সম্পর্কিত সত্য আমাকে দেখিয়ে দিন। এর অর্থ কি এই যে, মৌলিক তৌরাত ইঞ্জিলের অস্তিত্ব আর নেই, সেসবেরই সংক্ষিপ্তসার কোরানে বিবৃত হয়েছে? তা-ই যদি সত্যি হয়, তবে আমার অন্তর সংবলীকৃত করুন, যেন আমি আর বাইবেল পাঠ না করি। কিন্তু কোরানে উল্লিখিত ‘তৌরাত ও ইঞ্জিলের সত্য’ যদি এখন বাইবেল প্রাপ্ত সত্যকে বুঝায়, তবে আমি মিনতি জানাই, আমার হৃদয় খুলে দিন, যেন আমি সততার সঙ্গে বাইবেল পাঠ করতে আরও আগ্রহী হই।”

আমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আমি অন্য কারো সাহায্য কামনা করিনি। কোন ধর্ম-প্রচারক, দীনদার মুসলমান বা আমার জ্ঞানি বা বুদ্ধিমান বন্ধুদেরও আমি জিজ্ঞেস করিনি। সর্বজ্ঞ-সর্বদর্শী আল্লাহ্কে সরাসরি আমার জন্য মনোনয়ন করে দিতে বলেছিলাম, যেন আমি আসমানি ইচ্ছানুযায়ী সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি। আমি আকুল ও আন্তরিক ভাবে মোনাজাত করেছিলাম খোদার পথ-নির্দেশনার প্রত্যাশায়, যেন তিনি আমার জন্য সত্য মনোনয়ন করে দেন এবং নির্ভুল ধর্ম জানতে ও স্বীকার করতে আমাকে সাহায্য করেন।

প্রত্যেক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিই আশা করেন যে, মৃত্যুর পর এক বাস্তব জীবন আছে। এবং এসব লোকদের মধ্যে একজন হওয়ার কারণে আমি আমার আশা স্থাপন করেছিলাম আল্লাহ্‌তেই। আমি বিশ্বাস করতাম, মৃত্যুর পরে আমাদের যাওয়ার জন্য মাত্র দুটি স্থানই আছে: অনন্ত অগ্নিতে নিরবিচ্ছিন্ন শাস্তি সমেত দোযখ, অথবা অনন্ত গৌরবে আল্লাহ্‌র সঙ্গে থাকার জন্য স্বর্গ বা বেহেশত। আমার অনন্ত ভবিষ্যতকে আমি হালকাভাবে বিবেচনা করতে পারিনি।

উদাহরণস্বরূপ, ধীরুন, আমরা ১০ গ্রাম বিশুদ্ধ স্বর্ণ ক্রয় করেছি। কেউ আদেরকে ঠকায়নি এ সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়ার জন্য তা আমাদের অবশ্যই সতর্কতার সঙ্গে পরীক্ষা করে দেখতে হবে, যেন ভবিষ্যতে আফশোস করতে না হয়।তাহলে আমাদের প্রাণের (আত্মর) ভবিষ্যত সম্বন্ধে আমাদের আরও না কত বেশি সতর্কতার সঙ্গে চিন্তা-বিবেচনা করা উচিত। আল্লাহ্ যিনি বেহেশ্‌তি জীবনদাতা তাঁর ইচ্ছানুক্রমেই আমাদের এবাদতের সত্য যাচাই করে দেখতে হবে এবং অধ্যয়ন করতে হবে। অন্যথায়, আমাদের অসতর্কতার জন্য চিরকাল আফশোস করতে হবে। আমি সব সময়ই বিশ্বাস করতাম, আল্লাহ্ নিজেই বেহেশ্‌ত ও দোযখের নির্মাতা। এ কারণে আমি মানুষের উপদেশ বা পরামর্শ নেই নি- খ্রীষ্টানদেরও নয়, মুসলমান ধর্ম-প্রচারকদেরও নয়। তারা মানুষ মাত্র এবং খোদার ইচ্ছানুরূপ সঠিক সত্য তারা না জানতেও পারেন। তাই আমি সরাসরি সব সত্রের অধিকারী আল্লাহ্‌র সমীপবর্তী হয়েছিলাম এবং এই আশা ও আস্থা সহ তাঁর কাছে মিনতি জানিয়েছিলাম যে, তিনি আমাকে সত্য পথ-নির্দেশনা দিবেন।

আল্লাহ্ মাবুদের গৌরব হোক যে, আমার সব মোনাজাতের উত্তর মিলেছিল। এর দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, যে কেউ সত্য জানতে চায় এবং সেজন্য আন্তরিকভাবে মিনতি জানায় তিনি তাদেরকে অবশ্যই লক্ষ্যনীয় যে, সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্, ৬৮ ছাড়া কোরানের আরও বহু অংশ ঐ সময়ে আমার মনে রেখাপাত করেছিল। উদাহরণস্বরূপ:

সূরাহ্ আল-সাজ্বদাহ্, ২৩:

تَكُن فِي مِرْيَةٍ مِّن لِّقَائِهِ وَجَعَلْنَاهُ هُدًى لِّبَنِي إِسْرَائِيلَ

“আর আমি মূসাকেও ধর্মগ্রন্থ প্রদান করিয়াছিলাম। অতএব তুমি উহা প্রাপ্তিতে সন্দেহ পোষন করিও না।”

সূরাহ্ আল-সাজ্বদাহ্ ২৩

সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্, ৪৬:

قُلْ يَا أَهْلَ الْكِتَابِ لَسْتُمْ عَلَى شَيْءٍ حَتَّىَ تُقِيمُواْ التَّوْرَاةَ وَالإِنجِيلَ وَمَا أُنزِلَ إِلَيْكُم مِّن رَّبِّكُمْ وَلَيَزِيدَنَّ كَثِيرًا مِّنْهُم مَّا أُنزِلَ إِلَيْكَ مِن رَّبِّكَ طُغْيَانًا وَكُفْرًا فَلاَ تَأْسَ عَلَى الْقَوْمِ الْكَافِرِينَ

“আমি তাহাদের” (পূর্ববর্তী নবীদের) “পশ্চাতে মরিয়ম পুত্র ঈসাকে প্রেরণ করিয়াছিলাম, তাহার পূর্ববর্তী কিতাব সমর্থকরূপে, এবং তাঁহাকে ইঞ্জিল প্রদান করিয়াছিলাম যাহাতে হেদায়েত ও নূর রহিয়াছে এবং যাহা তাহার পূর্ববর্তী কিতাব তৌরাতের সমর্থক ও পরহেজগারদিগের জন্য হেদায়েত এবং উপদেশ।”

সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্ ৪৬

সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্, ৪৭:

وَلْيَحْكُمْ أَهْلُ الإِنجِيلِ بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فِيهِ وَمَن لَّمْ يَحْكُم بِمَا أَنزَلَ اللّهُ فَأُوْلَـئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ

“এবং যেন ইঞ্জিলধারীগণ আল্লাহ্ যাহা উহাতে নাজিল করিয়াছেন, তদনুযায়ী ব্যবস্থা প্রদান করে এবং যে ব্যক্তি আল্লাহ্‌র নাজিলকৃত কিতাব অনুযায়ী হুকুম প্রদান না করে, তাহারাই অবাধ্য।”

সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্ ৪৭

সূরাহ্ আল-বাকারাহ্, ৬২:

إِنَّ الَّذِينَ آمَنُواْ وَالَّذِينَ هَادُواْ وَالنَّصَارَى وَالصَّابِئِينَ مَنْ آمَنَ بِاللَّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَعَمِلَ صَالِحاً فَلَهُمْ أَجْرُهُمْ عِندَ رَبِّهِمْ وَلاَ خَوْفٌ عَلَيْهِمْ وَلاَ هُمْ يَحْزَنُونَ

“যাহারা মুসলমান এবং যাহারা ইহুদি এবং নাসারা ও যাহারা অগ্নিপূজারী, ইহাদের মধ্যে যাহারা আল্লাহ্‌র প্রতি ও পরকালের প্রতি ঈমান আনিবে এবং সৎকাজ করিবে, তাহাদের জন্য তাহাদের প্রভুর নিকট পুরস্কার রহিয়াছে, তাহাদের ভয় নাই এবং তাহারা মর্মপীড়িত হইবে না ।”

সূরাহ্ আল-বাকারাহ্ ৬২

তৌরাত ও ইঞ্জিল আল্লাহ্‌র ইচ্ছানুরূপ সত্যের প্রকৃত পথ, এ ইঙ্গিত বাহী আরও বহু উক্তি কোরানে আছে। কোরানের এসব অংশ বাইবেলের আরও গভীরে অনুসন্ধান করতে আমার মনকে সঞ্জিবিত করেছিল, কারণ খোদা এর সত্য সম্বন্ধে আমার আত্মর কাছে মৃদুস্বরে কথা বলেছিলেন।

মধ্যরাত্রির মোনাজাতে তাঁর কাছে পথ-নির্দেশনার মিনতি জানানোর পরদিন আমি আমার মধ্যে সুস্পষ্ট পরিবর্তন অনুভব করেছিলাম। সেই সময় থেকে, আর শত্রু বলে নয়, কিন্তু বাইবেলকে আমি বন্ধু বলে বিবেচনা করতাম। মহা আগ্রহ নিয়ে সকাল বেলাতে বাইবেল হাতে নিলাম এবং পাঠ কালে পাঠ্যাংশের প্রতিটি শব্দের প্রতি আমি অভিনিবেশ সন্নিবেশিত করেছিলাম, কারণ আমি এর সত্য সুনির্দিষ্টভাবে জানতে ইচ্ছুক ছিলাম।

بِسْمِ اللّهِ الرَّحْمـَنِ الرَّحِيمِ

“দয়াময় ও করুনাময় আল্লাহ্‌র নামে,”

এ কথাগুলো দিয়ে আমি বাইবেল খুলেছিলাম। ঐ সময়ে আমি দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৫ পদ পড়তে আগ্রহী ছিলাম। এ অংশটি আমাকে আকর্ষিত করেছিল, কারণ ইতিপূর্বে আমি, ধর্মপ্রচারক হোক বা শিক্ষকই হোক, খ্রীষ্টানদের বিশ্বাসের ওপরে আঘাত হানার হাতুড়িরূপে এ অংশটিকে ব্যবহার করতাম, উদ্দেশ্য এই, যেন তারা বাইবেলের এ অংশের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে হযরত মুহম্মদকে নবীরূপে স্বীকার ও বিশ্বাস করে। এ অংশটি আমার পূর্বপরিচিত ছিল, কিন্তু এর অর্থ এখন আমার জন্য বদলে গিয়েছে। সত্যিই, যারা বাইবেলে বিশ্বাস করে না তাদের প্রতেকের জন্য তা বুঝার জন্য রুদ্ধ ও কঠিনই থেকে যায়, কিন্তু অপর পক্ষে, যারা এতে বিশ্বাস করে এবং যাদের অন্তর পাক-রূহে পূর্ণ, তারা স্পষ্ট ভাবে তা বুঝতে সক্ষম হয়।

দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৫ পদের কথাগুলো নিুরূপ:

“তোমার আল্লাহ্ মাবুদ তোমার মধ্য হইতে, তোমার ভ্রাতৃগণের মধ্য হইতে, তোমার জন্য আমার সদৃশ একজন নবী উৎপন্ন করিবেন , তাঁহারই কথায় তোমরা কর্ণপাত করিবে।”

দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৫

ইতিপূর্বে আমি এ অংশটিকে হযরত মুহম্মদ সম্পর্কিত ভবিষ্যদ্বানী বলে বিবেচনা করতাম । “আমার (মূসার) সদৃশ একজন নবী”- এ কথাগুলোকে আমার কাছে প্রতিজ্ঞাত নবীরূপে হযরত মুহম্মদের ইঙ্গিতবহ ছিল, কারণ:

  • মূসা পিতা-মাতার দ্বারা জন্মপ্রাপ্ত ছিলেন, হযরত মুহম্মদও তদ্রুপ মাতা-পিতার দ্বারা জন্মপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি ঈসা মসীহের মত ছিলেন না, যিনি পিতা ছাড়া কেবল মাতা দ্বারা জন্মপ্রাপ্ত হয়েছিলেন।
  • বয়ঃপ্রাপ্ত হলে পর মূসা বিয়ে করেছিলেন। ঈসা যিনি কখনও বিয়ে করেননি, এর বিপরীতে হযরত মুহম্মদও বিয়ে করেছিলেন।
  • মূসার সন্তানেরা ছিল এবং হযরত মুহম্মদেরও সন্তান-সন্ততি ছিল। কিন্তু ঈসার কোন বংশধর ছিল না, কারণ তিনি কখনও বিয়ে করেননি।
  • মূসা বৃদ্ধ বয়সে মারা গিয়েছিলেন এবং হযরত মুহম্মদের প্রতিও অনুরূপ ঘটেছিল। কিন্তু ঈসা মসীহ্ মৃত্যুর দ্বারা কবলিত থাকেননি। তিনি জীবিতবস্থায় বেহেশতে আরোহন করেছিলেন, কবরে আবদ্ধ থাকেননি।

ইতিপূর্বে আমার কাছে স্পষ্ট বলে প্রতীয়মান হত যে, দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৫ পদে মূসার দ্বারা প্রতিজ্ঞাত নবীরূপে হযরত মুহম্মদকেই নিদের্শ করে, কিন্তু মসীহী বিশ্বাস অনুসারে এতে ঈসা মসীহকে নবীরূপে, এবং আদৌ ইব্নুল্লাহ্‌রূপে ভবিষ্যদ্বানী করা হয়নি।

কিন্তু ঐ দিন প্রকৃত অর্থ অনুধাবনের জন্য আমি, পদটিকে ধীরে ধীরে আন্তরিকভাবে পাঠ করেছিলাম। যখন আমি “…আমার সদৃশ এক নবী”কে এ অভিব্যক্তি পর্যন্ত পৌছালাম, তখন পাক-রূহ মৃদুস্বরে আমার অন্তরে এ কথা বলেছিলেন, “তুমি যদি বুঝতে চাও যে, হযরত মুহম্মদ ও মূসা নবীর মধ্যে সাদৃশ্য হল, তারা উভয়েই পিতা-মাতার দ্বারা জন্মপ্রাপ্ত, তবে তো তারা অবশিষ্ট মানবজাতির সকলেরই সদৃশ, কারণ তারাও পিতা-মাতার দ্বারা জন্মপ্রাপ্ত।” এই ভবিষ্যদ্বানীর সত্য নির্দেশ করার জন্য এই বৈশিষ্ট্যটিকে একটি বিবেচ্য বিষয় বলে বিবেচনা করা যায় না।

অধিকন্তু, বিবাহিত হওয়ার কারণেই যদি হযরত মুহম্মদ মূসার সদৃশ হন, তবে উভয়ে ছিলেন দুনিয়ার অন্যসব মানুষেরই মত। তাই, এটিকেও হযরত মুহম্মদ উক্ত নবী ছিলেন প্রমাণ করার জন্য ব্যবহার যায় না।

বংশধর থাকার কারণে যদি হযরত মুহম্মদকে মূসার সদৃশ বলে বিবেচনা করা হয়, তবে এই বাস্তবতাকেও ভবিষ্যদ্বানীটি নির্ভুলভাবে নির্ধারন কার জন্য ব্যবহার করা যায় না, কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ লোকেরই সন্তান-সন্ততি আছে।

হযরত মুহম্মদ ঠিক মূসা নবীরই মত বৃদ্ধ বয়সে মারা গিয়েছেন ও কবরস্থ হয়েছেন। এ দৃষ্টান্ত যদি ভবিষ্যদ্বানীটির অর্থ প্রমাণের জন্য ব্যবহারযোগ্য নয়, কারণ পৃথিবীর সব মানুষকেই মরতে ও সমাহিত হতে হবে। মারা যাওয়া ও সমাহিত হওয়া সকলেরই স্বাভাবিক পরিণতি, এবং কোন মানুষকে অনন্য করে তোলে না।

আমার কাছে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছিল যে, মূসার ভবিষ্যদ্বানী প্রতিজ্ঞাত নবীরূপে একমাত্র ঈসা মসীহের প্রতিই নির্দেশ করেছিল। সেই কারনে মূসা ও ঈসা মসীহের মধ্যে অনন্য ও অসাধারণ সাদৃশ্য খুঁজে বের করতে হয়েছিল। বাস্তবিকই, আমি বেশ কয়েকটি অসাধারণ সাদৃশ্য এ দুজন ব্যক্তির মধ্যে খুঁজে পেয়েছিলাম, যেগুলোর ভাগী অন্যেরা কেউ নেই।

  • মূসার শৈশব কালে ফিরাউন তাকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিলেন, ঠিক তেমনি ঈসা তার শৈশবে হেরোদ দ্বারা নিহত হবার হুমকির সম্মুখিন হয়েছিলেন। সব মানুষ জন্মগ্রহন করে তাদের শৈশবে হত্যার হুমকির সম্মুখিন হয় না।
  • মূসার জন্মকালে ফিরাউন ভয়ানক ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন এবং দুই বছর বয়সের নিচের সব বালককে অবশ্যই হত্যা করার আদেশ দিয়েছিলেন। সমগ্র বিশ্বে কেবলমাত্র এ দুজন ব্যক্তিই এরূপ প্রচন্ড ঘৃণা ও নির্যাতনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছেন।
  • তার শৈশবে মূসা রক্ষিত হয়েছিলেন ফিরাউনের কন্যার দ্বারা। শিশুরূপে ঈসা রক্ষিত হয়েছিলেন তাঁর পালক-পিতা ইউসুফের দ্বারা। সব লোকেরাই তাদের শৈশবে জীবনের উপরে হুমকি এলে পরে আল্লাহ্‌র মনোনিত লোকদের দ্বারা রক্ষিত হয়নি।
  • শৈশব কালে মূসা স্বদেশ থেকে সুদূর মিশরে বাস করতেন। ঈসার বেলাতেও ঠিক তাই, যিনি শৈশবে মিশরে প্রবাসী জীবন যাপন করেছিলেন। সমস্ত লোকদেরই শৈশবে মিশরের মত দূর কোন দেশে পালাতে হয়নি।
  • আসমানী বার্তাবাহক হিসেবে যখন তিনি কাজ করছিলেন, তখন মূসা অলৌকিক সাধন করার জন্য মাবুদের শক্তি প্রাপ্ত হয়েছিলেন, ঠিক যেমনি ভাবে ঈসা, যিনি জীবন্ত কালাম হিসেবে নিজ ক্ষমতাবলে আল্লাহ্‌র শক্তি প্রাপ্ত হয়েছিলেন পীড়িতদের সুস্থ ও মৃতদের কবর থেকে উত্থিত করা দ্বারা অলৌকিক কাজ সম্পাদন করার জন্য।
  • মূসা ইস্রাইল জাতিকে মিশরীয় ক্রীতদাসত্বের বন্ধন থেকে মুক্ত করেছিলেন, কিন্তু ঈসা তাঁর লোকদের মুক্ত করেছিলেন পাপ ও মৃত্যুর শিকল থেকে।

এই বিশেষ প্রমাণগুলো আমাকে এ সিদ্ধান্তে পৌছতে অনুমোদন করেছিল যে, দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১৫ পদে উল্লিখিত অনন্য ভবিষ্যদ্বানীটি পূর্বোক্ত নবীরূপে হযরত মুহম্মদকে প্রমাণ করার জন্য উদ্দিষ্ট হয়নি, কিন্তু ঈসা মসীহই মাংসে ছুরতপ্রাপ্ত আল্লাহ্‌র কালাম (কালেমাত্-উল্লাহ্), এ সত্য নির্দেশ করার জন্যই।

যদিও খোদার মহব্বত এত মহৎ ছিল যে, তিনি বাইবেলকে আল্লাহ্‌র প্রকৃত কালামরূপে স্পষ্টভাবে দেখতে আমাকে জ্ঞানালোক প্রদান করেছিলেন, কিন্তু তখনও আমি খ্রীষ্টান হতে প্রস্তুত ছিলাম না। কেন? কারণ, খ্রীষ্টিয় (মসীহ) বিশ্বাসের কয়েকটি বিষয় আমি গ্রহণ করতে পারছিলাম না, বিশেষত: এই বিশ্বাস যে, ঈসা আল্লাহ্‌র পুত্র (ইবনুল্লাহ্)। শৈশব থেকে আমাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল, এবং পরবর্তীকালে আমি অন্যদের শিক্ষা দিয়ে আসছিলাম যে,

لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ

“আল্লাহ্ বে-নেওয়াজ, না তিনি প্রজনন করিয়াছেন, না প্রজনিত হইয়াছেন।”

আর আমি একথাও স্পষ্ট ভাবে উচ্চারণ করতে পারছিলাম না যে, ঈসা ছিলেন খোদাবন্দ, কারণ আমাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল, এবং আমি নিজেও শিক্ষা দিচ্ছিলাম যে,

لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ

“আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নাই।”

আরও, আমি ত্রিত্ববাদের অর্থও বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমি শিক্ষা পেয়েছিলাম যে,

لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُواْ إِنَّ اللّهَ ثَالِثُ ثَلاَثَةٍ

“আল্লাহ্ তিনের তৃতীয় জন এ উক্তিকারীগণও নিঃসন্দেহে কাফের হইয়া গিয়াছে।”

আরও, আমি মসীহী এই বিশ্বাস গ্রহণ করতে পারছিলাম না যে,ঈসা বাস্তবিকই সলীবে হত হয়েছিলেন। “ঈসা-আল-মসীহ” যদি একজন নবী, আল্লাহ্‌র প্রিয় ও বিশ্বস্ত বার্তাবাহক, অথবা খ্রীষ্টানদের আখ্যা অনুসারে, তিনি যদি ‘আল্লাহ্‌র পুত্র ’ হয়ে থাকেন, তাহলে ইহুদিরা কিভাবে এত সহজে তাঁর উপর নির্যাতন চালাতে এবং মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত তাঁকে সলীবে টাঙ্গিয়ে রাখতে পেরেছিল? খোদা কেন তাঁকে রক্ষা করলেন না, কিন্তু তাঁকে সলীবে হত হতে দিলেন? ধরুন, আমি আমার ছেলেকে দৈহিকভাবে নির্যাতিত হতে, অথবা, এমনকি, সলীবে ঝুলতে দেখতে পেলাম, তাহলে তখন নিশ্চিতভাবেই আমি তাকে রক্ষার জন্য নির্যাতনকারী লোকদের সঙ্গে লড়াই করতাম, পরিণামে যা-ই ঘটুক না কেন। আল্লাহ্ কিভাবে ইহুদিদের উপরে তাঁর কর্তৃত্ব হারাতে পারলেন? ঐ সময়ে সত্যিই আমি এ বিষয়টিকে মেনে নিতে পারিনি।

এ বিষয় বুঝার জন্য সহায়ক ব্যাখ্যা পাওয়ার উদ্দেশ্যে আমি কয়েকজন ইঞ্জিল প্রচারকের সাথে দেখা করে জানতে চেয়েছিলাম যে, কেন ঈসাকে আল্লাহ্‌র পুত্র অথবা খোদাবন্দ বলা হয় এবং আল্লাহ্‌র ত্রিত্ববাদের অর্থ কি। আমি অনুসন্ধান করেছিলাম আল্লাহ্‌র পুত্র ঈসা কেন ইহুদীদের দ্বারা সলীবে বিদ্ধ ও হত হয়েছিলেন? আমি তাদের আরও জিজ্ঞেস করেছিলাম “পূর্বপুরুষদের পাপ সন্তান-সন্ততির উপরে বর্তানোর” মতবাদ সম্বন্ধে, যেটিকে আমি খোদার অন্যায় শাস্তি প্রদান বলে বিবেচনা করতাম।

যাদের কাছে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম তারা সব ক’জন মসীহী প্রচারকই আমার প্রশ্নগুলোর উত্তর সযত্নে ব্যাখ্যা করেছিলেন, কিন্তু ঐ সময়ে আমি তাদের মন্তব্যগুলো আমি গ্রহণ করতে পারিনি, যদিও সেগুলো সুন্দরভাবে প্রকাশ করা হয়েছিল। এর কারণ ছিল আমাদের বিভিন্ন পটভূমি যা আমাদের দুই পক্ষের মাঝখানে বিশাল উপসাগরের তুল্য ব্যবধান করেছিল। এ দুই ধর্মের পার্থক্যগুলো যথেষ্ট ভালোভাবে অধ্যয়ন ও গবেষনা করা হয়নি যা দ্বারা কিছু সংখ্যক সম্মিলন-বিন্দু (ঐক্যের বিষয়) খুঁজে পাওয়া যেত। নিশ্চিতঃই, দুটি ধর্মের পার্থক্য আমাদের অবশ্যই অধ্যয়ন ও গবেষণা করতে হবে, ভুল বুঝাবুঝি অতিক্রম করার জন্য যুক্তিসম্মত সংযোগ খুঁজে পাবার উদ্দেশ্যে। ঐ সময়ে আমি ছিলাম বেতারের একটি গ্রাহক-যন্ত্রের মত এবং প্রচারক ছিলেন প্রেরন যন্ত্রের মত। উভয়েই চমৎকার অবস্থাতে ছিল, কিন্তু আমাদের বিভিন্ন তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের কারণে তার (প্রচারকের) প্রেরন ও আমার গ্রহণ ছিল সম্পূর্ণ পৃথক। গ্রাহক-যন্ত্র ঘোষকের কন্ঠস্বর ধরতে অক্ষম ছিল।

ইঞ্জিল প্রচারক ও ঘোষকদের ব্যাখ্যাগুলো আমার বাম কান দিয়ে ঢুকে ডান কান দিয়ে বের হয়ে গিয়েছিল। ওসব আমার হৃদয় স্পর্শ করতে পারেনি, কারণ আমি তাদের বিশেষ শব্দ-প্রয়োগ অনুধাবনে অক্ষম ছিলাম। মসীহী প্রচারক নিজেই সুনির্দিষ্টভাবে আমার পটভূমি বুঝতে পারেননি, তাই তার ব্যাখ্যাও আমার আশানুযায়ী হয়নি। মসীহী প্রচারকের বর্ণনা ভুল ছিল বলে এমনটি ঘটেছিল তা নয়, কিন্তু মূল উপাদানের দিক থেকে চিন্তা ও ব্যাখ্যাদানের পদ্ধতি ছিল বিভিন্ন, যেজন্য একে অপরকে বুঝতে পারে নি। এ সত্বেও আমি আশায় পূর্ণ ছিলাম। আমি তখনও নিশ্চিত ছিলাম যে, খোদা যখন একবার আমাকে সত্য বেছে নিতে সাহায্য করেছেন, যেসব সমস্যা আমার অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছিল সেসব পূর্ণরূপে তিনিই আমাকে পথ-নির্দেশনা দিবেন।

আমার অবিশ্রান্ত মোনাজাত ছিল :“হে খোদা, তোমার কাছে করজোড়ে মিনতি জানাই, ‘ইবনুল্লাহ্’ শব্দ এবং ঈসা মসীহের জন্য ‘খোদাবন্দ’ নাম ব্যবহার সম্পর্কিত সত্য আমার কাছে প্রকাশ কর। আরও মিনতি জানাই, পবিত্র ত্রিত্ববাদের অর্থ এবং সলীবের রহস্য আমার কাছে প্রকাশ কর। হে খোদা, তুমি আমাকে এই অন্তর্র্দর্শন দিয়েছো যে, বাইবেল সত্য সত্যই আসমানী কিতাব, তাই তুমি বাইবেলের মধ্য দিয়েই আমার সব বাধা বুঝিয়ে পরি¯কার করে দিবে, যে বাইবেল আল্লাহ্‌র কালাম যা আদি থেকে আজ পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়নি এবং শেষ কাল পর্যন্ত কস্মিনকালেও পরিবর্তিত হবে না।”

বাস্তবিকই তাই। তাঁর রূহ, পাক-রূহ্ যিনি আমার অন্তরে কাজ করছিলেন, তাঁর মাধ্যমে খোদা আমাকে বহুবার সাহায্য করেছিলেন। খোদা কিভাবে আমার অন্তরায়গুলো অতিক্রম করতে সাহায্য করেছিলেন, আমি আপনাদের তা বুঝিয়ে বলব।

ঈসাকে আল্লাহ্ পুত্র (ইবনুল্লাহ্) আখ্যা দেয়া হয়

ইউহোন্না ১:১,১৪ পদে এরূপ লেখা আছে:

“শুরুতে কালাম ছিলেন, এবং কালাম আল্লাহ্‌র কাছে ছিলেন, এবং কালাম আল্লাহ্ ছিলেন।…আর সেই কালাম দেহে ছূরতপ্রাপ্ত হইলেন , এবং আমাদের মধ্যে বসবাস করিলেন, আর আমরা তাঁহার মহিমা দেখিলাম, যেমন পিতা হইতে আগত একজাতের মহিমা; তিনি রহমতে ও সত্যে পূর্ণ।”

এই পদে ‘আল্লাহ্‌র পুত্র’ অভিব্যক্তিটির আত্মিক অর্থ প্রকাশ পেয়েছে।‘আল্লাহ্‌র কালাম’ মানব-রূপ পরিগ্রহ করেছিলেন ঈসা মসীহের জন্মের দ্বারা। এজন্য, ঈসাকে বলা হয় ‘জীবন্ত কালাম’, যেমন ১ ইউহোন্না ১:১ পদে উক্ত আছে।

একথা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, আল্লাহ্ দৈহিক ও জৈবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম দেওয়া হেতু ঈসাকে আল্লাহ্‌র পুত্র বলা হয় না, যেমন, অনেকে এরূপ ভ্রান্ত চিন্তা করে থাকেন, কিন্তু পাক-রূহের দ্বারা মরিয়মের পুত্রে ‘আল্লাহ্‌র কালাম’ প্রকাশিত হওয়া হেতু তাঁকে সেই আখ্যা দেওয়া হয়।

এ পদের সত্যের পক্ষে হযরত মুহম্মদ নিজেই বেশ কয়েকবার সাক্ষ্য বহন করেছেন এরূপ উক্তির দ্বারা:

عيسى فانه روح الله وكلمته

“ঈসা সত্য সত্যই আল্লাহ্‌র রূহ্ (রূহুল্লাহ্)এবং তাঁর কালাম (কালেমাত্-উল্লাহ্)।”

(হাদীস এনাস-বিন-মালিক, মুতিয়ারা হাদীস, পৃঃ৩৫৩)

সূরাহ্ আল-নিসা, ১৭১-এ আমরা এরূপ পাঠ করি:

إِنَّمَا الْمَسِيحُ عِيسَى ابْنُ مَرْيَمَ رَسُولُ اللّهِ وَكَلِمَتُهُ أَلْقَاهَا إِلَى مَرْيَمَ وَرُوحٌ مِّنْهُ

“মরিয়মের পুত্র ঈসা আল্লাহর একজন রাসূল ছিল, আল্লাহর একটি কালেমা যাহা তিনি মরিয়মের দিকে পাঠাইয়াছিলেন এবং আল্লাহর তরফ হইতে একটি আত্মা।”

সূরাহ্ আল-নিসা, ১৭১

‘তাঁর কালাম’ বা ‘আল্লাহর কালাম’ যা ঈসার দেহে পরিণত হয়েছিল, এ অভিব্যক্তি সম্পর্কে ডঃ হাযবুল্লাহ বার্কি তার ‘নবী ঈসা দালাম আল-কোরান এন্‌ষ’ কোরানে ঈসা নবী) শীর্ষক পুস্তকের ১০৯ পৃষ্ঠায় এরূপ বলেন, “নবী ঈসাকে ‘কালেমাত্-উল্লাহ’ (আল্লাহর-কালাম) বলে অভিহিত করা হয়, কারণ তিনি আল্লাহর কালামের দৈহিক রূপ, এবং নবী ঈসাকে ধারণ করার কাজের জন্য মরিয়মকে মনোনীত করা হয়েছিল।”

এ কারণে, সেই সময় থেকে আমি আর ঈসাকে ‘আল্লাহর পুত্র, বলতে দ্বিধাগ্রস্ত হই নি, কারণ তিনি ‘মাবুদের জীবন্ত কালামের’ দৈহিক রূপ। পূর্বে আমি ঈসাকে আল্লাহর পুত্র বলে স্বীকার করতে অস্বীকার করতাম, কারণ তখন ‘পুত্র’ শব্দটি আমি জৈবিক ও মানবিক ভাবে বুঝতাম।

সূরাহ এখ্লাসে লেখা আছেঃ

اللَّهُ أَحَدٌ…لَمْ يَلِدْ وَلَمْ يُولَدْ وَلَمْ يَكُن لَّهُ كُفُوًا أَحَدٌ

“আল্লাহ্ এক, … না তিনি প্রজনন করিয়াছেন, না প্রজনিত হইয়াছেন, আর না কেহ তাঁহার সমকক্ষ আছে।”

সূরাহ এখ্লাস

আল্লাহর একজন পুত্র আছে একথা অস্বীকার করার জন্য এই ‘বিশ্বস্ততার সূরাহ’ টিকে মুসলমান ধর্ম প্রচারকেরা ব্যবহার করে থাকেন যাদের মধ্যে পূর্বে আমিও একজন ছিলাম। যাই হোক, একজন খ্রীষ্টান কোরানের এ অংশটি গ্রহণ করতে পারে, কারণ খ্রীষ্টধর্ম (মসীহীয়াত) কখনও জৈবিক অর্থে আল্লাহর একজন পুত্র আছে বলে দাবি করে না, যেভাবে কোরানে ‘ওয়ালাদ’ শব্দ দ্বারা উক্ত হয়েছে, যার অর্থ জৈবিক প্রক্রিয়ায় জাত পুত্র। আরবী ভাষা-ভাষী খ্রীষ্টানরা ঈসাকে ‘আল্লাহর পুত্র’ আখ্যা দিতে আইনগত অর্থে ‘ইবনে’ শব্দটি ব্যবহার করে। এ শব্দ প্রয়োগে তাঁকে জৈবিক প্রক্রিয়া জাত সন্তান বলা হয় না, যেভাবে কোরানে ‘ওয়ালাদ শব্দ দ্বারা বর্ণিত হয়েছে।

এজন্য, আমি উল্লেখ করতে চাই যে, আইনগত অর্থে ঈসা মসীহের জন্য ‘ইবনে’ (পুত্র) ব্যবহারে ‘আল্লাহর পুত্র’ নাম সংক্রান্ত বাইবেলের শিক্ষা প্রত্যাখ্যানকারী একটি আয়াতও কোরানে সেই। ‘ওয়ালাদ’ অর্থে আল্লাহ ও মরিয়মের মধ্যে যৌন-প্রক্রিয়াজাত এক জন পুত্র হিসাবে ঈসাকে ‘আল্লাহর পুত্র’ বলার দাবিকেই মাত্র কোরান প্রত্যাখ্যান করেছে। আমরা খ্রীষ্টানরাও এরূপ ধারনাকে অগ্রাহ্য করি।

ঈসাকে খোদাবন্দ (প্রভু) আখ্যা দেয়া হয়

কেন ঈসাকে খোদাবন্দ বা প্রভু বলা হয়? এর আগেই আমি স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দিয়েছি যে আমি দীর্ঘ্য কাল যাবৎ ‘ইসাই প্রভু বা খোদাবন্দ’ একথা উচ্চারণ করতে পারিনি। আমি একথাও উচ্চারণ করতে পারি নি, “খোদাবন্দ ঈসা মসীহ”। শৈশব কাল থেকে আমি শিক্ষা পেয়ে এসেছি এবং পরে অন্যদেরও শিক্ষা দিয়েছি যে,

“আল্লাহ, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নাই।”

পিতা ছাড়া জন্মগ্রহন করার কারণেই হয়তো ঈসাকে খোদাবন্দ বা প্রভু বলা হয়। না! আদমও পিতা ছাড়া, এমন কি, মাতা ছাড়া জন্মেছিলেন। অথবা, এজন্য কি যে, তিনি অনেক অলৌকিক কাজ সম্পাদন করেছিলেন? না, এটিও উত্তর হতে পারে না। নবী মূসাও অনেক অলৌকিক কাজ করেছিলেন, অথচ তাকে খোদা বলা হয় নি। ঈসা কুষ্ঠ রোগীদের সুস্থ করতে পারতেন এবং মৃতদের জীবিত করতে পারতেন, এ কারণে কি? না, কারণ নবী ইলিয়াশও কুষ্ঠরোগী সুস্থ করতে এবং মৃতদের পুনর্জীবন দিতে পারতেন, এবং তবুও তাকে খোদা বলা হয় নি। ঈসার সরাসরি বেহেশতে আরোহনের কারণে কি? না, নবী ইলিয়াসেরও একই অভিজ্ঞতা ছিল, এবং তাঁকেও খোদাবন্দ বা প্রভু বলা হয় নি। তাহলে কেন ঈসাকে প্রভু বলা হয়?

যেমন আমরা ইউহোন্না ১:১, ১৪ পদে পাঠ করি, ঈসাকে প্রভু বলা হয়, কারণ ঈসা মসীহের জন্মে ‘আল্লাহর কালাম’ মানব-রূপ নিয়েছিলেন। সেই কারণে ১ ইউহোন্না ১:১ পদে তাঁকে জিন্দেগীর কালাম এবং অন্যান্য পদে দেহে প্রকাশিত আল্লাহ, বলে অভিহিত করা হয়েছে।

‘আল্লাহর দেহে প্রকাশিত হওয়া বা ছুরতপ্রাপ্ত হওয়া অথবা ‘আল্লাহ’ সম্পর্কিত অনুরূপ শব্দ আভিধানিক বা পার্থিব অর্থে কখনই অনুবাদ করা উচিত নয়। “আল্লাহ্, বিদ্যমান আছেন, মানুষও বিদ্যমান রয়েছে।” বিদ্যমান থাকা’ বা ‘অস্তিত্বমান থাকা’ আল্লাহর সম্পর্কে ব্যবহৃত হলে মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত ঐসব শব্দের চাইতে ভিন্নতর অর্থ গ্রহণ করে। আল্লাহ স্বীয় অস্তিত্বে অস্তিত্বমান, কিন্তু মানুষ অস্তিত্বমান, কারণ তাদের অস্তিত্বমান করা হয়েছে, তারা সৃষ্ট।

সেই কারণে আল্লাহ, সম্পর্কে ‘দেহে ছুরতপ্রাপ্ত’ হওয়ার বিষয়ক শব্দটি পার্থিব অর্থে অনুবাদ করা উচিত নয়। অভিধানিক অর্থ অনুসারে, যদি একটি বিড়াল হাতির রূপ ধারন করে, বিড়ালটি উবে যাবে এবং একটি হাতি উপস্থিত হবে। যদি এক খন্ড পাথর সোনায় রূপান্তরিত হয়, তবে পাথরের অস্তিত্ব আর থাকবে না, থাকবে সোনার। ‘দেহে ছুরতপ্রাপ্ত হওয়া’ অভিব্যক্তিটি আল্লাহর সম্পর্কে ব্যবহার ভিন্নতর অর্থ বহন করে। আল্লাহর সম্পর্কিত ‘দেহে প্রকাশিত হওয়া’ বলতে খোদার অস্তিত্বে কোন পরিবর্তনের অর্থ প্রদান করে না, কারণ আল্লাহর কোন পরিবর্তন নাই কিতাবুল মোকাদ্দস, মালাখী ৩:৬

আল্লাহ মানুষের রূপ গ্রহণ করলেন। এ দ্বারা একথা বুঝায় না যে, খোদা আর অস্তিত্বমান নেই, কেবলমাত্র মানুষেরই অস্তিত্ব থাকবে। এ ধারণা ভূল। আল্লাহ মানব-রূপ গ্রহণ করলেন এর অর্থ হল, আল্লাহর অস্তিত্ব অব্যাহত রয়েছে এবং মানব-রূপও অস্তিত্বমান রয়েছে। তাই ‘মানবরূপ-গ্রহন’ বা ‘দেহে ছুরতপ্রাপ্ত হওয়া’ অভিব্যক্তিগুলো বিভিন্নতায় সাদৃশ্যমূলকভাবে যুক্তিবিদ্যার বহির্ভূত একটি কাজ ও সত্যের সাদৃশ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, কিন্তু তবুও এর অর্থ মানুষের ভাষায় অর্থের অনুরূপ নয়।

আল্লাহ্ দেহে ছুরতপ্রাপ্ত হলেন বা মানব-রূপ গ্রহণ করলেন বলতে এই অর্থ প্রকাশ করে যে, আল্লাহ্ নিজেকে, তাঁর সম্পূর্ণ সত্ত্বাকে একটি মানুষে প্রকাশিত করেছেন এবং তিনি তাঁর ইচ্ছা, পরাক্রম(শক্তি) এবং মহব্বত অনন্য মানুষ ঈসা মসীহের ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত করেছেন। এখন আমরা ঈসার উক্তিগুলো অনুধাবন কতে পারি:

“পিতা আমাতে আছেন এবং আমি পিতাতে আছি”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না-১০:৩৮খ

“আমি ও পিতা, আমরা এক”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১০:৩০

“যে আমাকে দেখিয়াছে, সে পিতাকে দেখিয়াছে”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৪:৯খ

রাসূল পৌল বলেছেন:

“কেননা তাঁহাতেই খোদাত্বের সমস্ত পূর্ণতা দৈহিক আকারে বাস করে”

ইঞ্জিল শরীফ, কলসীয় ২:৯

দ্বিতীয় যে পদটিতে ঈসা প্রকৃত খোদা বলে উক্ত আছে, সেটি আমরা পাঠ করতে পারি মথি ২৮:১৮ পদে, যেখানে ঈসা বলেন:

“আসমানে ও জমিনে সমস্ত ইখতিয়ার আমাকে দেওয়া হইয়াছে।”

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ২৮:১৮

ঈসা সর্ব শক্তিমান, সমস্ত কিছুর নিয়ন্তা।

রাসূল পৌল স্বীকার করেছিলেন:

“যিনি (অর্থাৎ ইসা) সমস্ত কর্তৃত্ব ও আধিপত্যের মস্তক”

ইঞ্জিল শরীফ, কলসীয় ২: ১০

স্বয়ং আল্লাহ্ই মবিুদ, যেমন আমরা কোরানে পাঠ করি:

اللّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ

“আল্লাহ্ই সারা জাহানের প্রভু।”

ইঞ্জিল শরীফে আমরা পাঠ করি যে, সর্বশক্তিমান আল্লাহ্ ঈসাকে খোদাবন্দ বা প্রভু করেছেন। এখানে আমরা আল্লাহ্‌র ও প্রভুর মধ্যেকার পার্থক্য নিরূপন করতে পারি। খোদা অর্থ গ্রীক ভাষাতে ‘থিয়স’ এবং আরবীতে আল্লাহ্; কিন্তু প্রভু অর্থ গ্রীকে ‘কাইরিয়স’ এবং আরবীতে ‘রব্ব’। বিধানিক ও শাসনিক দিক সমেত শেষোক্ত শব্দটির অর্থ সবসময়ই কর্তৃত্বপূর্ণ ‘ক্ষমতা’। আল্লাহ্‌র ক্ষমতা নিজেকে ঈসা মসীহের মধ্যে অনেক ভাবে প্রকাশ করেছে:

  1. সৃষ্টিতে
  2. শরীয়ত ও হুকুম প্রদানে
  3. পথ-নির্দেশনায় (সাহায্য ও খোদাই তত্ত্বাবধানে)
  4. ক্ষমা ও নাজাতে
  5. তাঁর আত্ম দ্বারা নবীনীকরণে
  6. বিচারে
  7. মহিমায়

আল্লাহ্‌র হুকুম প্রদানের, পথ-নির্দেশনা ও নাজাত দেবার ক্ষমতা ঈসার ব্যক্তিত্বে দেখতে পাওয়া যায়। সে কারণেই ঈসাকে ‘আল্লাহ্‌র জিন্দেগী কালাম’, “আমাদের একমাত্র নাজাতদাতা” আখ্যা দেওয়া হয়। জিন্দেগীর কালামরূপে প্রচার ও ক্ষমা দান দ্বারা ঈসা আল্লাহ্‌র খোদাত্ব সম্পন্ন করেন। সে কারণে ঈসা আল্লাহ্‌র দ্বারা খোদাবন্দ হয়েছেন (প্রেরিত ২:৩৬; কলসীয়২:১৬)।

ঈসা প্রভু, এই অর্থে যে, সম্পূর্ণরূপে নাজাত করার ক্ষমতা তাঁর আছে। ঈসা আমাদের সকলের নাজাতদাতা, জিন্দেগীর সেই কালাম ঈসা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন “আমিই তরিকা, হক ও জিন্দেগী, আমা দিয়া না আসিলে কেহ পিতার নিকটে আসেনা” (ইউহোন্না ১৪:৬)।

মনে রাখা উচিত যে, ইসলামী সাক্ষ্যই সেই প্রতিবন্ধক যা ঈসাকে প্রভু বা খোদাবন্দ বলতে আমাকে অক্ষম করেছিল। আমাকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছিল এবং আমি অন্যদের শিক্ষা দিয়ে আসছিলাম:

لآ اِلَهَ اِلّا اللّهُ

“আল্লাহ্, তিনি ছাড়া কোন মাবুদ নাই।”

ঐ সময়ের মধ্যে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই ইসলামী স্বীকারোক্তি আবশ্যিকভাবে বাইবেল-বিরুদ্ধ বলে প্রতিপন্ন হয়না। হিজরত ২০:৩ পদে লেখা আছে, “আমাকে ছাড়া তোমার অন্য দেবতা না থাকুক।” সেই কারণে আমি দেখতে পাই যে, হযরত মুহম্মদের উক্তিতেও ঈসার খোদাত্বের ইঙ্গিত রয়েছে যাতে স্বীকার করা হয়েছে যে, ঈসা মসীহ, আল্লাহ্‌র রূহ ও তাঁর কালাম, আল্লাহ্‌র স্থলাভিষিক্ত ক্ষমতা:

عيسى فانه روح الله وكلمته

“ঈসা সত্য সত্যই আল্লাহ্‌র রূহ এবং তাঁর কালাম।”

মসীহীয়াতে এক আল্লাহ্-বাদ (তৌহিদ)

‘তৌহিদ’ কথাটি মসীহী বিশ্বাসীদের কানে অদ্ভুত শোনায়, কারণ তা মসীহীয়াতে আদৌ ব্যবহৃত হয়না। মসীহীয়াতে তৌহিদ আল্লাহ্‌র ত্রিত্বের একত্ব বুঝিয়ে দেয় বা ব্যাখ্যা করে। ত্রিত্বের একত্ব, মসীহী বিশ্বাসীদের এই কেন্দ্র বিন্দু নিয়ে মাঝে মাঝে আলোচনা হয়েছে, কিন্তু আমাদের ভাইয়েরা যারা মুসলিম শিক্ষা ও পটভূমি থেকে আগত তারা অধিকাংশই সাধারণতঃ এই সত্য যথার্থভাবে অনুধাবন করতে পারেন না।

একমাত্র সত্য আল্লাহ্

প্রত্যেক প্রকৃত মুসলমানই একমাত্র সত্য আল্লাহে বিশ্বাস করে। ইসলামী মতবাদে এটি সুবিদিত সত্য যে, এ বিষয় কখনও পরিবর্তিত বা পরিহার করা যায় না।

সেই একই প্রত্যয় মসীহীয়াতেও বিদ্যমান। মসীহীরাও একমাত্র এক এবং সত্য আল্লাহকে স্বীকার করে। ‘কেবল মাত্র এক ও সত্য আল্লাহ্’ এ অভিব্যক্তি সম্পর্কে মসীহী ও মুসলমানদের ধারনা বস্তুতঃ কি অভিন্ন?

ইসলামের শিক্ষায় আল্লাহ্‌র একত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে সূরাহ্ আল-এখলাস, ১, সূরাহ আল-বাকারাহ্, ১৬৩, সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্, ৭২খ এবং অন্যান্য আয়াতে।

কিতাবুল মোকাদ্দসে আল্লাহ্‌র একত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে:

“আমিই মাবুদ, আর কেহ নাই।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৪৫:৫

“আর ইহাই অনন্ত জিন্দেগী যে, তাহারা তোমাকে, একমাত্র সত্যময় আল্লাহকে এবং তুমি যাঁহাকে পাঠাইয়াছ, তাঁহাকে, ঈসা মসীহকে, জানিতে পারে।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৭:৩

“আমরা জানি,…এক আল্লাহ ছাড়া দ্বিতীয় নাই।”

ইঞ্জিল শরীফ, ১ করিন্থীয় ৮:৪খ

“আমাদের জ্ঞানে একমাত্র আল্লাহ, পিতা, যাঁহা হইতে সকলই হইয়াছে, ও আমরা যাঁহারই জন্য; এবং একমাত্র খোদাবন্দ সেই ঈসা মসীহর, যাঁহার দ্বারা সকলই হইয়াছে এবং আমরা যাঁহারই দ্বারা আছি।”

ইঞ্জিল শরীফ, ২ করিন্থীয় ৮:৬

এ অনুচ্ছেদ গুলো পড়ার পরে আমি আর সন্দিগ্ধ থাকলাম না। আমার দৃঢ় প্রত্যয় হল যে, আল্লাহ্‌র একত্ব সম্পর্কিত মুসলমান হিসেবে আমার পূর্ববর্তী বিশ্বাস এবং মসীহী হিসেবে আমার বর্তমান বিশ্বাস পরিবর্তন করার প্রয়োজনীয়তা নেই। অন্য ভাষায় বলতে গেলে, যদিও আমি নিজেকে মসীহী বলে ঘোষনা করি, তথাচ আমি আল্লাহ্‌র একত্ব সম্পর্কিত সত্য পরিহার কি প্রত্যাহার করিনি। আমি অনুভব করি, মসীহী হবার পরে আমি তা আরও বিশুদ্ধভাবে বুঝতে পারি।

মুসলমানরা সব সময়ই ধরে নেই যে, মসীহীরা আল্লাহ্‌র একদ্বের মতবাদ লঙ্ঘন করে। তারা ভুল করছে। কিন্তু আমি দৃঢ়ভাবে নিশ্চিত যে, মসীহী শিক্ষা বস্তুত পক্ষে আল্লাহ্‌র একত্বের মতবাদকে বিশোধিত করে। আল্লাহ্ সম্বন্ধে মসীহী এক-আল্লাহ্বাদ সর্বোত্তম ও বিশুদ্ধতম শিক্ষা। এ বিষয়টি আমরা বহু-ঈশ্বরবাদের (বহু-আল্লাহবাদ) অর্থ ব্যাখ্যা করে পরীক্ষা করে দেখতে পারি।

বহু-আল্লাহ্‌বাদের সমস্যা

বহু-আল্লাহ্ বাদ (বহুদেব-দেবীর এবাদত) ইসলামে একটি অপরিহার্য বিষয়। এ বিষয়ে আমাদের সতর্কতার সঙ্গে অভিনিবেশ করা উচিত, যেন মসীহীয়াতে আল্লাহ্‌র একত্বের সঙ্গে বহু-আল্লাহবাদ মিলিয়ে গুলিয়ে না ফেলি।

ইসলামে তিনটি অমার্জনীয় পাপের মধ্যে বহু-ঈশ্বরবাদ অন্যতম। এ কারণে দুটি ধর্মের তুলনা করার প্রচেষ্টাতে এ প্রশ্নটি অত্যন্ত জরুরী হয়ে উঠেছিল। আমি সব সময়ই সতর্ক দৃষ্টি মেলে লক্ষ্য করতাম মসীহীয়াত বহু-ঈশ্বরবাদের কোন উপাদান ধারন করে কি না।

সর্ব প্রথমে আমি একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কিতাবুল মোকাদ্দসে দেখতে পেয়েছিলাম যা বলছে,

“আমাকে ছাড়া তোমার অন্য দেবতা না থাকুক। তুমি নিজের জন্য খোদাই করা মূর্তি বানাইও না; উপরিস্থ আসমানে, নীচস্থ জমীনে ও জমীনের নিচের পানির ভিতরে যাহা যাহা আছে, তাহাদের কোন মূর্তি বানাইও না; তুমি তাহাদের কাছে সিজদা করিও না, এবং তাহাদের এবাদত করিও না, কেননা তোমার আল্লাহ্ মাবুদ আমি নিজের গৌরব রক্ষা করিতে উদ্যোগী আল্লাহ্; আমি বাপ দাদাদের অপরাধের প্রতিফল সন্তানদিগের উপরে বর্তাই, যাহারা আমাকে দ্বেষ করে, তাহাদের তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ পর্যন্ত বর্তাই।”

তৌরাত শরীফ, হিজরত ২০: ৩-৫

রাসূল ইউহোন্না আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন, “বৎসেরা, তোমরা মূর্তি হইতে নিজদিগকে রক্ষা কর” (১ ইউহোন্না ৫:২১)। এসব প্রতিমা বা মূর্তি সম্পর্কে অবশ্যই পরিস্কার সংজ্ঞা থাকতে হবে যে, কোন্ বস্তুকে কখন মূর্তি বা প্রতিমা বলা হয়। সব শিলা মূর্তি বা ধাতব-মূর্তিকেই প্রতিমা (আরাধ্য) বলা যায় না। সমস্ত স্তম্ভকেই প্রতিমা বলা যায় না। আবার সমস্ত কবর-প্রস্তরকেই মূর্তি বলা যায় না, ঠিক যেমনি ভাবে সমস্ত ঐতিহাসিক ইমারতকেই মূর্তি বা প্রতিমা বলা যায় না। যদি লোকেরা তাদের উদ্দেশ্যে ধর্মীয় কর্তব্যাদি সম্পাদন করত, অথবা যদি তাদের এবাদত করত এবং তাদের উদ্দেশ্যে মোনাজাত করত, তবে এসব ইমারত আরাধ্য মূর্তি হতে পারত, অথবা আরাধ্য মূর্তিতে রূপান্তরিত করা যেতে পারত। মৃত লোকদের আত্ম চালান, অথবা ঝাড়নের মাধ্যম হিসেবে ধূপ-ধূনা, আগরবাতি এবং মন্ত্রোচ্চারন সমেত গুপ্ত বিদ্যায় বিশ্বাসী, ভাগ্য-কথক ও জাদুকরীরা বহু-ঈশ্বরবাদের ইঙ্গিত বহ। কিতাবুল মোকাদ্দসে জোরালোভাবে এরূপ অভ্যাসে বিজড়িত না হতে আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে এবং এরূপ মন্ত্র ব্যাবহারকারী লোকদের এড়িয়ে চলতে বলে, যেমন দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১০-১৩ পদে সুদৃঢ় ভাবে ঘোষনা করা হয়েছে:

“তোমাদের মধ্যে যেন এমন লোক পাওয়া না যায়, যে পুত্র বা কন্যাকে আগুনের মধ্যে উৎসর্গ করে, যে মন্ত্র ব্যাবহার করে, বা গণক, বা মোহক, বা মায়াবী, বা ঐন্দ্রজালিক বা ভূতুড়িয়া, বা গুণী বা প্রেত সাধক। কেননা মাবুদ এই সকল কাজ যাহারা করে তাহাদিগকে ঘৃনা করেন, আর সেই ঘৃণার্হ কাজের জন্য তোমার আল্লাহ্ মাবুদ তোমার সম্মুখ হইতে তাহাদিগকে বেদখল করিবেন। তুমি আপন আল্লাহ্ মাবুদের উদ্দেশ্যে কামিয়াব হও।”

তৌরাত শরীফ, দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১০-১৩

বহু-ঈশ্বরবাদ সম্পর্কে সারসংক্ষেপে আমি বলতে চাই:

  1. মসীহীয়াত দৃঢ়ভাবে ঘোষনা করে যে, একমাত্র আল্লাহ্ আছেন। এই এক আল্লাহ্‌র এবাদত করতে এবং তাঁর উদ্দেশ্যে নিবেদিত-প্রণ হতে প্রত্যেকে বাধ্য। অন্য দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে বিচ্যুতি মহা পাপ। (পড়ুন:- লূক ৪:৮; মথি ৪:১০; দ্বিঃবিবরণ ৬:১৩; ইউসা ২৪:১৪,১৫)।
  2. আল্লাহ্‌র একত্ব বুঝার জন্য মসীহী মতবাদ এক আল্লাহ্ ব্যতীত কোন আকারে অন্য দেব-দেবীর বা আরাধ্য বস্তুর অস্তিত্ব যথার্থ বলে বিবেচনা করে না, যেমন, প্রতিমা, ইমারত বা মানুষের তৈরী প্রাকৃতিক কোন কিছুর মূর্তি, এমন কি সাদা লাল বা কালো রঙের ছবিতে বা কার্পেটে অঙ্কিত কাবাও (বায়তুল্লাহ্ও) নয়। এর সম্মুখে বা পাদদেশে এবাদতের নমুনায় নতজানু হওয়া সমর্থনযোগ্য নয়। (পড়ুন: হিজরত ২০:৩-৫)

  3. কিতাবুল মোকাদ্দস অনুসারে একজন প্রকৃত মসীহী ভাগ্য-কথক, জাদুকর-জাদুকরীদের মন্ত্রোচ্চারণ এবং সৌভাগ্য আনয়নকারী কল্পিত বস্তু (এমন কি, যদি বাইবেল থেকেও তৈরী করা হয়) এবং মৃত আত্ম চালান অথবা ঝাড়নের জন্য ধূপ-ধূনা- আগরবাতি জ্বালানোর কাছে যাওয়া ও আস্থা স্থাপন করা এড়িয়ে চলে। সে অবশ্যই অন্ধ-সংস্কার ও অন্ধকারের দুষ্টাত্মদের প্রভাবের ভয়মুক্ত হবে। (পড়ুন: দ্বিতীয় বিবরণ ১৮:১০-১৩)।

  4. দুষ্টাত্মর প্রভাব, বা জাদু-মন্ত্র বা অন্ধকারের শক্তি বলে অর্থ করা যায় এমন কিছুকে নিবেদিত-পাণ মসীহী অবশ্যই ভয় করবে না এবং করেও না। কিতাবুল মোকাদ্দসের অনেক ক্ষেত্রে উক্ত আছে যে, মসীহের পরাক্রম দুষ্টাত্মদের শক্তিকে পরাজিত করে বিজয় গ্রহণ করেছে। অবশেষে ঐ সব দুষ্টাত্মরা মসীহ্ ও তার অনুসারীদের কাছে নতিস্বীকার করবে। (পড়ুন: ইউহোন্না ১৪:১২; মার্ক ১৬:১৭)।

  5. আঙটিতে মূল্যবান পাথর, ছোরা, মাদুলি বা তাবিজ-কবজের মত বস্তু সমূহকে বিশেষ অধিভৌতিক শক্তি সম্বলিত বলে মসীহীরা কখনই বিবেচনা করবে না। মসীহীয়াতে একমাত্র শক্তি হলেন আল্লাহ্‌র রূহ, রুহুল কুদ্দুস (পড়ুন: রোমীয় ১৪:১৭-১৮)।

  6. ভীতি, অস্বস্তি, উদ্বেগ এবং মসীহীদের জীবনের অন্য সব সমস্যাগুলো এমন বিষয় যা অবশ্যই মোনাজাতে একমাত্র আল্লাহ্‌র সাক্ষাতে নিয়ে আসতে হবে। কেবলমাত্র তিনিই আমাদের সব প্রয়োজন বুঝেন এবং আমাদের মোনাজাতের উত্তর দেন। (পড়ুন: যবুর ৫:৩;মথি ৬:২৫-৩৪; ৭:৭,৮) পাক্-কবরে (মাজারে) যাবেন না, এমন কি, নবীদের মাজারেও না, তাদের নাম যাই হোক না কেন।

পরিশেষে, আমি শুদ্ধ সংবেদে সর্ব সমক্ষে স্বীকার করতে ও বিশ্বাস করতে পারি যে, মসীহী তৌহিদ পরমোৎকৃষ্ট ও বিশুদ্ধতম তৌহিদ। এতে বিধি আত্ম, মূর্তি অথবা মানব-সৃষ্ট দেব-দেবীর স্থান নেই। একমাত্র আল্লাহ্, পিতা এবং তাঁর সক্রিয়, জীবন্ত কালাম, খোদাবন্দ ঈসা মসীহ আছেন।

আল্লাহ্ সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদ

ঈসা মসীহের উপর ঈমান দ্বারা মন-পরিবর্তনের পূর্বে আল্লাহ্, সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদ আমার জন্য ছিল অপর আরেকটি অন্তরায়। এটি অবশ্য আরও অনেকেরই জন্য অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছিল। মসীহী ঈমান সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারনার কারণেই এই অন্তরায় ।

আমি প্রত্যক্ষ করেছিলাম যে, আল্লাহ্ সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদের অর্থের সত্য আল্লাহ্‌র একত্বের মতবাদ (তৌহিদ) আদৌ লঙ্ঘন করে না।

সূরাহ আল মায়েদাহ্ ৭৩- এ বলা হয়েছে:

لَّقَدْ كَفَرَ الَّذِينَ قَالُواْ إِنَّ اللّهَ ثَالِثُ ثَلاَثَةٍ

“আল্লাহ্ তিনের তৃতীয় জন, এই উক্তিকারীগণও কাফের হইয়া গিয়াছে।”

সূরাহ আল মায়েদাহ্ ৭৩

সূরাহ্ আল-নিসা ১৭১- এ লেখা আছে:

وَلاَ تَقُولُواْ ثَلاَثَةٌ

“তোমার খোদা তিনজন বলিও না।”

সূরাহ্ আল-নিসা ১৭১

মসীহী ঈমানে আসার পূর্বে আমাকে সহ, আমাদের মুসলমান ভাইয়েরা আল্লাহ্ সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদের মসীহী ব্যাখ্যা প্রত্যাখ্যান করার ধরাবাধা সূত্ররূপে কোরানের এসব আয়াত প্রায়শঃ ব্যবহার করে থাকেন। বস্তুত পক্ষে কোরানের এ আয়াতগুলো মসীহী ঈমানের পবিত্র ত্রিত্বের একত্বের নয়, কিন্তু কেবল মাত্র তিন পৃথক খোদায় বিশ্বাস প্রত্যাখ্যান করে।

কোরানের এ আয়াতগুলোকে আমরা মসীহীরা প্রশংসা করতে পারি, কারণ কিতাবুল মোকাদ্দস বিরুদ্ধ ত্রি-আল্লাহ্বাদ, অর্থাৎ- “তিন পৃথক খোদায়” ঈমান সহ সব ধরনের “বহু-আল্লাহবাদ” মসীহীয়াত অগ্রাহ্য করে। পরন্তু মসীহীয়াত নিরেশ্বরবাদ (অর্থাৎ, আল্লাহ্ নাই) এবং সর্বেশ্বরবাদও (অর্থাৎ,আল্লাহ্ ও সৃষ্টি অভেদ) অগ্রাহ্য করে।

কিতাবুল মোকাদ্দস আল্লাহে ঈমান এভাবে মুদ্রাঙ্কিত করে রেখেছে:

“হে ইস্রায়েল, শুন; আমাদের আল্লাহ্ মাবুদ এক মাবুদ”

তৌরাত শরীফ, দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৪,৫

ঈসা এই বিশ্বাস সূত্র জনসমক্ষে স্বীকার করেছিলেন (মার্ক ১২:২৯,৩০)।

ইশাইয়া ৪৫:৫ পদে উক্ত আছে,

“আমিই মাবুদ, আর কেহ নাই।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৪৫:৫

ইউহোন্না ১৭:৩ পদে লেখা আছে,

“আর ইহাই অনন্ত জিন্দেগী যে, তাহারা তোমাকে, একমাত্র সত্যময় আল্লাহ্ কে, এবং তুমি যাঁহাকে পাঠাইয়াছ, তাঁহাকে ঈসা মসীহকে জানিতে পারে।”

ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১৭:৩

আল্লাহ্ সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদে মসীহী বিশ্বাস একমাত্র সত্যময় আল্লাহের একত্বের সঙ্গে বিরুদ্ধ ভাবাপন্ন এ সম্পর্কে, এমন কি, নূন্যতম প্রমাণও নেই। অনেকে যেমন ব্যাখ্যা দিয়ে থাকেন, তা এমন কি তিনজন সংযুক্ত খোদার অর্থও প্রকাশ করে না।

  1. আল্লাহ্ সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদ নিম্নোক্তভাবে ব্যাখ্যা করা যায়: “পিতা” রূপে আখ্যায়িত সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্ বিশ্বের স্রষ্টা, যা ইসলামে ‘পরাক্রমশালী’ অর্থে আল্-কাদির শব্দের সদৃশ।
  2. তাঁর কালাম, যাকে ‘পুত্র’ নামেও আখ্যা দেওয়া হয়, ঈসার জন্মে মানব-রূপ পরিগ্রহ করেছিল। আল্লাহের বিধিসমূহ ও ইচ্ছা প্রকাশ করার জন্য, মানুষের কাছে আল্লাহের প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করার জন্য, মানবিক ভাষায় কথা বলার জন্য তিনি ছিলেন আল্লাহের জীবন্ত কালাম। (তাঁর কালাম হওয়া মুসলমান শিক্ষা অনুযায়ী “মুরিদ-ইচ্ছুক” বিশেষণের অনুরূপ)।
  3. আল্লাহ্‌র রূহ্, অথবা “পাক-রূহ,” সত্যের সেই আত্ম তিনি যারা তাঁর উদ্দেশ্যে উৎসর্গীকৃত হয় তাদেরকে সাহায্য ও পরিচালনা দিয়ে থাকেন। (আল্লাহের-রূহ্ ইসলামে ‘মূহাই-জীবনদাতা’ বিশেষণের সমতুল্য।)

আল্লাহ্‌রই তিনটি রূপ বা অভিব্যক্তি (পিতা,পুত্র/কালেমাত্-উল্লাহ্, এবং পবিত্র বা পাক-রূহ) তিন ব্যক্তিত্বরূপে বর্ণিত ও অঙ্কিত হয়েছেন (যা ইসলামে ‘সিফাত’ শব্দের সমতুল্য), কিন্তু তারা সারসত্ত্বায় আল্লাহ্‌র অস্তিত্বে এক। প্রত্যেক জনই অন্যদের থেকে অবিচ্ছেদ্য, প্রত্যেক জনেরই অভিন্ন পরাক্রম ও অমরত্ব আছে, এবং কোন জনই অন্যদের চাইতে পূর্বে বা পরে অস্তিত্বমান ছিলেন না। পিতা, পুত্র/কালেমাত্-উল্লাহ্ এবং পবিত্র আত্ম- সকলকেই একটি শব্দে প্রকাশ করা যায়: আল্লাহ্।

এ কথা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান যে, মসীহীয়াতের আল্লাহ্ সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদের একত্ব তৌহিদের মতবাদ লঙ্ঘন করে না, এবং তা একাধিক আল্লাহ্ বা ঈশ্বরের ঐক্যের অর্থও বহন করে না।

মসীহীয়াতের আল্লাহ্ সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদের অর্থের বিরুদ্ধে কোরান আপত্তি তোলে না বা প্রত্যাখ্যানও করে না। কোরান দ্বারা যা প্রত্যাখ্যিত হয়েছে তা দৃষ্ট হয় সূরাহ্ আল- মায়েদাহ্‌, ৭৩ অথবা সূরাহ আল-নিসাহ্, ১৭১ আয়াতে, যা তিন বিভিন্ন খোদায় বা ত্রি-আল্লাহ্বাদের বিশ্বাস। মসীহীয়াতেও নিজেই ত্রি-আল্লাহ্বাদ, বা তিন খোদায় বিশ্বাস পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করে।

সেই কারণে আমি মনে করি, মসীহীয়াতের সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ একটি আয়াতও কোরানে নেই।

ঈসা মসীহের মৃত্যু ও পুনরুত্থান

সূরাহ্ আল-নিসাহ্, ১৫৭ আয়াতে বলা হয়েছে,

وَقَوْلِهِمْ إِنَّا قَتَلْنَا الْمَسِيحَ عِيسَى ابْنَ مَرْيَمَ رَسُولَ اللّهِ وَمَا قَتَلُوهُ وَمَا صَلَبُوهُ وَلَـكِن شُبِّهَ لَهُمْ وَإِنَّ الَّذِينَ اخْتَلَفُواْ فِيهِ لَفِي شَكٍّ مِّنْهُ مَا لَهُم بِهِ مِنْ عِلْمٍ إِلاَّ اتِّبَاعَ الظَّنِّ وَمَا قَتَلُوهُ يَقِينًا

তারা এই কথা বলেছিল, “নিশ্চয় আমরা আল্লাহ্‌র রাসূল মরিয়ম পুত্র ঈসা মসীহকে হত্যা করিয়াছি, বস্তুত:তাহারা তাঁহাকে হত্যা করে নাই, শূলেও দেয় নাই, পরন্তু তাহারা বিভ্রান্ত হইয়াছে এবং যাহারা তাঁহার সম্বন্ধে মতবিরোধ করে, এই ব্যাপারে সন্দেহের মধ্যে পড়িয়া রহিয়াছে।”

সূরাহ্ আল-নিসাহ্ ১৫৭

ঈসা বাস্তবিকপক্ষে সলীবে হত হয়েছিলেন এ সত্য অগ্রাহ্য করার জন্য মুসলমান প্রচারকেরা প্রায়শঃ কোরানের এই আয়াতটি ব্যবহার করে থাকেন এবং ইতিপূর্বে আমিও মাঝেমধ্যে তা ব্যবহার করেছি। এর আগে আমি ভাবতাম যে, আল্লাহ্‌র প্রিয় পাত্র, যিনি তাঁর নবী হয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে কোন রক্ষা-ব্যবস্থা ছাড়া সলীবে হত হওয়া অসম্ভব ছিল। পরন্তু মসীহীরা যেহেতু তাঁকে ইবনুল্লাহ্ আখ্যা দেয়, সেই হেতু খোদা যিনি তাঁর পিতা তিনি আদৌ কোন রক্ষা-ব্যবস্থা দেন নি, তা অসম্ভব।

সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্, ৬৮ ও অন্যান্য আয়াত দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমার এই প্রত্যয় জন্মেছিল যে কোরান বাইবেলের সত্য সমর্থন করে, আর সেই হেতু আমি কিতাবুল মোকাদ্দস ও কোরানে লিখিত বিষয় অনুসারে ‘সলীবে ঈসার মৃত্যু ’ সম্বন্ধে নিরপেক্ষ ভাবে পুনরায় অধ্যয়ন ও গবেষণা করেছিলাম।

  1. কোরান অনুসারে আমরা একটি ঘটনা পাঠ করি যে, অন্য কেউ সলীবে বিদ্ধ ও হত হয়েছিল, কিন্তু সেই মৃত ব্যক্তির পরিচয় নিশ্চিত করা যায় নি। যিনি মরেছিলেন তিনি ঈসা মসীহ্ কোরানের শিক্ষকেরা তা অস্বিকার করেন। তারা বলে থাকেন সলীবে হত ব্যক্তি ছিল এহুদা।
  2. কোরান একথা বলে, ইহুদিরা স্থির-নিশ্চিত ছিল যে তারা বাস্তবিকই ‘ঈসাকে হত্যা’ করেছিল।

এখন, বাস্তবিকপক্ষে যে সলীবে বিদ্ধ ও হত হয়েছিল-ঈসা না অন্য কেউ সে সম্পর্কে আমাকে আরও ভাল ও প্রত্যয়-উৎপাদক তথ্য খুঁজতে হয়েছিল। এ তথ্য পাবার উদ্দেশ্যে আমাদের বিষয় গত ঐতিহাসিক দলিলের প্রমাণ খুঁজে বের করতে হয়েছিল। তা দেখতে পাওয়া যায় কিতাবুল মোকাদ্দসে যা একটি উন্মুক্ত লিপিবদ্ধ দলিল যা ঐতিহাসিক তথ্যের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

ঈসার সলীবে হত হওয়ার বিবরণ ইঞ্জিল শরীফের মথি, মার্ক, লূক ও ইউহোন্নার লিখিত চারটি কিতাবে আমরা পাঠ করতে পারি। এসব লেখকের সাক্ষ্য গুলো বাস্তব ঘটনা-ভিত্তিক যা তিনজন নিজেরাই প্রত্যক্ষ করেছিলেন।

যদি আমরা শরীয়তের এই শর্তটি মেনে নিই যে, কোন ঘটনার দুই বা তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী সেই ঘটনা শরীয়ত মোতাবেক (দ্বিতীয় বিবরণ ১৭:৬,৭) সত্য বলে স্থির-নিশ্চিত করতে যথেষ্ট, তাহলে আসার সলীবে বিদ্ধ ও হত হবার চারজন লেখকের মধ্যে তিনজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য সত্য, আইনানুগ ও বিশ্বাসযোগ্য; সেই তুলনায় ঘটনার ছয় শতাব্দী পরে হযরত মুহম্মদ বা কোরানে লিখিত সাক্ষ্য লেখক প্রত্যক্ষদর্শী না হওয়া হেতু প্রত্যয় উৎপাদনে অক্ষম নিছক ধারনা মাত্র বলে প্রতিপন্ন হয়

আরেকটি সাক্ষ্য যোগ করা যায়। প্রহরীদের কমান্ডার যখন ঈসাকে মৃত বলে ঘোষনা দিয়েছিলেন, তখন অরিমাথীয়ার ইউসুফ পন্তীয় পিলাতের সাক্ষাতে উপস্থিত হয়ে ঈসার দেহের জন্য অনুরোধ জানিয়েছিলেন। তার অনুরোধ মঞ্জুর করা হয়েছিল (মার্ক ১৫:৪২-৪৬)। ধরুন, সলীব থেকে যে দেহ নামানো হয়েছিল তা যদি ঈসার দেহ না হত, তাহলে কি অরিমাথীয়ার ইউসুফ সেই দেহের মৌলিকতা প্রত্যাখ্যান ও অস্বিকার করতেন না।

আরও একটি প্রমাণ হল এই যে, ইহুদিরা পন্তীয় পিলাতকে ঈসার কবর পাহারা দিতে অনুরোধ করেছিল। ঈসা ছাড়া অন্য কেউ সমাহিত হলে পিলাত পাহারার ব্যবস্থা করতেন না, কারণ তিনদিন পরে তিনি মৃতদের মধ্য থেকে আবার উঠবেন এ কথা পিলাত ঈসাকে বলতে শুনেছিলেন।

ধরে নেয়া যাক, সলীবে বিদ্ধ ব্যক্তি ঈসা ছিলেন না। তাহলে ঈসার প্রকৃত চরিত্র প্রকাশক এরূপ কথা তার পক্ষে উচ্চারণ করা সম্ভব হত না, “পিতা, ইহাদিগকে ক্ষমা কর, কারণ ইহারা কি করিতেছে তাহা জানেনা” এবং “সমাপ্ত হইলো”- এসব প্রমাণ করে যে সলীবে বিদ্ধ ব্যক্তি স্বয়ং ঈসা মসীহ্ বৈ অন্য কেউ নয়।

এরূপে আমি এ প্রত্যয়-উৎপাদিত সিদ্ধান্তে পৌছি যে, সূরাহ্ আল-নিসাহ্, ১৫৭ আয়াতে বর্ণিত “সলীব-বিদ্ধ হত” ব্যক্তি নিঃসন্দেহে স্বয়ং ইসা, এহুদার মত অন্য কোন ব্যক্তি নয়। চারজন ইঞ্জিল লেখকের সত্য সাক্ষ্য প্রত্যয় উৎপাদক, আইনানুগ ও সত্য।

মৃতদের মধ্য থেকে ঈসার পুনরুত্থান

কোরান কোন স্থানে মৃতদের মধ্য থেকে ঈসার পুনরুত্থান অস্বীকার করেনি। কোরান অনুসারে হযরত মুহম্মদ ঈসা সম্বন্ধে নিম্নরূপ অহী পেয়েছিলেন:

وَالسَّلَامُ عَلَيَّ يَوْمَ وُلِدتُّ وَيَوْمَ أَمُوتُ وَيَوْمَ أُبْعَثُ حَيًّا

“আর আমার প্রতি আল্লাহ্‌র শান্তি যে দিবস আমি ভূমিষ্ট হইয়াছি, আর যে দিবস আমার মৃত্যু ঘটিবে, আর যে দিবস আমাকে জীবিত অবস্থায় উঠাইয়া দাঁড় করানো হইবে।”

সূরাহ্ মরিয়ম ৩৩

যদিও কেউ কেউ তাঁর সলীবে মৃত্যু অস্বীকার করেন, উপরোক্ত আয়াতটি আমাকে স্থির-নিশ্চিত করেছিল যে, ঈসা বস্তুতঃই প্রকৃত মৃত্যুর অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন। আমি নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ঈসা পুনরুত্থিত হয়েছিলেন (উব্ আছু হাইয়ান)। ‘উব্ আছু হাইয়ান’ কথাগুলোর অর্থ হল, ‘আমুতু’, অর্থাৎ প্রকৃত মৃত্যুর অভিজ্ঞতার পরে জীবন্ত প্রেরিত হওয়া।

তৃতীয় দিনে ঈসা সত্য সত্যই মৃতদের মধ্য থেকে উঠেছিলেন, পুনরুত্থিত হয়েছিলেন দৃশ্য ও স্পর্শযোগ্য দেহ নিয়ে (ফিলিপীয় ৩:২১)। ঈসার মৃত্যুর কোন অর্থই থাকত না, যদি তা মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থানের মুকুটে বিভূষিত না হত।

ধরে নেয়া যাক, ঈসা সলীবে বিদ্ধ হয়েছিলেন, মৃত্যু বরণ করেছিলেন এবং তথাচ মৃতই থেকে গিয়েছিলেন। তবে তা হত মসীহীদের ওপর এক প্রচন্ড আঘাত, কারণ তাহলে তাদের আল্লাহ্ মারা গিয়ে উবে যেতেন। মসীহীয়াত আজ পর্যন্ত সুদৃঢ়ভাবে দাড়িয়ে থাকত না, এমনকি মসীহীদের বেহেশতে নাজাতের কোন প্রত্যাশাই থাকত না।

আরও, ঈসা যদি মৃত্যু বরণ করতেন এবং মৃত থেকে যেতেন এবং তাঁর হাড়গুলো আজও কবরেই থাকত, তাহলে মসীহীগণ কেন মৃত আল্লাহ্‌র এবাদত করত? কি উদ্দেশ্যেই বা একজন মসীহী একজন মৃত ব্যক্তির নামে বাপ্তিষ্ম নিত (তরীকাবন্দী হত)? তবে কোন উদ্দেশ্যে মসীহীগণ মৃত এক ব্যক্তি সম্বন্ধে ধ্যান করত? যদি তিনি নিজেই মৃত্যু থেকে মুক্তি না পান এবং এখনও কবরে শায়িত থাকেন, তা সত্ত্বেও যদি মসীহীগণ ঈসাকে তাদের নাজাতদাতা হিসেবে বিবেচনা করত, তবে তাদের ধ্যান-চিন্তা নিত্যান্ত বাজে বিষয়ে পর্যবসিত হত। আল্লাহ্ মহব্বত প্রমাণ করার উদ্দেশ্যেই ঈসাকে সলীবে হত হতে হয়েছিলো- চিরতরে মৃত থাকার জন্য নয়, কিন্তু পুনরুত্থিত হবার জন্য এবং এমন কি, কালের পরিসমাপ্তির পরেও জীবিত থাকার জন্য।

ঈসা মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হয়ে হয়ে আবার জীবন যাপন করেছিলেন তা কোন ব্যক্তির মিথ্যে রচনা বা উদ্ভাবন নয়, কিন্তু তা ছিল বাস্তব-সত্য যা অনেকে দেখেছিল এবং সাক্ষ্যও দিয়েছিল।

সমগ্র বিশ্বব্যাপী মসীহী জামাতের বিশ্বস্ত সাক্ষ্যের সার-বস্তুই হল ঈসার মৃত্যু ও পুনরুত্থান। আমাদের বিশ্বাস প্রত্যাশায় পরিপূর্ণ। আমাদের একজন নাজাতদাতা আছেন যিনি চিরঞ্জীব। আমাদের আছে মহব্বত-ভিত্তিক ঈমান, এবং আমরা ঈসার মাধ্যমে আল্লাহ্‌র প্রতিজ্ঞাসমূহের ওয়ারিশ। আমরা একসঙ্গে দুঃখভোগ করি এবং একসঙ্গে তাঁর সাথে গৌরবপ্রাপ্তও হব (রোমীয় ৮:১৭)।

মসীহের উম্মত হিসেবে আমাদেরকে অবশ্যই স্থির-নিশ্চিত হতে হবে যে, বিভিন্ন ধরনের সব মৃত্যু থেকে আমরা উত্থিত হব:

  • আমরা পারিবারিক অমিল, মতবিরোধ এবং ঘৃণা থেকে উত্থিত হই।
  • আমরা যন্ত্রনাদায়ক জীবিকা উপার্জনের মৃত্যু থেকে উত্থিত হই।
  • উদ্বেগপূর্ণ হৃদয়ের মরণ থেকে আমরা উত্থিত হই।
  • দুর্বল বিশ্বাসের মরণ থেকে আমাদের উত্থিত করা হবে।
  • আত্মবাদের (স্বার্থপরতার) মরণ থেকে আমরা উত্থিত হই।
  • দুঃখভোগ, পীড়া ও ভীতির মরণ থেকে আমরা উত্থিত হই।

আমাদের কাছে ঈসার সলীবের অর্থ

আসমানী অনুপ্রেরণায় রাসূল পৌল নিম্নোক্ত কথা লিখেছেন:

“কেননা কেহ যদি আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে বিবেকের কারণে অন্যায় ভোগ করিয়া দুঃখ সহ্য করে তবে তাহাই তারিফের বিষয়। বস্তুতঃ গোনাহ্ করিয়া চপেটাঘাত প্রাপ্ত হইলে যদি তোমরা সহ্য কর তবে তাহার সুখ্যাতি কি? কিন্তু সদাচরন করিয়া দুঃখ ভোগ করিলে যদি সহ্য কর, তবে তাহাই তো আল্লাহ্‌র কাছে তারিফের বিষয়। কারণ তোমরা ইহারই জন্য আহ্বানপ্রাপ্ত হইয়াছ কেননা মসীহও তোমাদের জন্য দুঃখভোগ করিলেন, যেন তোমরা তাঁহার পদ চিহ্নের অনুসরণ কর; “তিনি গোনাহ্ করেন নাই, তাঁহার মুখে কোন ছলও পাওয়া যায় নাই”, তিনি নিন্দিত হইলে প্রতিনিন্দা করিতেন না; দুঃখভোগ কালে তর্জন করিতেন না, কিন্তু যিনি ন্যায় অনুসারে বিচার করেন, তাঁহার উপর ভার রাখিতেন। তিনি আমাদের “গোনাহের বোঝা তুলিয়া লইয়া” আপনি নিজ দেহে কাঠের উপর বহন করিলেন, যেন আমরা গোনাহের পক্ষে মরিয়া দ্বীনদারীর পক্ষে জিন্দা হই; “তাঁহারই ক্ষত দ্বারা তোমার আরোগ্য প্রাপ্ত হইয়াছ”, কেননা তোমরা “মেষের ন্যায় ভুল পথে চলিয়াছিলে,” কিন্তু এখন তোমাদের জানের হেফাজতকারী ও উপদর্শকের কছে ফিরিয়া আসিয়াছ।”

ইঞ্জিল শরীফ, ১ পিতর ২:১৯-২৫

ঈসার সলীব ছিল তাঁর দুঃখভোগের শীর্ষ-বিন্দু। সলীবে মৃত্যু বরণ এমন কিছু ছিল না যা তিনি চেয়েছিলেন, কিন্তু তা ছিল আল্লাহ্‌র দ্বারা উদ্দীষ্ট পরিণতি অনুসারে। ঈসার দুঃখভোগের সুগভীর অর্থ সম্বন্ধে সে ঘটনা বাস্তবে সংঘটিত হবার ৭০০ বছর আগে নবী ইশাইয়া ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন:

“সত্যিই,

আমাদের তকলিফ সকল তিনিই তুলিয়া লইয়াছেন ,

আমাদের ব্যাথা সকল তিনি বহন করিয়াছেন;

তবু আমরা মনে করিলাম, তিনি আহত ,

আল্লাহ্ কর্তৃক প্রহারিত ও দুঃখার্ত।

কিন্তু তিনি আমাদের অধর্মের জন্য বিদ্ধ ,

আমাদের অপরাধের জন্য চূর্ণ হইলেন;

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৫৩: ৪-১২

আমাদের শান্তিজনক শাস্তি তাঁহার উপরে বর্ষিত হল, এবং তাঁহার ক্ষত সকল দ্বারা আমাদের আরোগ্য হইলো।

আমরা সকলে ভেড়ার ন্যায় ভ্রান্ত হইয়াছি, প্রত্যেকে নিজ নিজ পথের দিকে ফিরিয়াছি; আর মাবুদ আমাদের সকলকার অপরাধ তাঁহার উপরে বর্তাইয়াছেন।

তিনি মজলুম হইলেন, তবু দুঃখভোগ স্বীকার করিলেন, তিনি মুখ খুলিলেন না; মেষ শাবক যেমন জবেহ্ হইবার জন্য নীত হয়, ভেড়ী যেমন লোম কাটিবার লোকদের সামনে নীরব হয়, সেইরূপ তিনি মুখ খুলিলেন না।

তিনি জুলুম ও বিচার দ্বারা অপনীত হইলেন; তৎকালীয়দের মধ্যে কে ইহা আলোচনা করিল যে, তিনি জীবিতদের দেশ হইতে নির্মূল হইলেন?

আমার জাতির অধর্ম প্রযুক্তই তাঁহার উপরে আঘাত পড়িল। আর লোকে দুষ্টদের সহিত তাঁহার কবর ঠিক করিল, এবং মৃত্যুতে তিনি ধনবানের সঙ্গী হইলেন, যদিও তিনি জুলুম করেন নাই, আর তাঁহার মুখে ছল ছিল না। তথাপি তাঁহাকে চূর্ণ করিতে মাবুদেরই দিলের খায়েশ ছিল; তিনি তাঁহাকে যাতনাগ্রস্ত করিলেন, তাঁহার জান যখন দোষার্থক কুরবাণী হাসিল করিবে, তখন তিনি আপন বংশ দেখিবেন, দীর্ঘায়ূ হইবেন, এবং তাঁহার হাতে মাবুদের মনোরথ সিদ্ধ হইবে;

তিনি আপন জানের মেহনতের ফল দেখিবেন, তৃপ্ত হইবেন; আমার দ্বীনদার বান্দা তাঁহার জ্ঞান দিয়া অনেককে দ্বীনদার করিবেন, এবং তিনিই তাহাদের অপরাধ সকল বহন করিবেন।

এই জন্য আমি মহানদিগের মধ্যে তাঁহাকে অংশ দিব, তিনি পরাক্রমীদের সহিত লুট বিভাগ করিবেন, কারণ তিনি মৃত্যুর জন্য আপন জান ঢালিয়া দিলেন, তিনি অধর্মীদের সঙ্গে গণ্য হইলেন; আর তিনিই অনেকের গোনাহের বোঝা তুলিয়া লইয়াছেন, এবং অধর্মীদের জন্য সাফায়াত করিতেছেন।”

কিতাবুল মোকাদ্দস, ইশাইয়া ৫৩:৪-১২

ঈসা নিজেও অনুধাবন করতে পেরেছিলেন যে, এ ভবিষ্যদ্বানী তাঁর ব্যক্তিত্বেই পূর্ণতা লাভ করবে, কারণ তিনিই ছিলেন ভবিষ্যদ্বানীতে উল্লিখিত মাবুদের বান্দা।

সে কারণেই যখন তিনি এই মাত্রার দুঃখভোগের মুখোমুখি, তখন যে সব সৈনিকেরা তাঁকে গ্রেফতার করতে যাচ্ছিল তাঁর সহযোগি শিষ্য তাদেরকে হত্যার হুমকি দিলে পর ঈসা শিষ্যকে আদেশ করেছিলেন:

“তোমার তলোয়ার পুনরায় জায়গা মত রাখ, কেননা যে সকল লোক তলোয়ার ধারন করে তাহারা তলোয়ার দ্বারা হালাক হইবে। আর তুমি কি মনে কর যে, আমি আমার পিতার কাছে আরজ করিলে তিনি এখনই আমার জন্য বারোটি ফৌজ অপেক্ষা অধিক ফেরেশতা পাঠাইয়া দিবেন না? কিন্তু তাহা করিলে কেমন করিয়া কিতাবের এই কালাম সকল সফল হইবে যে, এরূপ হওয়া আবশ্যক?”

ইঞ্জিল শরীফ, মথি ২৬:৫২-৫৪

তিনি তৌরাৎ লঙ্ঘন করে গোনাহ্ করার কারণে ইহুদি যাজকত্বের ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ অধিকারিকভাবে ঈসাকে রোমীয় গভর্ণরের কাছে সোপর্দ করে নি। আল্লাহ্-নিন্দার দোষে তিনি বিচারিত হয়েছিলেন ইহুদি ধর্মীয় কর্তৃপক্ষ, তথা ইমামদের দ্বারা, কারণ তিনি তাদের সাক্ষাতে নিজেকে ইবনুল্লাহ্, নাজাতদাতা বলে স্বীকার করেছিলেন।

আমাদের ও মসীহের প্রত্যেক অনুসারীকে সলীবের প্রতিকৃতি একথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া উচিত যে, ঈসা সলীবে দুঃখভোগ করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন আমাদেরকে পাপের ক্ষমতা থেকে রক্ষা করার কোরবাণী রূপে, যেন আমরা চিরকাল বেহেশতে ঢোকার জন্য অধিকার ও রূহ লাভ করি।

ঈসার বেহেশতে আরোহন (মিরাজ)

(জেরুশালেম) নগরীর বাইরে বেথানীর নিকটে ঈসার এগার জন শিষ্য ঈসার বেহেশতে আরোহন (মিরাজ) প্রত্যক্ষ করেছিলেন (লূক ২৪:৫০)। ঈসার বেহেশতে আরোহন (মিরাজ) সম্পর্কে কোরানের কোন আপত্তি বা বিরোধিতা নেই। এমন কি, তা কোরান দ্বারা সমর্থিত, কারণ সূরাহ্ আল-ইমরান,৫৫ তে বলা হয়েছে:

إِذْ قَالَ اللّهُ يَا عِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ

“….হে ঈসা ! আমি তোমার মৃত্যু ঘটাইব এবং তোমাকে নিজের কাছে উঠাইয়া লইব…।”

সূরাহ্ আল-ইমরান ৫৫

ঈসার বেহেশতে আরোহনে দুটি বিষয় আছে যা লক্ষ্য করা উচিত:

  1. সাহাবীদের প্রতি ঈসার চূড়ান্ত বাণী, তাঁর পুনরাগমনের আলোকপাত ছিল তাঁর সব উম্মতদের প্রতি উদ্দিষ্ট একটি আদেশ:

    • ক) তোমরা সমগ্র জগতে যাও, নাজাতের সুখবর প্রচার কর এবং লোকদের ঈসার উম্মত কর।
    • খ) ত্রিত্ব আল্লাহ্-পিতা, পুত্র ও পাক-রূহের নামে তাদের বাপ্তিষ্ম দাও (তরীকাবন্দী দাও)।
    • গ) বিশেষভাবে সুসমাচার (ইঞ্জিল) সম্বন্ধে আমি তোমাদের যেসব শিক্ষা দিয়েছি সেই সব এবং সার্বিকভাবে কিতাবুল মোকাদ্দস তাদেরকে শিক্ষা দাও।
  2. এ ছিল তাঁর সব সহাবীদের পাক-রূহের শক্তি প্রদানের ঈসার প্রতিশ্রুতি যা আমাদেরও বুঝায়, যেন, বর্তমানে আমরা যারা তাঁর সাহাবী বা অনুসারী আমরা সবাই ঈসা যে ইবনুল্লাহ্, জীবন্ত কালাম এই সাক্ষ্য বহন করি। কালের পরিসমাপ্তি পর্যন্ত চিরকাল তাঁর রূহ আমাদের সঙ্গে থাকবেন।
  3. ঈসার দ্বিতীয় আগমন (পুনরাগমন)

    জীবিত ও মৃত সকলে বিচার করতে খোদাই বিচারক হবার জন্য ঈসা দ্বিতীয়বার আসবেন (প্রেরিত ১: ১১; জাহেরী কালাম ২০:১১-১৫)।

    কালের পরিসমাপ্তিতে দ্বীনদার বিচারক হবার জন্য ঈসার আগমন সার্বিকভাবে মুসলমানদের দৃঢ়-প্রত্যয়, যেহেতু অন্যান্য হাদীসের মত নিম্নোক্ত গুলোতেও সেই ঘটনার ভবিষ্যত উক্তি রয়েছে:

    ১। আবু হুরাইরা থেকে প্রাপ্ত হাদীস বুখারীর, ২য় খন্ড ২৫৬ পৃষ্ঠায় লেখা আছে:

    كَيْفَ أَنْتُمْ إِذَأ نَزَلَ اُبْنَ مَرْيَمَ فِيكُمْ وَ إِمَامُكُمْ مِنْكُمْ

    “তোমাদের অবস্থা কি হবে, যদি মরিয়ম-পুত্র ঈসা তোমাদের ধর্মীয় নেতা ও ইমাম হবার জন্য পুনরাবতরণ করেন?”

    আবু হুরাইরা থেকে প্রাপ্ত হাদীস বুখারীর, ২য় খন্ড ২৫৬ পৃষ্ঠায়

    ২। মুসনদ ইমাম আহমদ ইবনে হানবল-এর হাদীসের ২য় খন্ডের পৃঃ ২৪০, ৪১১-তে লেখা আছে এরূপ:

    لَيُوشَكَنَّ أَنْ يَنْزِلَ فِيكُمْ آبْنَ مَرْيَمَ إِمَاماً مَهْدِياً وَ حَكَماً

    “শীঘ্রই মরিয়ম-পুত্র ঈসা প্রধান ইমাম ও দ্বীনদার বিচারক রূপে তোমাদের কাছে নেমে আসবেন।”

    মুসনদ ইমাম আহমদ ইবনে হানবল-এর হাদীসের ২য় খন্ডের পৃঃ ২৪০, ৪১১

    ৩। হযরত মুহম্মদ একবার অন্যদের প্রত্যয় উৎপন্ন করার জন্য শপথ করে বলেছিলেন যে, মরিয়ম-পুত্র ঈসা দ্বীনদার বিচারক হবার জন্য আবার আসবেন। হযরত মুহম্মদ বলেছিলেন:

    وَآللَّه لِيُنْزِلَ آبْنَ مَرْيَمَ حَكَماً عَدْلاً

    “কসম আল্লাহ্‌র, সত্য সত্যই মরিয়ম-পুত্র দ্বীনদার বিচারক রূপে অবতীর্ণ হবেন”

    হাদীস মুসলমান, ১ম খন্ড, পৃঃ৭৬

    এই হাদীসের তফসীর, কাল- সমাপ্তিতে ঈসা মসীহের দ্বিতীয় আগমন। ‘হাকামান’কথাটি এই ইঙ্গিত বহন করে যে, দ্বিতীয়বারে ঈসা মসীহ বর্তমানে ব্যবহৃত কিতাবুল মোকাদ্দস বা কোরানে প্রাপ্ত আল্লাহ্‌র বিধান (শরীয়ত) নিয়ে আসবেন না, কিন্তু একটি নতুন কিতাব ,‘জিন্দেগীর কিতাব’ সহ সব মানুষের বিচার করতে আসবেন (জাহেরী কালাম ২০: ১১-১৫)

    হাদীস আল-সহী, বুখারী-মুসলিম-এর পূর্বোক্ত আয়াতটি রোমীয় ২:১৬ পদের সঙ্গে তুলনা করা যায়:

    “যেদিন আল্লাহ্ আমার ইঞ্জিল মোতাবেক ঈসা মসীহের দ্বারা মানুষদের গোপন বিষয় সকলের বিচার করবেন।”

    ইঞ্জিল শরীফ, রোমীয় ২:১৬

    সেই কারণে ঈসাকে আমার আল্লাহ্ ও ব্যক্তিগত নাজাতদাতা হিসাবে গ্রহণ এবং দ্বীনদার বিচারক রূপে তাঁর দ্বিতীয় আগমনের প্রতীক্ষা করার পথে অন্তরায় সৃষ্টিকারী কোন প্রতিবন্ধক আর রইলো না।

    ঈসার অনুসারীদের নাজাত লাভের পক্ষে কোরান নিম্নোক্ত সাক্ষ্য বহন করেছে। খোদা ঈসাকে বলেছিলেন:

    إِذْ قَالَ اللّهُ يَا عِيسَى إِنِّي مُتَوَفِّيكَ وَرَافِعُكَ إِلَيَّ وَمُطَهِّرُكَ مِنَ الَّذِينَ كَفَرُواْ وَجَاعِلُ الَّذِينَ اتَّبَعُوكَ فَوْقَ الَّذِينَ كَفَرُواْ إِلَى يَوْمِ الْقِيَامَةِ

    “আমি তোমার মৃত্যু ঘটাইব এবং তোমাকে নিজের কাছে উঠাইয়া লইব, আর তোমার অনুসারীগণকে কিয়ামত পর্যন্ত অবিশ্বাসীদের উপর বিজয়ী রাখিব।”

    সূরাহ্ আল-ইমরান, ৫৫)

    স্পষ্টতঃই কোরান সাক্ষ্য বহন করে যে, ঈসার অনুসারীদের নাজাতের নিশ্চয়তা বিধান করা হয়েছে যার অর্থ বেহেশ্‌তে অনন্ত জীবন, যেমন ঈসা নিজেও বলেছেন:

    “সত্য সত্য, আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, যে ব্যক্তি আমার কথা শুনে, ও যিনি আমাকে পাঠাইয়াছেন, তাঁহার উপর ঈমান আনে, সে অনন্ত জিন্দেগী প্রাপ্ত হইয়াছে, এবং বিচারে আনীত হয় না, কিন্তু সে মৃত্যু হইতে জিন্দেগীতে পার হইয়া গিয়াছে।”

    ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ৫:২৪

    আমিই তরীকা, হক ও জিন্দেগী; আমা দিয়া না আসিলে কেহ পিতার নিকটে আসে না।” (ইউহোন্না ১৪:৬)

    কিতাবুল মোকাদ্দসের সত্যতা

    আমার এই সাক্ষ্যের শুরুতেই যেমন আমি বর্ণনা করেছি, প্রথম যে জিনিসটি আমাকে কিতাবুল মোকাদ্দসের সত্য অন্বেষায় প্রবর্তনা দিয়েছিল তা ছিল সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্, ৬৮ আয়াত যা প্রত্যায়ন করে যে, আল্লাহ্‌র ইচ্ছানুসারে যারা সত্যে আল্লাহ্‌র এবাদৎ করে সেই সব লোকের জন্য কিতাবুল মোকাদ্দস অভ্রান্ত কিতাব।

    কোরানে আরও অনেক আয়াত আছে যেগুলো মুসলমান প্রচারকদের দ্বারা ব্যবহৃত হয় এবং আমিও পূর্বে ব্যবহার করতাম, যেগুলোকে অজ্ঞদের কলুষিত হাত তৌরাত ও ইঞ্জিল মিথ্যায়ন ও পরিবর্তন করার প্রমাণ রূপে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে থাকে।

    সে যা-ই হোক, আমি কোরানের আয়াতগুলোর সত্যিকার অর্থ মূল কোরান থেকেই বুঝতে চেয়েছিলাম, যেভাবে আমি ইতিপূর্বে কিতাবুল মোকাদ্দস থেকেই কিতাবুল মোকাদ্দসের বিষয়-বস্তু বুঝতে চেয়েছিলাম।

    সততার সাথে আমি যাচাই করতে চেষ্টা করেছিলাম যে, কোরানের আয়াতগুলোতে কী সত্য নিহিত রয়েছে, যা আমাকে সিদ্ধান্তে (উপসংহারে) পৌছতে চালিত করেছিল।

    ১। সূরাহ্ আল-বাকারাহ্, ৭৫

    أَفَتَطْمَعُونَ أَن يُؤْمِنُواْ لَكُمْ وَقَدْ كَانَ فَرِيقٌ مِّنْهُمْ يَسْمَعُونَ كَلاَمَ اللّهِ ثُمَّ يُحَرِّفُونَهُ مِن بَعْدِ مَا عَقَلُوهُ وَهُمْ يَعْلَمُونَ

    “তোমরা কি এরূপ আশা পোষন কর যে, তাহারা তোমার কথা মান্য করিবে, এবং ইহাদের এই অবস্থা যে, ইহাদের মধ্যে এরূপ কিছু লোকও গত হইয়া গিয়াছে যে, তাহারা আল্লাহ্‌র কালাম শুনিবার জন্য তৎপর, অতঃপর উহা বুঝিবার পর তাহারা উহার কিছু পরিবর্তন করিয়া দিত এবং তাহারা এ সম্পর্কে পরিজ্ঞাত ছিল।”

    সূরাহ্ আল-বাকারাহ্ ৭৫

    সাধারনতঃ মুসলমানেরা ‘এরূপ কিছু লোকও’ উক্তিটিকে (ফারিকুন মিনহুম) কিতাবুল মোকাদ্দস বিশেষজ্ঞ (ইহুদি ও মসীহীদের) বলে ব্যাখ্যা করে থাকেন যারা আল্লাহ্ কালাম, তৌরাত ও ইঞ্জিলের বিষয়-বস্তু পরিবর্তন করেছেন।

    আমার পরীক্ষা-নীরিক্ষা অনুসারে সূরাহ্ আল-বাকারাহ্ ৭৫- এর অর্থ তা নয়। ‘এরূপ কিছু লোকও’ বলতে মুসলমানদেরই বোঝানো হয়েছে যারা ইহুদি ও মসীহীদের মধ্য থেকে উৎপন্ন হয়েছিল এবং তারপর মুহাম্মদের প্রকৃত শিক্ষা জানার পরে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছিল। কোরান তাদেরকেই কোরানের বিষয়-বস্তুর অর্থ বা ব্যাখ্যা পরিবর্তন করার দোষে অভিযুক্ত করেছে, কিতাবুল মোকাদ্দস পরিবর্তনের জন্য নয়

    একথা আয়াতটির এ উক্তি থেকে বুঝা যায় ,“তুমি”(যদিও ‘তোমরা’ অনুদিত হয়েছে পরবর্তী ‘তোমার কথা-র সঙ্গে অসঙ্গতি লক্ষ্যনীয়) “কি এরূপ আশা পোষন কর যে তাহারা তোমার কথা বিশ্বাস করিবে…?”এ বাক্যের ‘তুমি’(তোমার) স্পষ্টভাবে হযরত মুহাম্মদকে বুঝায়। কিন্তু ‘তাহারা’ (ইহুদি ও মসীহীরা) নবী রূপে হযরত মুহাম্মদকে গ্রহণ করার পর ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছিল এবং ‘তাহারা’ আল্লাহ্‌র বাণী সমূহ অর্থাৎ কোরানের অর্থ পরিবর্তন করার দোষে অভিযুক্ত হয়েছিল; পরন্তু তারা নির্বুদ্ধিতা, মিথ্যা ও অজ্ঞতা দোষে অভিযুক্ত হয়েছিল।

    কোরানের উক্ত আয়াতটি ইহুদি ও মসীহী আলেমদের বিরুদ্ধে লিখিত হয়নি এবং তারা কিতাবুল মোকাদ্দস পরিবর্তন করেছে এমন দাবী ও করে না, কিন্তু কোরানেরই বিষয়-বস্তু সম্বন্ধে একথা বলে।

    ২। সূরাহ্ আল-বাকারাহ্, ১০৬

    مَا نَنسَخْ مِنْ آيَةٍ أَوْ نُنسِهَا نَأْتِ بِخَيْرٍ مِّنْهَا أَوْ مِثْلِهَا

    “আমি (মূলে: আমরা) কোন আয়াত বাতিল করিয়া দেই কিংবা স্মরনপথ হইতে বিস্মৃত করিয়া দেই, তৎপর তাহা অপেক্ষা উত্তম কিংবা তাহারই অনুরূপ আয়াত নাজির করি ….।”

    সূরাহ্ আল-বাকারাহ্ ১০৬

    সূরাহ্ আল-বাকারাহতে উল্লিখিত ‘বাতিল করিয়া’ দেওয়া আয়াতগুলো সম্বন্ধে সাধারনতঃ মুসলমানেরা কিতাবুল মোকাদ্দসের তৌরাত- ইঞ্জিলের আয়াতকে বোঝাতে চান।

    কিন্তু একাধিক ইসলামী তফসীর থেকে দেখা যায় যে, ‘বাতিল করিয়া’ দেওয়া আয়াত বলতে কোরানের আয়াতকেই বুঝায়, কারণ ওগুলোর শরীয়ত এবং বিধিসমূহ বিলোপ করা হয়েছিল। “আল্-তাজদিদ ফিল্ ইসলাম” শীর্ষক কিতাব এ কথা বলে যে, কোরানে পাঁচ থেকে পঞ্চাশটি আয়াত রয়েছে যেগুলো বাতিল করা হয়েছে।

    অন্যান্য লোকেরা বলেন যে, ‘বাতিল করিয়া’ দেওয়া ঐ আয়াতগুলো হযরত মুহাম্মদের অলৌকিক কাজ (মাজেজা) সম্পর্কিত, কারণ খোদার অহী প্রাপ্ত নবীরূপে হযরত মুহাম্মদ তার পূর্বে আগত মূসা ও ঈসা নবীর মত অলৌকিক কাজ সাধন করার ক্ষমতা সম্পন্ন ছিলেন বলে প্রতিভাত হয়নি। তাই যারা সত্যিকার ভাবে আল্লাহ্‌র এবাদত করবে তাদের জন্য সত্যের প্রকৃত ভিত্তিস্বরূপ যে কিতাবুল মোকাদ্দস আসমানী কিতাব রূপে সেটির সত্য প্রত্যাখ্যান করার প্রমাণ হিসেবে সূরাহ্ আল-বাকারাহ্ ব্যবহার করা যায় না।

    ৩। সূরাহ্ আল্-মায়েদাহ্, ১৩

    فَبِمَا نَقْضِهِم مِّيثَاقَهُمْ لَعنَّاهُمْ وَجَعَلْنَا قُلُوبَهُمْ قَاسِيَةً يُحَرِّفُونَ الْكَلِمَ عَن مَّوَاضِعِهِ وَنَسُواْ حَظًّا مِّمَّا ذُكِّرُواْ بِهِ وَلاَ تَزَالُ تَطَّلِعُ عَلَىَ خَآئِنَةٍ مِّنْهُمْ إِلاَّ قَلِيلاً مِّنْهُمُ

    “অতঃপর উহাদেরই একরার ভঙ্গের কারণে আমি উহাদিগকে অভিসম্পাত করিয়াছি ও উহাদের অন্তঃকরণ গুলিকে শক্ত করিয়া দিয়াছি, তাহারা কালক্রমে তাহার স্থান হইতে ঘুরাইয়া দিতেছে ও উহাদিগকে যে উপদেশ প্রদত্ত হইয়াছিল, তাহা হইতে এক বিরাট অংশ ভুলিয়া বসিয়াছে; বস্তুত; অল্প সংখ্যক ছাড়া। উহাদের বিশ্বাসঘাতকতার উপর তুমি সর্বদাই খবরদার হইতেছ।”

    সূরাহ্ আল্-মায়েদাহ্ ১৩

    সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্ ১৩,-তে উক্ত ‘উহাদেরই’ শব্দের সঙ্গে মুসলমানরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে ‘ইহুদিদের/মসীহীদের’ শব্দগুলো বাক্যের মধ্যে লঘু বন্ধনীতে যোগ করে থাকেন। “… … তাহারা কালক্রমে তাহার স্থান হইতে ঘুরাইয়া দিতেছে…” উক্তিকে মুসলমানরা এরূপ ব্যাখ্যা দেন যে, কিতাবুল মোকাদ্দস অর্থাৎ তৌরাত ও ইঞ্জিলের সত্য পরিবর্তিত ও মুছে ফেলা হয়েছে।

    এই আয়াতটি ঠিক সূরাহ্ আল্-বাকারাহ্ ৭৫ আয়াতের মত। বস্তুতঃপক্ষে হযরত মুহাম্মদের জীবনকালে কিছু সংখ্যক লোকের প্রতি প্রয়োগ করা হয়েছিল যারা মূলতঃ ইহুদি ও মসীহী ছিল, কিন্তু ইসলামে মতান্তরিত হয়েছিল এবং পরবর্তিতে আবার নিজ নিজ ধর্মে ফিরে গিয়ে ইসলাম প্রত্যাখ্যান করেছিল। তাদের প্রতিশ্রুতি পরিবর্তন করে কোরানের আয়াতের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য কোরান তাদের অভিযুক্ত করেছে। হযরত মুহাম্মদের প্রকৃত শিক্ষা জানার পরে তারা ইসলামের বাণী প্রত্যাখ্যান করেছিল। সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্ ১৩, ৭-১৪ আয়াতের প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি অধ্যয়ন করা যেতে পারে !

    স্পষ্টতই, সূরাহ্ আল-মায়েদার আয়াতগুলোকেও কিতাবুল মোকাদ্দসের সত্য প্রত্যাখ্যানের জন্য ভিত্তিরূপে ব্যবহার করা যায় না।

    উপসংহার

    একই সুরে আরও আয়াত কোরানে আছে যেগুলো আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় কিতাবুল মোকাদ্দসের সত্যকে প্রত্যাখ্যান করে। ওগুলো নিরপেক্ষভাবে অধ্যয়নের পরে আমি স্বীকার করি যে, কোরানে একটিও আয়াত নেই যা দ্ব্যার্থহীনভাবে ব্যক্ত করে যে, তৌরাত ও ইঞ্জিল মৌলিক সত্য থেকে মিথ্যায়িত বা পরিবর্তিত হয়েছে।

    পরিশেষে, আমি সিদ্ধান্ত টানছি যে, সূরাহ্ আল-মায়েদাহ্, ৬৮ আল-বাকারাহ্ ,৬২ আল-সাজ্বদা-হ্,২৩ এবং অন্যান্য আরও আয়াতে কোরান যা বলে এবং যে সম্বন্ধে আমি পূর্বেই প্রকাশ করেছি, সে সব এই স্থির-নিশ্চয়তা বিধান করে যে, আল্লাহ্‌র ইচ্ছানুক্রমে যারা আল্লাহ্‌র এবাদত করতে আকাঙ্খী তাদের প্রত্যেকের জন্য তৌরাত ও ইঞ্জিল অভ্রান্ত সত্য।

    পরিবেশের প্রভাবের বিরুদ্ধে আমার সংগ্রাম

    যদিও আমি সত্য সম্বন্ধে সুদৃঢ় ও প্রত্যয়যুক্ত হয়েছিলাম এবং ঈসা মসীহ্ কে আমার ব্যক্তিগত নাজাতদাতা বলে গ্রহণ করতে প্রস্তুত ছিলাম, তথাচ আমি বিধিসম্মতভাবে মসীহীয়াতে দীক্ষিত হই নি, কারণ পরিবেশের প্রভাব আমার অন্তরায় হয়েছিল। ভীতি ও দুর্ভাবনা বারংবার আমাকে পেয়ে বসত।

    আমার অভিজ্ঞতা প্রতীয়মান করে যে, এমন অনেক লোক আছেন যারা ঈসাকে ব্যক্তিগত নাজাতদাতা রূপে গ্রহণ করার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকেন, কিন্তু তারা পরিবেশের প্রভাবের সাথে উছোট খান, সম্ভবতঃ এ কারণ যে, তারা পিতামাতার বিরোধীতা করতে অনিচ্ছুক বা ভীত। কখনও কখনও তারা ভয় পান, তারা মসীহী হলে তাদের উর্ধতন কর্মকর্তা হয়তো তাদের চাকুরীচ্যুত করবেন। এমন একজন বিশ্বাসী ছিলেন যার ভাবী-বধুর সঙ্গে সংঘাত বেধেছিল, কারণ তিনি তাকে সহ মসীহী হতে চেয়েছিলেন। অন্যান্য আরও অন্তরায় আছে যেগুলো লোকদেরকে তাদের হৃদয়ে ঈসাকে পূর্ণভাবে রাজত্ব করতে দিতে বিঘিœত করে।

    মথি ১০: ৩৪-৩৬ পদে লিখিত ঈসার সতর্কবাণীতে পরিবেশের ভীতিপূর্ণ প্রভাব নির্দেশিত হয়েছে। যারা মসীহকে অনুসরণ করতে ইচ্ছা করে তারা যেসব দুঃখভোগের সম্মুখিন হবে তিনি তার বর্ণনা দিয়েছেন: সে তার পিতা মাতা দ্বারা ঘৃণিত হতে পারে; তার পারিবারিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হতে পারে; তাঁর নিজ জীবনের উপরেও ঝুকি আসতে পারে। যাহোক, যারা ঈসাকে প্রভু হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তাদের হৃদয়ে রাজত্ব করতে দেয় তাদের জীবনে এরূপ উদ্বেগ বেশীদিন থাকে না। প্রতিটি দুর্ভাবনা আল্লাহ্‌র সহায়তায় বিজিত হয়। আমি নিজেও এরূপ পারিপার্শিক চাপের অভিজ্ঞতা লাভ করেছি। তবুও মাবুদ সব সময়ই উদ্ধারের একটি পথ খুলে দিয়েছিলেন।

    ১৯৬১-১৯৬৪ সন পর্যন্ত আমি দ্বৈত ধর্মীয় কর্তব্যাদি সম্পাদন করছিলাম। ইসলাম অনুসারে আমি মোনাজাত করতাম (নামাজ আদায় করতাম) এবং প্রতি শুক্রবারে মসজিদে যেতাম। আবার প্রতি শনি ও রবিবারে গীর্জাতেও যেতাম। আমি একটি এ্যাড্ভেন্টিষ্ট জামাতে (মন্ডলীতে) এবাদত করতাম। দৃঢ় প্রত্যয়ের কারণে তখন আমি জামাতে যেতাম না। তার চাইতে সত্য পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পরীক্ষার জন্যই যেতাম। মাঝে মাঝে আমি মসীহী নয় এমন লোকদের লেখা বর্ণনা পড়েছিলাম যাতে বলা হয়েছে যে, গীর্জাতে লোকেরা মূর্তি ও ছবির মত জিনিসের পুতুল-পূজা করে। ঐ কালের রবিবার গুলোতে আমি তাই পালাক্রমে জাকার্তার চারিপাশের গীর্জাতে পরিদর্শনে যেতাম। এমন কি, আমি একই রবিবারে একাধিক গীর্জায় যেতাম মূর্তি অথবা ছবির সামনে পুতুল-পূজারী আছে কি না তা খুঁজে বের করার জন্য।

    পরিশেষে, আমি একটি সিদ্ধান্ত টানতে ও প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, আমার সন্দেহ ছিল অপ্রতিষ্ঠিত। যত গীর্জাতে আমি গিয়েছি কোথাও আমি কোন প্রতিমাপূজক দেখতে পায়নি।

    ১৯৬৪ সন থেকে বাস্তবিকই আমার অন্তর আল্লাহ্‌র রূহ্, পাক-রূহ্ বা সত্যের রূহ দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। সেই সময় থেকে ঈসাকে আমার নাজাতদাতা রূপে সর্বান্তঃকরণে গ্রহণ করবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তবুও একটি দুর্বলতা তখনও ছিল। আমি প্রকাশ্যে আমার প্রত্যয় ব্যক্ত করতে সাহস পাই নি। তখনও আমি আমার মসীহী ঈমান গোপন করে রেখেছিলাম। ইন্দোনেশিয়ার কুইটাং-এর মসীহী জামাতে গিয়ে প্রথমবারের মত আমি গোপনে বাপ্তিষ্ম গ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়েছিলাম, কারণ আমার পরিবার-পরিজন বা অন্যেরা, এমন কি, আমার স্ত্রী জানুক তা আমি চাই নি। আমি জানতাম না সেই মসীহী জামাতের দায়িত্বে কে ছিলেন, তবুও আমার বিশেষ অনুরোধ প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল, কারণ কাউকেই গোপনে বাপ্তিষ্ম দেওয়া হত না।

    কয়েক সপ্তাহ্ পরে মনে একই উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিনেগারা-র বেথেল চার্চের (জামাতের) ইমাম জে, সেপুলীট এর সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়েছিলাম। তিনি তক্ষুনি আমাকে এই শর্তে বাপ্তিষ্ম দিতে প্রস্তুত ছিলেন যে, আমি আমার প্রতিবেশী দু-তিন জন মসীহীকে নিয়ে আসব যারা আমাকে আত্মিক জীবনে পথ-নির্দেশনা দিবেন, যেন আমি মসীহীরূপে জীবন যাপন করি।

    আমি শর্তটি মেনে নিতে পারিনি, কারণ তখনও আমি নিজেকে প্রকাশ্যভাবে মসীহী বলে ঘোষনা দিতে অসমর্থ ছিলাম। এমনটি হয়েছিল পরিবেশের, বিশেষতঃ আমার নিজ পরিবার-পরিজনের প্রভাব হেতু। আমি ভীত ছিলাম যে, আমার বাড়িতে বিরাট এক গোলমাল দেখা দিবে। আমি আমার স্ত্রীকে আমার সঙ্গে গীর্জাতে যেতে বলতে এই ভয়ে ভীত ছিলাম যে, সে হয়তো প্রতিশোধ স্বরূপ আমাকে কোন মুসলমান কাজীর কাছে তালাকের জন্য যেতে বলবে। তালাকের প্রক্রিয়ায় সম্মুখিন হতে আমি ভীতিপূর্ণ ছিলাম। সে কারণে আমি কেবল গোপনে ঈসা মসীহকে গ্রহণ করতে চেয়েছিলাম।

    তথাচ আমার অন্তর অনিশ্চিত রইল না।

    ঈসা মসীহকে গ্রহণ করা সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ ছিল না।

    এজন্য আমি আর দ্বৈত ধর্মীয় এবাদত সম্পন্ন করতাম না। আমি শুধুমাত্র গীর্জাতেই যেতাম। তবুও আমার পরিবার সম্পর্কে কিছু ভীতি ও উদ্বেগ নাছোড়বান্দার মত লেগেই ছিল। এর ওপরে বিজয়ের পথ আমার জানা ছিল না। আমার ব্যাপার নিয়ে কারো কাছে উপদেশের জন্যও আমি যাই নি। সেই সময়ে আমি আমার অন্তর্দ্বন্দ সূক্ষ¥ভাবে অনুভব করেছিলাম।

    যাহোক, আল্লাহ্ তাঁর নিরূপিত সময়ে আমাকে আমার অন্তর্দ্বন্দের ওপরে বিজয় নিতে সাহায্য করেছিলেন। এর আগ পর্যন্ত আমি ধরে নিয়েছিলাম যে, যদি ইসলাম থেকে মসীহীয়াতে পরিবর্তিত হওয়ার কথা আমি আমার স্ত্রীর সাথে আলোচনা করি, তবে তা অশান্তির সৃষ্টি করবে। কিন্তু আল্লাহ্ অনুগ্রহের সঙ্গে, এমন কি, আমার স্ত্রীর মধ্য দিয়েই সত্যের দরজা খুলে দিয়েছিলেন। ঐ সময়ের মধ্যে অনেক মসীহীদের বাড়িতে উজ্জ্বল ভাবে ঝলমল করছিল বড়দিনের গাছ, আর ঐ আলো ও সৌন্দর্যের মাধ্যমে তাকে শান্তি দত্ত হয়েছিল। তা তার জন্য একটা চিহ্নস্বরূপ হয়েছিল যে, একটা মসীহী পরিবারে জীবন কেমন সুন্দর হতে পারে। বড়দিনের গান এবং মসীহীদের মনোভাবের আন্তরিকতার ঔজ্জ্বল্যের সে শান্তির পরশ অনুভব করেছিল।

    তার অনুভূতির প্রকাশের জন্য আমার স্ত্রী ও এক মেয়ে পরিবাররূপে মসীহী হওয়ার আগ্রহ সম্বন্ধে আমার কাছে বলতে এসেছিল। এ সুযোগের জন্যই তো আমি অপেক্ষা করছিলাম।

    পরের দিন ছিল বড়দিন এবং আমি দ্বিতীয়বার ইমাম জে, সেপুলীট-এর সঙ্গে দেখা করে বললাম যে, আমি এবং আমার পরিবার বাপ্তিষ্ম নিতে ও ঈসা মসীহকে গ্রহণ করতে চাই। আমার অনুরোধ তক্ষুনি মঞ্জুর করা হল এবং আমরা, অর্থাৎ, আমি, আমার স্ত্রী এবং আমাদের সাত সন্তান-সন্ততি ২৬ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন, গেরেজা বেথেল জামাতে (জি পি আই বি) ইমাম জে, সেপুলীট-এর দ্বারা বাপ্তিষ্ম গ্রহণ করলাম। এক সপ্তাহ্ পরে আমাদের ছেলে আমাদের অনুসরণ করল। সেও প্রায় গোপনে মসীহী জামাতে যোগ দিত, কারণ সে ভীত ছিল যে, আমি সত্য জেনে যাব। আমিও জামাতে যাচ্ছিলাম গোপনে, এই ভযে যে আমার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েরা সে সম্বন্ধে জেনে ফেলবে। তাই, আমার বস্তুতঃ লুকোচুরি খেলছিলাম। আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক যে, পরিণতিতে আমার পরিবারের সব সদস্য ঈসার অনুসারী হয়েছে এবং তাঁকে হৃদয়ে রাজত্ব করতে দিয়েছে।

    বহু আশির্বাদ

    ১৯৬৯ সনের ২৬ শে ডিসেম্বর আমি ও আমার পরিবার বাপ্তিষ্ম নেওয়ার পরে আমাদের গোটা পরিবার সুখ ও আনন্দময় সব পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিল। আমরা অনেক আশির্বাদ লাভ করেছিলাম যা আমাদের জীবন পরিবর্তিত করে দিয়েছিল।

    রাসূল পৌল বলেন:

    “ফলতঃ কেহ যদি মসীহে থাকে, তবে নূতন সৃষ্টি হইলো, পুরাতন বিষয় গুলি অতীত হইয়াছে, দেখ, সেগুলি নতুন হইয়া উঠিয়াছে”

    ইঞ্জিল শরীফ, ২ করিন্থীয় ৫: ১৭

    যখন কেউ ঈসাকে তার নাজাতদাতা বলে গ্রহণ করে, তখন খোদা তার জীবনে পরিবর্তন সাধন করেন। মসীহের সাদৃশ্য তার মধ্যে অঙ্কিত করা হবে। কিতাবুল মোকাদ্দস বলে যে, “আল্লাহ্ মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর সাদৃশ্যে”

    তৌরাত শরীফ, পয়দায়েশ ১:২৬,২৭

    এই নতুন প্রকৃতি থেকে উৎসারিত হয় এক নতুন আনন্দ ও মহব্বত এবং ভিন্নতর সব আকাঙ্খা। সে পূর্বে যা ভালবাসত এখন সে তা ঘৃণা করে, আর যা সে পূর্বে ঘৃণা করত এখন তা ভালবাসে। তার জীবন পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন দৃষ্টিগোচরে সুস্পষ্ট এবং চারিপাশের লোকেরা তা দেখতে পাবে। তার জীবন-যাপন পদ্ধতি পরিবর্তিত হবে এবং এসব, এমন কি, তার উচ্চারিত কথায়ও পরিবর্তন নিয়ে আসবে। কী আশ্চর্য !

    এসব পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি এবং অনুভব করেছি পরিবার রূপে আমাদের জীবন। রাগী মেজাজ অন্তর্হিত হয়েছে এবং পরিবর্তিত হয়েছে মহব্বতের মেজাজে। আমাদের আত্মিক জীবনে আমরা অনুভব করেছি শান্তি ও আনন্দ। আমাদের আর কোন সন্দেহ ছিল না। আমাদের অন্তর ছিল নিশ্চিত ও আনন্দে পূর্ণ। এমন কি, আমাদের বৈষয়িক জীবনেও আমরা প্রচুরভাবে আশর্বিাদ লাভ করেছিলাম। এই অভিজ্ঞতা আল্লাহ্‌র প্রতিজ্ঞাসমূহের সত্যতার প্রমাণ বহন করে, যেগুলো তার অনুসারীদের মধ্যে ঈসা মসীহের দ্বারা পরিপূর্ণ হয়।

    “কেহ যদি তৃষ্ণার্ত হয়, তবে আমার কাছে আসিয়া পান করুক। যে আমার উপর ঈমান আনে, কিতাবে যেমন, বলে তাহার অন্তর হইতে জিন্দা পানির নদী বইবে।”

    ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ৭:৩৭,৩৮

    “আমি আসিয়াছি, যেন তাহারা জিন্দেগী লাভ করে ও অতিরিক্ত পায়।”

    ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১০:১০

    আমাদের গোটা পারিবারিক পরিবেশে পরিবর্তন সুস্পষ্ট ছিল এবং তা ঘটেছিল এত দ্রুত যে, আমরা নিন্দার (অপবাদের) পাত্র হয়ে পড়েছিলাম। আমাদের প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনেরা ভাবছিলেন যে, মসীহী হবার পুরস্কার হিসেবে আমরা মসীহী জামাত থেকে আর্থিক সহায়তা পেয়েছিলাম। লোকেরা এ কথা বলে আমাদের উপহাস করত: “যদি তুমি রাতারাতি ধনী হতে চাও তবে মিঃ আমব্রী-র মনোভাবের অনুসরণ কর, মসীহী হও, আর তাহলে লক্ষ লক্ষ টাকা তুমি মসীহী জামাত থেকে অনুদান পাবে।”

    তারা সন্দেহ করছিলেন যে, মসীহী হবার জন্য ঘুষ হিসেবে মসীহী জামাতের দানের মাধ্যমে আমাদের জীবন আশীষযুক্ত হয়েছিল। না, আদৌ তা নয় ! মসীহকে গ্রহণ করার জন্য বাধ্য করার উদ্দেশ্যে কারও কাছ থেকে বা মসীহী জামাতের কাছ থেকে আমরা কখনও কোন আর্থিক সাহায্য পাই নি। আমরা কোন অর্থ বা সামগ্রী পাই নি, কোন চাকুরীর প্রতিশ্রুতিও নয়, এক পয়সাও নয়। বস্তুতঃপক্ষে সে সময়ে আমাদের আশীষযুক্ত জীবন ছিল একমাত্র খোদার বদান্যতার মাধ্যমে। এটি আল্লাহ্‌র একটি স্থায়ী প্রতিজ্ঞা যে, যেসব লোক বিশ্বাস করে তারা পর্যাপ্তরূপে আশীষযুক্ত হবে।

    মসীহী রূপে আমাদের নিষ্ক্রিয় বছর গুলো

    ১৯৭০-৭২ সন পর্যন্ত আমি ছিলাম একজন নিষ্ক্রিয় মসীহী। আমি আমার ব্যবসায়িক তদারকীতে এবং পরিবার-পরিজনদের আর্থিক ব্যায় নির্বাহে ব্যস্ত থাকতাম। আমি কেবলমাত্র রবিবারে জামাতের এবাদতে উপস্থিত হতাম এবং অবসর সময়ে কিতাবুল মোকাদ্দস পড়তাম। এমন মনোভাবের জন্য আল্লাহ্ আমাকে দোষী সাব্যস্ত করেছেন। আমি স্পষ্ট অনুভব করছিলাম যে, সেই সময়ে আল্লাহ্ আমাকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন: “যদি তুমি একজন মসীহী হতে চাও, তবে এমন নিষ্ক্রিয় মনোভাব যথেষ্ট নয়। তোমার জীবন যেসব আশীর্বাদে খোদা পূর্ণ করেছেন তা ভোগ করে তোমার জন্য অলস ভাবে বসে থাকা উপযুক্ত নয়। মসীহরে একজন প্রকৃষ্ট উম্মত হিসেবে তুমি অবশ্যই উঠে দাড়াবে এবং যেমন, তিনি মথি ২৮: ১৯-২০ পদে আদেশ করেছেন, সেই মত মসীহের সুখবর বলে সুস্পষ্ট সাক্ষ্য দিবে।”

    কিভাবে আমি খোলাখুলি সাক্ষ্য দিতে এবং সহজভাবে সুখবর বলতে আরম্ভ করতে পারতাম। প্রকৃত পক্ষে, আমি তেমন করতে ইচ্ছুক ছিলাম, তবুও আমি জানতাম না কিভাবে তা আরম্ভ করতে হয়। এ কারণে, খোদা আবারও পথ খুলে দিয়েছিলেন এবং এভাবে তিনি তা করেছিলেন

    একদিন আমার ঘনিষ্টতম বন্ধু বান্জার্মাসিন থেকে আমাদের সঙ্গে রাত কাটানোর জন্য এসেছিল। প্রকৃত বন্ধুর কথার পূর্ণ অর্থে সে আমার বন্ধু ছিল, কারণ সুদিন বা দুর্দিনে সে আমার সঙ্গে দাড়িয়েছিল। ওলন্দাজ সৈনিকেরা যখনই গ্রেফতার করত, তখন আমরা সব সময়ই জেলখানায় বা কয়েদ-শিবিরে একে অন্যের সঙ্গে দেখা করতাম।

    সে যথারীতি আমাদের অভিনন্দন জানিয়েছিল, কারণ আমরা মসীহী হয়েছি এমন কোন চিহ্ন আমাদের ঘরে ছিল না। যখন সে বলল,“আস্-সালাম-ওয়ালাইকুম,” আমি প্রতি উত্তরে বলেছিলাম ,“ওয়ালাইকুম আস্সালাম।” আমার বন্ধুটি প্রতিবেশীদের কাছ থেকে শুনেছিল যে, আমি মসীহী হয়ে গিয়েছি। সে ঘোষণা করেছিল যে, তা সম্ভব হতে পারে না এবং এ সম্বন্ধে সে প্রতিবেশীদের প্রায় নিশ্চিত করে ফেলেছিল। সে তাদের বলেছিল:

    “শুধু জাকার্তাতেই নয়, কিন্তু বান্জার্মাসিন-এও আমি আমার বন্ধু হামরান আমব্রী-কে ভালভাবে চিনেছি। সে একজন সাধারন মুসলমান বিশ্বাসী নয়- তার ঈমানে সে বিবেকী। এ প্রদেশে সে একজন সংগ্রামরত মুসলমান যোদ্ধা (সৈনিক) বলে পরিচিত; এমন কি, সে একজন মসীহী বিরোধী, অন্যতম মুহাম্মদিয়া নেতা, একজন মুসলমান সাংবাদিক এবং ইসলাম প্রচারক রূপে মধ্যপূর্ব কালিমান্টান-এ সুপরিচিত। অধিকন্তু, ১৯৪৭ সনে আমুনটাই-তে সমগ্র ইসলামিক কংগ্রেসে হামরান আমব্রী ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। ইন্দোনেশিয়ার জাতীয় সেনাবাহিনীতে বান্জার্মাসিন-এর সেনাবহিনীর জন্য তাকে মুসলমান প্রচারক-প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছিল। সুতরাং আমি স্থির-নিশ্চিত যে, হামরান আমব্রী মসীহীয়াতের পক্ষে মুসলমান ধর্ম পরিবর্তন করতে পারে না।”

    কিন্তু আমার প্রতিবেশীরা তাকে নিশ্চিত করেছিলেন যে, কয়েক বছর যাবৎ আমার গ্রামের লোকেরা আমাকে নিয়মিত মসীহী জামাতে যেতে এবং বড়দিনের সময়ে বড়দিনের গাছ স্থাপন করতে দেখে আসছে। তারা তাকে বলেছিলেন, আরও ব্যাখ্যার জন্য যেন সে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করে।

    এ কারণে, এবার আমার বাড়িতে বেড়াতে আসা মাত্রই সে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করল যে, আমি মসীহী হয়েছি সে খবর সত্য কি না। কোন সন্দেহ বিনা আমি প্রশ্নটির উত্তর দিয়েছিলাম, “হ্যাঁ, তা নির্ভুল। আমি ও আমার গোটা পরিবার বাপ্তিষ্ম গ্রহণ করেছি।”

    আমার উত্তর শুনে সে কেঁদে ফেলেছিল। সে অত্যন্ত দুঃখিত হয়েছিল, কারণ তার কাছে গভীর পরিতাপের বিষয় এমন কিছু ঘটেছিল। কিন্তু তার করার কিছুই ছিলনা, সে বিস্ময়াহত হয়ে শুধু কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থেকেছিল। বান্জার্মাসিন-এ ফিরে এসে সে অন্যদের, বিশেষতঃ আমার ঘনিষ্ট বন্ধুদের কাছে আমার মসীহীয়াতে ধর্মান্তরিত হওয়ার কথা জানিয়েছিল ।

    এ ঘটনার খবর আমার অপর এক ঘনিষ্ট মুসলমান সাংবাদিক বন্ধু দ্বারা বান্জার্মাসিন থেকে প্রকাশিত ‘হরিয়ান উটামা’ পত্রিকাতে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিল। বড় হাতের অক্ষরে এইচ, আরশাদ মারান্ লিখেছিল:

    আন্দোলনের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের মসীহীয়াত গ্রহণ:

    ত্রিশের দশকের মুহাম্মদিয়ার একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, যিনি এক সময় ‘জিহাদ’-এর প্রধান সম্পাদক ছিলেন।

    অন্যান্যদের মধ্যে জে, এ্যান্টেমাস লিখেছিলেন:

    একজন মুহাম্মদীয় ব্যক্তিত্বের মসীহীয়াতে ধর্মান্তর:

    অত্যন্ত বিস্ময়কর সংবাদ !

    অপর একজন সাংবাদিক আর্থাম আর্থা আশা করেছিল:

    “আমরা আশা করি এ খবর সত্য নয়; স্বাধীনতার অগ্রদূত (প্রবক্তা) হামরান আমব্রীর ঈমান সম্বন্ধে এখনও সন্দেহ আছে।”

    বান্জার্মাসিন-এর মুসলমানরাও এ উত্তেজনা সৃষ্টিকারী সংবদের পক্ষপাত-দুষ্ট প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল: “সাম্প্রতীক অর্থনৈতিক সমস্যাদি কোন ব্যক্তিকে নিজ ধর্ম পরিবর্তনে প্রবৃত্ত করতে পারে।” এ মুসলমান ব্যক্তিটির নাম দেয়া হয়নি।

    এমন কি, এ্যান্টাসারী-র মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় আই, এ আই, এন, থেকেও মসীহীয়াতে আমার ধর্মান্তরিত হওয়ার খবরে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছিল। ইতিমধ্যে পি এম ডাব্লিউ-র (মুহাম্মদীয়া-র), বান্জার্মাসিন-এর সম্পাদক আমি একজন বিশিষ্ট মুহাম্মদীয়া ব্যক্তিত্ব ছিলাম তা অস্বীকার করার প্রয়াস পেয়েছিলেন, কিন্তু তিনি আমাকে একজন মুসলমান যোদ্ধারূপে স্বীকার করেছিলেন।

    আমার মসীহীয়াত গ্রহণের সব সংবাদই পূর্বোল্লিখিত পত্রিকাতে প্রকাশ করা হয়েছিল আমাকে লজ্জিত করার উদ্দেশ্যে এবং পরিণতিতে তারা আশা করেছিলেন যে, আমি ইসলাম ধর্মে ফিরে আসব। কিন্তু তাদের ইচ্ছা আল্লাহ্‌র ইচ্ছা থেকে ছিল ভিন্নতর। আল্লাহ্ তাদের এরূপ উপায়ে ব্যবহার করেছিলেন আমাকে সক্রিয় করে তোলার জন্য, যেন আমি একজন তৎপর মসীহী হয়ে উঠি এবং মসীহের খোদাত্বের সত্য সম্বন্ধে সাক্ষ্য দিই।

    ঐ ভাবে প্রায় দু মাস কাল যাবৎ আমার মসীহীয়াত গ্রহণের বিষয়টি জন-সাধারনের আলোচনার বিষয়-বস্তু এবং বান্জার্মাসিন-এর ‘হরিয়ান উটামা’ পত্রিকার প্রধান শিরোনাম হয়ে দাড়িয়েছিল। আমি খবর পেয়েছিলাম যে রক্তপাত সংঘটিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। আমার কিছু সংখ্যক বন্ধু যারা খবরটিকে নিছক অপবাদ বলে মনে করত তারা সংবাদ লেখককে আক্রমণ করতে প্রস্তুত হয়েছিল। সৌভাগ্যবশতঃ আমি শিঘ্রই ‘একটি খোলা চিঠি’- আমার স্বীকারোক্তির বিবৃতি বান্জার্মাসিন-এর ‘হরিয়ান উটামা’ পত্রিকার উদ্দেশ্যে লিখে পাঠিয়েছিলাম যা নিম্নরূপ প্রকাশিত হয়েছিল:

    একটি খোলা চিঠি-

    ‘হরিয়ান উটামা’পত্রিকার পাঠকবর্গের উদ্দেশ্যে, আসসালামু ওয়ালাইকুম,

    প্রিয় মহোদয়গণ,

    এতদ্বারা আমি স্বীকার করছি, একথা সত্য যে আমি প্রোটেষ্ট্যান্ট মসীহীয়াতের সঙ্গে সংযুক্ত এবং ১৯৬৪ সন থেকে আমি ধর্মান্তরিত আছি।

    আপনার সংবাদপত্রের খবরটি ছিল আলোড়ন সৃষ্টিকারী, কারণ তা আমাকে ইসলামের একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব বা মুক্তিযোদ্ধা রূপে বর্ণিত করেছে।

    যদিও এ মূহুর্ত পর্যন্ত আমি কখনও নিজেকে ইসলামের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব রূপে বোধ করিনি এবং কখনও মুক্তিযোদ্ধা বলে ঘোষণা দেই নি, তথাচ আমার বন্ধুরা আমার প্রতি যে প্রতিবেদনশীলতা ও সপ্রশংসা মূল্যায়ন প্রদর্শন করেছেন সেসবের জন্য আমি কৃতজ্ঞ। যেমন আমার বন্ধুরা লিখেছেন, আমি যদি অতীতে যুদ্ধে যোগ দিয়ে থাকি তবে তা মাতৃভূমির একজন সন্তান হিসেবে কর্তব্যের বেশী কিছু ছিল না। সেই কারণে, অভিজ্ঞ সৈনিক অথবা স্বাধীনতার উদ্যোক্তা হিসেবে কোন খেতাব না চাওয়া এটি আমার নীতি হয়ে দাড়িয়েছে। আমি কেবল মাত্র আমার কর্তব্যই সম্পাদন করেছি।

    আমার বন্ধুরা, আপনাদের সকলের উদ্দেশ্যে ধন্যবাদ, বিশেষতঃ আরশাদ মারানের প্রতি (আমি তোমার চিঠি গ্রাহ্য করি নি) এবং জে, এ্যান্টেমাস্ এবং আর্থাম আর্থার প্রতি যারা প্রয়োজন অনুসারে লিখেছেন। আপনাদের লেখনীর মধ্যে অস্বীকার করার বা তার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল হবার কিছু নেই; শুধু মাত্র সংশোধনের এই বিষয় আছে যে, আমি স্বাধীনতার উদ্যোক্তা (প্রবক্তা) খেতাব পাওয়ার অনুরোধ র্ফম আমি কখনও সই করি নি। আর্থাম আর্থার কাছে আমি ‘ঈমানের টীকা’ পাঠিয়েছি যা প্রোটেষ্টান্ট মসীহীয়াতের সঙ্গে আমার সংযুক্ত থাকার ভিত্তি হয়ে উঠেছে।

    যা-ই ঘটুক না কেন, বন্ধুরা বন্ধুই থাকে এবং উত্তম বন্ধুত্ব ছিন্ন হতে পারে না।

    আজ এ পর্যন্তই এবং সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে ধন্যবাদ।

    জাকার্তা, ৬ই মে, ১৯৭২ আপনাদের বিশ্বস্ত,

    হাম্রান আম্ব্রী

    আমার সক্রিয় সাক্ষ্যদানকারী মসীহী জীবনের সূচনা

    উপরোক্ত ‘খোলা চিঠি’ প্রকাশিত হবার পরে বানজার্মাসিন এবং হুলু সুনগাই-স্থিত আমার বন্ধুদের কাছ থেকে কোরানের আয়াতের সতর্কবাণী ও উপদেশ সহযোগে দুঃখের সুরবাহী অনেক চিঠি এসেছিল। এমন কিছু চিঠিও ছিল যাতে কি সব ঘটনা আমাকে মসীহের প্রতি (মসীহীয়াতে) ধর্মান্তরিত হওয়ার দিকে চালিত করেছিল তা জানতে চাওয়া হয়েছিল।

    এগুলো ছিল আমার জন্য উঠে দাঁড়িয়ে স্পষ্টভাবে আমার সাক্ষ্য দেওয়ার প্রারম্ভিক কারণ। শুরুতে আমি টাইপরাইটারে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেক চিঠির উত্তর দিতাম। এসব চিঠি ঈমানের টাকা-র ব্যাখ্যা রূপে উন্নীত হয়েছিল ষ্টেন্সিলে।

    আরও উন্নীত ও বর্ণিত হলে পর আমাকে ‘আল্লাহ’ ঈসা ও পাক-রূহ শীর্ষে একটি প্রবন্ধ হস্ত-চালিত ছাপাখানায় প্রকাশ করা হয়েছিল। পরবর্তী প্রকাশনা ‘মসীহ্-তত্ব ও আল্লাহ্‌র একত্বের মতবাদ’ শেষ হয়েছিল ১৯৭৩ সনে। পরিণতিতে প্রশ্ন ও সহানুভূতির আকারে আরও চিঠি পেতে থাকলাম; তাছাড়া সত্যের অন্বেষায় আলোচনার আকারেও কিছু চিঠি আসত।

    অধিকন্তু, জাভাতে প্রকাশিত কয়েকটি ইসলামী সাময়িকী আমার ঈমানের ওপরে আক্রমন শানছিল। ঐসব নিবন্ধের কারণে আরও অধিক হারে চিঠি আমার কাছে আসছিল। যেসব চিঠি আমি পেতাম তা আসত ইন্দোনেশিয়ার সব অংশ থেকে- বান্জার্মাসিন, পশ্চিম জাভার মুসলমান এলাকা, মধ্য জাভা ও পূর্ব জাভা, সুমাত্রা (পালেমব্যাঙ্গ, মেডান, পাডাং, আকেহ্) ইত্যাদির সব এলাকা থেকে। কিছু সংখ্যক এসেছিল বিদেশ (মিসর ও মালয়েশিয়া) থেকে। এ ছিল আল্লাহ্‌র পথ-নির্দেশনা, যেজন্য আমাকে দাঁড়াতে এবং স্বাভাবিকভাবে আমার সাক্ষ্য দিতে হয়েছিল।

    ওসব যোগাযোগের কয়েকটি ছ’মাসেরও অধিককাল পর্যন্ত টিকে ছিল। মসীহীয়াত সম্বন্ধে বিধি সমস্যা নিয়ে আলোচনা হত। কিছু সংখ্যক প্রশ্ন ও উত্তর আমি পুস্তক রূপে সংকলন করেছি এবং সত্যের ব্যবহারিক দলিল রূপে প্রকাশ করেছি:

    1. এইচ, এম, ইউসুফ শোয়েব সাহেবের সঙ্গে পত্র-যেগাযোগ, যিনি একজন মুসলমান সাংবাদিক (জাকার্তার কিবলাত সাময়িকীর সম্পাদকের সহকারী)।
    2. সামুদি সাহেবের সঙ্গে পত্র-যোগাযোগ (যিনি ছিলেন সালাটিগা-য় ইসলাম ধর্মের শিক্ষক)।
    3. ইমাম মূসা প্রয়োসিসওয়াইও-র সঙ্গে পত্রালাপ, (যিনি ছিলেন জাকার্তার ষ্টুডি ইসলাম সাময়িকীর সম্পাদক)।
    4. ওয়াহ্ইওনো হাদী সাহেবের সঙ্গে পত্রালাপ (দারূল কুতুবিল ইসলামিয়া, জাকার্তা)।
    5. আলী ইয়াকুব মাটন্ডাং-এর সঙ্গে পত্র-যোগাযোগ (একজন মুসলমান ছাত্র, কায়রো, মিশর)।
    6. এ, হাসান তৌ-এর সঙ্গে পত্র-যোগাযোগ (যিনি ছিলেন স্পীকার, আহম্মদীয়া আসলামী জামাত, ডেন্পাসার, বালী)।
    7. আসিফ ফাহ্মী ও অন্যান্যদের সঙ্গে পত্রালাপ (একদল মুসলমান ছাত্র, সুরাবাইয়া)।
    8. এম, এ, ফ্যাড্লী-র সঙ্গে পত্র-যোগাযোগ (যিনি ছিলেন মসজিদ আগুং, কেন্দ্রীয় মসজিদ, কিমহি, বান্ডুং-এর প্রধান)।

    ১৯৭৯ সন পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ার সব অংশের মুসলমান পটভূমির ভাইদের হাজার হাজার চিঠির উত্তর দিয়েছে। প্রতিদিন আগত চিঠিগুলো আমাকে উৎসাহিত করত। ওগুলো একথা নির্দেশ করত যে, পত্র-লেখকেরা সত্যের অনুসন্ধান করছিল, এবং আমার ব্যাখ্যা দেওয়ার পরে, তারা পরিতৃপ্তি অনুভব করত। আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক! এমন কি, অনেকে ছিল যারা ব্যক্তিগতভাবে আমার সঙ্গে সাক্ষাতও করেছিল।

    যেহেতু আমি দেখলাম যে, কত অধিক মনযোগ আমার ধর্মান্তরিত হওয়ার এবং সত্য অন্বেষার প্রতি দেওয়া হচ্ছিল, সেই হেতু আমি মসীহী ঈমান ও সত্য সম্বন্ধে দর্শনার্থীদের পরামর্শ দেওয়ার জন্য মঙ্গল, বৃহস্পতি ও শনিবারে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিশেষ সময়ের বন্দোবস্ত করেছিলাম।

    এ সবের জন্য আল্লাহ্‌র শুক্রিয়া হোক। কিতাবুল মোকাদ্দাসের সত্য এবং ঈসা মসীহের খোদাত্ব ব্যাখ্যা করার মাধ্যম হিসেবে তিনি আমাকে ব্যবহার করেছেন, বিশেষতঃ আমার মুসলমান ভাইদের কাছে, যেন তারা মসীহএক সঠিকভাবে অনুধাবন করতে সক্ষম হয়।

    এসব প্রশ্নের ও প্রত্যাখ্যানের উত্তর দেওয়া থেকে আমি অনুভব করেছিলাম যে, কিতাবুল মোকাদ্দাস ও মসীহের খোদাত্ব সম্পর্কিত সাম্প্রাতিক ভুল বুঝাবুঝি ও ব্যাখ্যাদি সত্য স্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়ে সত্বর সংশোধন করা উচিত।

    বাইরে খেদমতের শুরু

    ১৯৭৩ সন থেকে ১৯৭৮-র ফেব্রুয়ারী মাস পর্যন্ত কেবলমাত্র আমার ডেস্ক্ থেকে মসীহীয়াত সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন কারী পত্র সমূহের উত্তর দিয়ে সাক্ষ্য বহন করেছিলাম। সত্যের দলিল রূপে আমি ওসব উত্তর প্রকাশও করেছিলাম।

    কিন্তু ১৯৭৮-র ফেব্রুয়ারীতে আমি মোনাজাত করেছিলাম: “হে আল্লাহ্ ! দয়া করে এই আন্দোলনের একটি নতুন ক্ষেত্র দাও, কারণ আমার পত্র-যোগাযোগের ক্ষেত্র প্রায় পরিত্যক্ত হয়েছে।” এরূপে মোনাজাত করে আমি সরাসরি আমার অন্তরে একটি উত্তর পেলাম যে, পরবর্তী দিনে আমার ঘরের বাইরে যাওয়া উচিৎ এবং সেখান থেকে আমি আমার নতুন ক্ষেত্র খুঁজে পাব।

    পরদিন খুব ভোরে, কোন্ পথে যাব তা না জেনেও আমি আমার ঘর থেকে বের হলাম। যখন আমি প্রধান সড়কে পৌছলাম, তখন আমি খোদাকে অনুরোধ করলাম, যেন যেখানে আমার যাওয়া উচিৎ সেই পথে তিনি আমার কদম পরিচালিত করেন। আমার অন্তর আমাকে বলল- আমার উত্তর দিকে যাওয়া উচিৎ। যেহেতু আমি আমার গন্তব্যস্থল নির্দিষ্টভাবে জানতাম না, সেই হেতু আমি কোন যান বা বাস না নিয়ে পায়ে হেঁটে চললাম। ইন্দোনেশিয়ার কিতাবুল মোকাদ্দস ইন্ষ্টিটিউটের সামনে যখন আমি পৌছলাম, তখন মাবুদ আমাকে ঐ অফিসে ঢুকতে বললেন। আমি সন্দিগ্ধ ছিলাম, কারণ আমি কাউকেই ভালমত চিনতাম না। এক সময় সেখানে ছিলেন হযরত বি প্রবোউইনটো, তাকে সালাটিগা-তে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। এ কারণে, যদি আমি অফিসে ঢুকি কার কাছে আমি কথা বলব, আর কি বলা আমার সমীচীন হবে? কিন্তু আমার অন্তর আমাকে এগিয়ে যাওয়ার প্রবর্তনা দেওয়া হেতু আমি অফিসে ঢুকলাম।

    অন্যতম বন্ধু আমাকে ভেতরে ঢুকতে দেখে চিনতে পেরে তক্ষুনি আমাকে সম্বোধন করে বললেন, “মিঃ আম্ব্রী! খোদার প্রশংসা হোক, কি আশ্চর্য পথ-নির্দেশনা ! জনৈক ব্যক্তি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান।” শীঘ্রই আমরা আলাপ করতে সক্ষম হলাম। পরে আমি হযরত এম, কে, জাক্রাটমাড্জার সঙ্গে দেখা করেছিলাম যিনি আমার সম্বন্ধে শুনেছিলেন এবং আমার সঙ্গে দেখাও করতে চেয়েছিলেন। এ আলাপ থেকে আমি আশীর্বাদ পেয়েছিলাম। তারা আমার কিছু বই কিনতে চেয়েছিলেন।

    আমি বিস্মত হৃদয়ে ভাবছিলাম, এটিই আমার নতুন ক্ষেত্র কি না, কিন্তু আমি মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম যে না, এটি নয়। আমি বাড়িতে ফিরতে চাইলাম, কিন্তু আমার অন্তর আরও উত্তরে আমার হাঁটা চালিয়ে যেতে প্রবর্তনা দিচ্ছিল। আমি হেঁটে চললাম, যতক্ষণ না ক্রামাট ৫-এর সম্মুখে উপস্থিত হলাম। আমার অন্তর আমাকে ভেতরে গিয়ে ডঃ আইস্ এম, ও, পোরমেস্-এর সঙ্গে দেখা করতে বলছিল। আমি অবাক হয়ে ভাবছিলাম যে, কিভাবে হযরত পোরমেস্-এর সঙ্গে আমার কথা বলা সম্ভব, কারণ আমি তার সঙ্গে ভালমত পরিচিত ছিলাম না এবং আমরা তার সংস্থার অন্তর্ভক্তও ছিলাম না। একে অপরের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়েছিল, কিন্তু সে তো তিন বছর আগে। কিন্তু যেহেতু পাক-রূহ্ আমার কাছে কথা বলছিলেন, আমি ক্রামাট ৫-এর দিকে ফিরলাম। সেই ঘরে ঢোকার আগে আমি সন্ধিগ্ধ ছিলাম। পূর্বে এ ঘরটি আল্লাহ্‌র খাদেমদের দ্বারা পরিপূর্ণ ছিল, কিন্তু তখন যেন নীরব ঠেকছিল। সম্ভবতঃ হযরত পোরমেস্ চলে গেছেন, তাই। যাহোক, হযরত পোরমেস্ আমাকে দেখতে পেয়েছিলেন, কারণ তিনি সামনের দরজাতে আমাকে অভ্যর্থনা জানাতে চলে এসেছিলেন এবং বলেছিলেন: “এই যে মিঃ আম্ব্রী ! বাস্তবিকই গতকাল থেকে আপনার কথাই ভেবেছি এবং আপনার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছি, কারণ একটা বিষয় আমি আপনার সঙ্গে আলাপ করতে চই। আমি আপনাকে আশা করছি-সম্ভবতঃ আমরা একসঙ্গে কাজ করতে পারি।” আমি বিস্ময়ে কতকটা হতবাক হয়ে গেলাম। হযরত পোরমেস্ কি করে আমাকে মনে রাখলেন? আমরা কখনই খুব সুপরিচিত হয়ে উঠিনি। কিন্তু আগের দিনের প্রার্থনা আমার স্মরণ হল। সম্ভবতঃ পাক-রূহ এখানেই নতুন ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পরিচালিত করেছেন।

    এ আলোচনায় অনেক কিছুই ছিল যা আমার হৃদয় ও অনুভূতিকে সঞ্জীবিত করেছিল। হযরত আইস পোরমেস্ আশা করছিলেন, আমি আল্লাহ্‌র খেদমতে তার সঙ্গে কাজ করব। আরও, তিনি আমার স্বাস্থের তত্ত্বাবধান করেছিলেন যা তখন ভাল যাচ্ছিল না।

    পরিশেষে, হযরত পোরমেস্ আমাকে তার একটি চিঠি সোলোর ষ্ট্রীট-৪-এ বুমাই আসিহ্-র ডিরেক্টর এম, কে, সিনাগা-র কাছে নিয়ে যেতে বললেন। আমি চিঠিটা নিয়ে ব্যক্তিগত ভাবে হস্তান্তর করেছিলাম। কে, এম, সিনাগার ঘর থেকে আমাকে অনুরোধ করা হয়েছিল, যেন শুক্রবার সকালে আমি হোটেল ইন্দোনেশিয়াতে যাই, কারণ, তিনি যেমন জানিয়েছিলেন, কয়েকজন প্রচারক আমার সঙ্গে পরিচিত হতে চাচ্ছিলেন।

    ১৯৭৮ সনের ২ শে ফেব্রুয়ারী, শুক্রবার সকালে আমি হোটেল ইন্দোনেশিয়াতে গেলাম জাকার্তার মসীহী ব্যবসায়ীদের আয়োজিত একটা মোনাজাত সম্মেলনে যা “সি,বি,এম,সি” নামে পরিচিত।

    ভূমিকা থেকে মনে হল, কিছু সংখ্যক লোক আমার নাম জানতেন এবং আমার সঙ্গে সেদিন ব্যক্তিগত ভাবে দেখা করতে ইচ্ছুক ছিলেন। সেই সময় থেকে আমি অনেক গৃহ-সম্মেলনে খেদমত করতে আনন্ত্রিত হয়েছি যা ক্রমশঃ জামাতে এবাদতের সহযোগীতার ক্ষেত্রে উন্নিত হয়েছিল। জাকার্তা ও বান্ডুং-এর চারিদিকস্থ অনেক জামাতে আমাকে সাক্ষ্য দিতে হত। এ সময়ের মধ্যে আমি জাকার্তার বাইরেও খেদমত করেছিলাম। দক্ষিন কালিমান্টান (বান্জার্মাসিন, আমুন্টাই) মধ্য কালিমান্টান (প্যালাংকারায়ো), পূর্ব জাভা (সুরাবাইয়া এবং মালাং), বান্ডুং অন্যান্য স্থানে।

    এ ছিল আমার নতুন কর্মক্ষেত্র। এতে আমি বিশ্বস্তভাবে সমস্ত সম্মেলন ও এবাদতখানার মাধ্যমে মসীহের সুখবর জানিয়ে আমার খেদমত অব্যাহত রাখব। যদিও এখন আমি আমার বাড়ির বাইরে খেদমতের নতুন ক্ষেত্র লাভ করেছি, তবু আমার পত্র-যোগাযোগ থেমে যায় নি, এমন কি, তা বরং শতগুনে বৃদ্ধি পেয়েছে। আল্লাহ্‌র প্রশংসা হোক ! এই চিঠি গুলো আমার জন্য আশীর্বাদ স্বরূপ, কারণ আমি সানন্দে বহু সত্যান্বেষীর খেদমত করতে পারছি।

    মাবুদ আমার খেদমতের ক্ষেত্র প্রচুররূপে বাড়িয়ে তুলেছিলেন

    ১৯৭৯ সনের ১৩ ই মে লিখিত আমন্ত্রণ মারফত জাকার্তার বাটংহারি ষ্ট্রীটস্থ দারূস্ সালাম মসজিদে ‘লেম্বাগা পেংগাজিয়ান ইসলাম আল-ফুরকান’-এ যোগদানকারী একদল মুসলিম যুবকের সামনে বক্তৃতা দিতে অনুরুদ্ধ হয়েছিলাম। আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ‘ঈসা মসীহের খোদাত্ব’। প্রধান তর্ক-বাগীশেরা ছিলেন ডঃ আবুনিয়ামিন রোহাম এবং ডঃ সানি আর্দি। ইসলামের শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সম্বলিত উপস্থিত লোকের সংখ্যা ছিল কমবেশ ১০০ জন। আমি একাই উত্তর দিতে এসেছিলাম। চূড়ান্ত প্রভাব ছিল উত্তম। সভা বন্ধুভাবাপন্ন ছিল এবং শেষ হয়েছিল করমর্দনের মধ্য দিয়ে।

    ১৯৭৯ সনের ২২ শে জুলাই আবার প্রশ্নোত্তরে বক্তৃতা চলেছিল আমার এবং মসজিদ উলেমা-র (মুসলিম ধর্মতাত্ত্বিক কাউন্সিল-এর) কয়েকজন ইসলামী নেতার সঙ্গে। আলোচনার বিষয় বস্তু ছিল ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহ্- ত্রিত্বে এক’। দশ ব্যক্তি তার্কিকরূপে তালিকাভুক্ত হয়েছিলেন। এদের মধ্যে ছিলেন অধ্যা. ডঃ এইচ, এম, রশীদি, ডঃ বুনাইয়ামিন রোহান, ডঃ টাগোর, ও ডঃ আসমুনি। বিতর্কের নিয়ন্ত্রক ছিলেন ডঃ র্মামানসিয়াহ্ রহমান। মুসলমান নেতা, শিক্ষক ও বুদ্ধিমান লোকবৃন্দ সম্বলিত উপস্থিত শ্রোতার সংখ্যা ছিল কমবেশ ১৫০ জন।

    ১৫ ই আগষ্টের পরে দু’মাসের মধ্যে আমি জাকার্তার বাইরে বেশ কয়েক জায়গায় পরিভ্রমনে গিয়েছিলাম পশ্চিম ও পূর্ব জাভাতে। ১লা সেপ্টেম্বর মেনাডো, উজুং প্যান্ডাং, তানাহ্ তোরাজা, পালাপো, বালিক্পাপান, বান্জার্মাসিন এবং কাপুয়াস-এ ‘ইঞ্জিল মিশন’ অভিযান পরিচালনা করেছিলাম।

    উপসংহার

    প্রত্যেক মানুষেরই জন্য নাজাত সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। এই নাজাত অর্থাৎ মুক্তি তার নিজের জন্য, মুক্তি তার পরিবারের জন্য, মুক্তি তার বিষয়-সম্পত্তির এবং অন্যান্য সব রকমের মুক্তি। এসব উদ্দেশ্য তার জীবনে সুখের জন্য শীর্ষ স্থানীয় লক্ষ্য বস্তু হয়ে থাকে।

    একজন ধর্মপ্রাণ লোকের জন্য নাজাত বা মুক্তি কেবলমাত্র জাগতিক জীবনেই সীমাবদ্ধ নয়, কিন্তু এর মধ্যে পাপের প্রভাব থেকে স্বাধীনতায় তার আত্মর মুক্তিও অন্তর্ভুক্ত। তার আত্মিক (রূহানিক) নাজাত বা মুক্তি মহব্বতের সঙ্গে ঘনিষ্টভাবে সম্পর্কযুক্ত যা বেহেশ্‌তী জীবনের ভিত্তি।

    ধরা যাক, আদম ও হাওয়া পাপে পতিত হয় নি, তবে তো মানুষ এখনও চিরন্তন জীবন যাপন করত। কিন্তু, আদম ও হাওয়া যারা আল্লাহ্‌র নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করেছিল তাদের সেই মৌলিক পাপের কারণে মানবজাতি আদম ও হাওয়ার সঙ্গে অনন্ত জীবন বহির্ভূত হয়েছে এবং এমন জীবনে পতিত হয়েছে যা ক্ষয় পায় এবং আত্মিক ও দৈহিক মৃত্যুর অভিজ্ঞতার অধীন। আদম ও হাওয়ার পাপের কারণে আত্মিক ও দৈহিক মৃত্যু সমেত ক্ষয়শীল এই জীবনে আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। আমি ও আপনি সহ দুনিয়ার সব মানুষ এর অন্তর্ভূক্ত।

    কিন্তু দয়াময় ও করুনাময় আল্লাহ্ আমাদেরকে তাঁর কাছ থেকে বিচ্ছন্ন ও মৃত থাকতে দিবেন না। সূচনাতে আদম হাওয়ার সৃষ্টির সময়ে তাদের যে জীবন ছিল তার চাইতেও বহুগুনে শ্রেষ্টতর অনন্ত জীবন আমাদের দিতে খোদা প্রতিজ্ঞা করেছেন।

    প্রথম পদক্ষেপ: বহুকাল পূর্বে খোদা তাঁর নবীদের মাধ্যমে আদেশ করেছেন যে, আমাদের অনুতপ্ত হওয়া, তাঁর কাছে ফিরে আসা, তাঁর বাধ্য হওয়া এবং মূসা ও নবীদের কিতাবসমূহের শরীয়ত (আজ্ঞাসমূহ) অনুসরণ করা উচিৎ (ইব্রানী ১:১)।

    দ্বিতীয় পদক্ষেপ: আল্লাহ্ তাঁর কালাম ঈসা মসীহে মানব-রূপ পরিগ্রহ করিয়েছিলেন, যিনি ‘জিন্দেগীর কালাম ’ এবং ‘পিতার একমাত্র পুত্র ’ (ইব্রানী ১:১; ইউহোন্না ১:১, ১৪; ১ ইউহোন্না ১:১)।

    তৃতীয় পদক্ষেপ: আসমানী পথ-নির্দেশনা প্রদান করতে ও এবং দুনিয়ার অগণিত লোককে সাহায্য করতে আল্লাহ্-পাক পাক-রূহ, আল্লাহ্ নিজ রূহ দ্বারা মানুষদের পরিচালিত করেন, যেন তারাও কিতাবুল মোকাদ্দসে লিখিত আল্লাহ্‌র কালামের বাধ্য হতে পারে। এ কারণে, যারা আসমানী বিধিসমূহ এবং খোদার আশ্চর্য প্রতিজ্ঞাসমূহ গ্রহণ করে তাদের সকলেরই জন্য আল্লাহ্ অনন্ত জীবন মঞ্জুর করেন ।

    এ কথা গুলো অনুধাবন করতে হবে:

    “কারণ আল্লাহ্ দুনিয়াকে এমন মহব্বত করিলেন যে, নিজের একজাত পুত্রকে দান করিলেন, যেন কেহ তাঁহার উপর ঈমান আনে, সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জিন্দেগী লাভ করে।”

    ইউহোন্না ৩:১৬

    “যে ঈমান আনে ও তরীকাবন্দী হয়, সে নাজাত পাইবে, কিন্তু যে অবিশ্বাস করে, তাহার দন্ডাজ্ঞা করা যাইবে”

    মার্ক ১৬:১৬

    ঈসা বলেন:

    “আমি আসিয়াছি, যেন তাহারা জীবন পায়, আর সেই জীবন যেন পরিপূর্ণ হয় ”

    ইঞ্জিল শরীফ, ইউহোন্না ১০:১০

    “দেখ, আমিই কেয়ামত পর্যন্ত প্রতিদিন তোমাদের সঙ্গে সঙ্গে আছি”

    ইঞ্জিল শরীফ, মথি ২৮:২০

    ফেরেশতাগণ ঈসার সাহাবীদের বলেছিলেন:

    “হে গালীলীয় লোকেরা তোমরা আসমানের দিকে দৃষ্টি করিয়া দাঁড়াইয়া রহিয়াছ কেন? এই যে ঈসা তোমাদের নিকট হইতে আসমানে নীত হইলেন, তাঁহাকে যেরূপে আসমানে গমন করিতে দেখিলে, সেইরূপে উনি আগমন করিবেন।”

    ইঞ্জিল শরীফ, প্রেরিত ১:১১

    এ ক্ষেত্রে ঈসা স্বয়ং বলেছিলেন:

    “আর সেই সময়ে তাহারা ইবনে আদমকে কুদরত ও মহা প্রতাপ সহকারে মেঘযোগে আসিতে দেখিবে”

    ইঞ্জিল শরীফ, লূক ২১: ২৭

    ঈসা মসীহের দ্বিতীয় আগমন সম্বন্ধে শুধু মাত্র কিতাবুল মোকাদ্দসই বলা হয়নি, কিন্তু এর সত্য মুসলমানরা সমর্থন ও বিশ্বাস করে, যেমন আমরা এ বইয়ের ৩৩ পৃষ্ঠাতে হাদীসে উক্ত মুহাম্মদের উক্তি পাঠ করি। সেখানে বিচারক রূপে ঈসার দ্বিতীয় আগমনের কথা আমরা লিখিত দেখতে পাই।

    আল্লাহ্‌র সন্তান-সন্ততিদের (বান্দাদের) জন্য চারটি প্রতিজ্ঞার গ্যারান্টি (নিশ্চয়তা) দেওয়া হয়েছে:

    1. বেহেশতে অনন্তজীবন এবং এমন এক জীবন যা আদি সৃষ্টিতে আদম ও হাওয়ার জীবনের চাইতেও গৌরবময়। অনন্ত জীবনের অধিকার এবং আসমানী নাজাত লাভের উদ্দেশ্যে লোকদের ঈসা মসীহের উপর ঈমান আনতে, তাঁর বিশ্বস্ত সাহাবী হতে এবং বাপ্তিষ্ম নিতে (তরীকাবন্দী হতে) হবে।
    2. । বেহেশ্‌ত থেকে আশীর্বাদের আকারে আত্মিকভাবে দৈহিক ভাবে এবং বৈষয়িকভাবে পরিপূর্ণতা। মসীহের অনুসারীদের কোন কিছুরই অভাব থাকবে না, কিন্তু তাঁর পূর্ণতা থেকে সব সময়ই প্রাচুর্যের অভিজ্ঞতা লাভ করবে।
    3. যারা মসীহ্ কে স্বীকার করে এবং বিশ্বস্ত অনুসারী হয়, সে যেখানেই থাকুক, তাদের প্রত্যেকজনের মধ্যে আল্লাহ্‌র রূহ বা পাক-রূহ্ কেয়ামত পর্যন্ত বসবাস করবেন।

    প্রিয় পাঠকবৃন্দ, এসব কারণে আমি এ পরামর্শ দেয়ার সুযোগ চেয়ে নিচ্ছি:

    এক্ষুনি আপনারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করুন ! প্রতিজ্ঞাত এ প্রস্তুত নাজাত গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিন। আপনার হৃদয়ে রাজত্ব করতে ঈসা মসীহকে গ্রহণ করুন, যেন আপনি আপনার নূতন জীবনে মসীহে নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ থাকতে পারেন। তাহলে আমরা একসঙ্গে আল্লাহ্‌র সঙ্গে অনন্তকাল বসবাস করতে পারব।

    এই সুযোগ অবহেলা করবেন না। আগামী দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না। যা করা উচিৎ আজই করুন। আগামী দিন বড় বেশী দেরী হয়ে যেতে পারে। অনুতাপের দরজা বন্ধ হয়ে যেতে পারে, আর তাহলে আপনি অনন্ত মনোদুঃখে জীবন যাপন করবেন এবং শাস্তি ভোগ করবেন। অনন্তকালের জন্য আসমানী নাজাতের দরজা দিয়ে প্রবেশের উদ্দশ্যে অকপট হৃদয়ে এগিয়ে আসুন এবং ঈসা মসীহকে আপনার প্রভু এবং ব্যক্তিগত নাজাতদাতা রূপে গ্রহণ করুন।


    অভীক্ষা

    (আল্লাহ্ আমার জন্য অনন্ত জীবনের ব্যবস্থা করেছেন)

    প্রিয় পাঠক,

    আপনি যদি এই আলোড়ন সৃষ্টিকারী জীবন-চরিত সযত্নে পাঠ করে থাকেন, তাহলে আপনি নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে সমর্থ হবেন। যদি আপনি ২৪-টি প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারেন, তাহলে খোদা সম্বন্ধে আরও জানতে এবং যারা তাঁর বাধ্য হয় তাদের জীবনে খোদা কি সব উপায় কাজ করেন তা আবিষ্কার করতে আপনাকে আরও উৎসাহিত করার জন্য আমরা আপনাকে পুরস্কার হিসেবে আমাদের একটি বই পাঠিয়ে দিব।

    1. কোরানের মূল বা প্রধান আয়াতটি লিখুন যেটি প্রতীয়মান করে যে, কোরানে উক্ত তৌরাত ও ইঞ্জিল এবং বর্তমান কিতাবুল মোকাদ্দসের তৌরাত ও ইঞ্জিল অভিন্ন।
    2. কোরানের আর কোন্ চারটি অংশও নির্দেশ করে যে, তৌরাত ও ইঞ্জিল আল্লাহ্‌র ইচ্ছানুরূপ সত্যস্বরূপ?
    3. মূসা ও মসীহের মধ্যে অনন্য ও অসাধারণ সাদৃশ্য গুলো কি কি?
    4. কি কি বিশেষ চিহ্ন প্রতীয়মান করে যে, দ্বিতীয় বিবরণ ১৮ অধ্যায়ে উল্লিখিত ভবিষ্যদ্বানী ঈসা মসীহকে মানবরূপী ‘আল্লাহ্‌র কালাম’ বলে নির্দেশ করে?
    5. হাম্রান আম্ব্রী কিতাবুল মোকদ্দসকে আল্লাহ্‌র সত্য-কালাম রূপে প্রত্যক্ষ করার পরও মসীহকে গ্রহণ করতে তখনও প্রস্তুত ছিলেন না। কেন?
    6. সুসমাচার (ইঞ্জিল) প্রচারক ও ঘোষকদের উত্তর ও ব্যাখ্যা সমূহ কেন তিনি গ্রহণ করতে পারেন নি?
    7. তার যে তিনটি প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল সেসব হাম্রান আম্ব্রী কিভাবে জয় করেছিলেন?
    8. কি উপায়ে আল্লাহ্ হাম্রান আম্ব্রীকে এসব প্রতিবন্ধক অতিক্রম করতে সাহায্য করেছিল?
    9. ঈসাকে ‘প্রভু’ (খোদাবন্দ) বলা হয় কেন?
    10. হাম্রান আম্ব্রী যখন মসীহী হয়েছিলেন, তখন আল্লাহ্‌র একত্ব সম্পর্কিত ঈমান কেন পরিবর্তন করা আবশ্যক হয় নি?
    11. কিভাবে মসীহীয়াতের শিক্ষা আল্লাহ্‌র একত্বের মতবাদকে বিশোধিত করে?
    12. বহু-ঈশ্বরবাদ বলতে কি বুঝায়?
    13. কেন মসীহীদের বহু-ঈশ্বরবাদী বলা যায় না?
    14. আল্লাহ্ সম্পর্কিত ত্রিত্ববাদ কেন মুসলমানদের জন্য অন্তরায়স্বরূপ?
    15. পবিত্র ত্রিত্বের ঐক্য মসীহী দৃষ্টিকোন থেকে বুঝিয়ে দিন।
    16. কিভাবে আমরা নির্দেশ করতে পারি যে, ঈসা মসীহ্ সত্যি সত্যিই সলীবে বিদ্ধ হয়েছিলেন?
    17. কিভাবে আমরা জানতে পারি যে, ঈসা মৃতদের মধ্য থেকে পুনরুত্থিত হয়েছিলেন?
    18. কি কি বিভিন্ন প্রকারের মৃত্যু থেকে আমরা উত্থিত হতে পারি?
    19. ঈসার সলীবের অর্থের সংক্ষিপ্তসার লিখুন।
    20. ইশাইয়া ৫৩:৪-১২ পাঁচবার লিখুন এবং মুখস্ত করুন।
    21. যেসব লোক তলোয়ার ধারন করে তাদের প্রতি কি ঘটবে?
    22. কোরান কি ঈসার বেহেশতে আরোহনের বিরোধীতা করে?
    23. দুনিয়াতে আবার ফিরে এলে পর ঈসা কি করবেন?
    24. কিতাবুল মোকাদ্দস মিথ্যায়িত হয়েছে একথা প্রতীয়মান করার জন্য কিভাবে কোরানের কয়েকটি আয়াত অপব্যবহার করা হয়ে থাকে?
    25. কোরানে কি এমন একটি আয়াতও আছে যা দ্ব্যার্থহীনভাবে একথা ব্যক্ত করে যে, মূল সত্য থেকে কিতাবুল মোকাদ্দস মিথ্যায়িত বা পরিবর্তিত হয়েছে?
    26. আমরা যদি ঈসাকে অনুসরণ করি, তাহলে আমাদের কি প্রকারের দুঃখভোগের সম্মুখিন হতে হবে?
    27. তাদের জীবন ঈসার হাতে তুলে দেবার পরে মিঃ হাম্রান আম্ব্রী ও তার পরিবারের জীবনে কি কি পরিবর্তন সাধিত (সংঘটিত) হয়েছিল?
    28. আল্লাহ্‌র সন্তান-সন্ততিদের জন্য কোন চারটি প্রতিজ্ঞার গ্যারান্টি (নিশ্চয়তা) দেওয়া হয়েছে?
    29. ইউহোন্না ৩: ১৬ এবং আমল (প্রেরিত) ৪:১২ উভয় পদ পাঁচবার করে লিখুন এবং ও দুটি মুখস্ত করুন।
    30. আপনি কি জীবন্ত মসীহকে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন?

    সমাপ্ত

Bengali Bijoy > Unicode Converter

bijoy-unicode-converterThere are quite a few existing bijoy-to-unicode converters, like the Avro Converter (no longer available), and banglaconverter.com. from i2soft technology.  These both do a similar job, but they have a lot of frustrating limitations:

    • Each Bijoy version seems to have a different mapping of various juktokkhor, which means you need manually convert it to the appropriate bijoy version before converting to unicode using find & replace.
    • Even so ~1% of the juktokkhor don’t convert properly.
    • Often Bijoy text has double reph, chandrabindu or hoshontos which become glaringly obvious in a converted unicode text.
    • Since these converters are plain-text converters (I couldn’t get Avro Converters’ Word converter to work), all text formatting gets lost in conversion and needs to be painstakingly reconstructed.
    • Often English words are scattered throughout the Bijoy text, and these are converted to gibberish – again, lots of time to manually fix in a manuscript.
    • HTML tags get converted to <হ২> etcetera…

I’ve been looking for a better converter for a while now, and I finally found a good solution now in the software package SIL Converters 4.0, for which I wrote a Bijoy-Unicode converter table. This has the following features:

  1. MS Word documents can be converted (retaining formatting)
  2. Within each document conversions can be set or skipped based on fonts (ie. SutonnyMJ will be converted, not Arial or Times New Roman)
  3. Any Bijoy version text will convert fine (eg. Classic, Bayanno, Ekushe, etc)
  4. Double chandrabindus, rephs and hoshontos are corrected
  5. HTML tags remain in English.
  6. If there’s any incorrect conversions you can modify the converter yourself through a text file in notepad.

Instructions

  1. First of all download the SIL Converters 4.0 software and install it – either from their website or else directly download with this link. (right click, ‘save link as’)
  2. Download the following file:bijoy-unicode.cct (right click and select ‘save link as’).
  3. After installing the SIL Converters 4.0 package, from Start type “Bulk Word Document Converter” and select it. There you’ll see the following window:
    converter1
  4. If MS Word is open, close it now.
  5. Select “File” > “Open” and choose a Bijoy Word document (.doc) you have. Then you’ll see the following window:
    converter2
  6. Now you’ll see a list of all the fonts in your document, and you can assign each font a converter and converted font.  So beside ‘SutonnyMJ‘ font hit ‘select a converter
  7. This time you’ll have to select “Add New” from the ‘Select Converter‘ window
    converter3
  8. From the “Choose a Transduction Engine” window select ‘CC Table
    converter4
  9. Next a window called “CC Table” will show up; select the ‘Setup‘ tab at the top:
    converter5
  10. To select the Bijoy>Unicode converter table we’ve made, click the “” on the top right and navigate to the ‘bijoy-unicode.cct‘ file you downloaded earlier.  Ensure that the  ‘CC table expects‘ and ‘CC table returns‘ are both set to ‘Unicode String (UTF-8)’
  11. Now select “OK” and hit “Yes” so that you can more easily use this converter next time around. Then click “OK” to return to the main window.
  12. Select this converter for each Bijoy font in your document and select an appropriate Unicode Bengali font such as SolaimanLipi.
  13. Now select ‘File‘> ‘Convert and Save Documents‘ to process the conversion.
  14. Notice that this software can also convert multiple documents simultaneously.
  15. If there’s any mistakes in the conversion you can fix them permanently by editing the ‘bijoy-unicode.cct’ file in Notepad.
  16. Enjoy!

বাংলা বিজয়-ইউনিকোড কনভার্টার

bijoy-unicode-converterবিজয় থেকে ইউনিকোড কনভার্টার বেশ কয়েকটা আছে, যেমন অভ্র কনভার্টার (অচল) অথবা i2soft technology এর banglaconverter.com. কিন্তু এগুলির বিভিন্ন সমস্যা আছে, যেমন:

  • এক এক বিজয় ভার্শনের এক একটা লেয়-আউট আছে, এবং প্রচলিত কনভার্টারগুলি শুধুমাত্র একটি বিশেষ বিজয় ভার্শন থেকে কনভার্ট করতে পারে। তাই আগে find & replace দিয়ে আগে বিজয় লেখাটি ঠিক করা লাগে।
  • তাছাড়া কিছু কিছু যুক্তক্ষর (১%) ঠিকমত কনভার্ট হয় না,
  • বিজয়ের মধ্যে অনেকসময় ভুল করে দুইটি রেফ, চন্দ্রবিন্দু ও হসন্ত থাকে, এবং সেগুলি ঠিকমত কনভার্ট হয় না, যার ফলে অনেক সংশোধন করতে হয়।
  • প্রচলিত কনভার্টারে MS Word এর সব ফর্ম্যাটিং হারিয়ে যায়, যার ফলে সেগুলি আবার তৈরী করতে হবে।
  • বাংলা লেখার মধ্যে সাধারণত ইংরেজি কিছু শব্দ থাকে, কিন্তু সেগুলিও প্রচলিত কনভার্টে আবোল-তাবোল হয়ে যায়।
  • HTML ট্যাগ থাকলে, সেগুলিও কনভার্ট করা হয়

অনেক দিন ধরে আমি একটি ভাল বিকল্প কনভার্টার খুঁজছিলাম, কিন্তু এখন একটা পাওয়া গেছে – SIL Converters এর CC সফ্‌টওয়্যার দিয়ে আমি নিজেই একটা কনভার্টার তৈরী করেছিলাম। এর মূল ফিচার হল:

  1. MS Word ডক্যুমেন্ট কনভার্ট করা যায় (অর্থাৎ ফর্ম্যাটিং থাকবে)
  2. ফন্ট অনুযায়ী কনভার্ট করা হয় (অর্থাৎ SutonnyMJ লেখা কনভার্ট হবে, Arial কনভার্ট হবে না)
  3. যেকোন বিজয় ভার্শনের লেখা (যেমন ক্ল্যাসিক, বায়ান্ন, একুশ, ইত্যাদি) ঠিকভাবে কনভার্ট হবে
  4. ডবল চন্দ্রবিন্দু/রেফ/হসন্ত ঠিকমত কনভার্ট হবে
  5. HTML ট্যাগ ইংরেজি রয়ে যাবে
  6. কোনো যুক্তক্ষর বা ভুল থাকলে আপনি নিজেই কনভার্টারটি সংশোধন করতে পারবে একটি সহজ txt ফাইল দিয়ে।

কীভাবে ইনস্টল করতে হবে

  1. সর্বপ্রথমে SIL Converters 4.0 সফ্‌টওয়্যার ডাউনলোড ও ইনস্টল করতে হবে – তাদের ওয়েবসাইটে যান অথবা এখানে সরাসরি ডাউনোড করুন
  2. এই ফাইল ডাউনলোড করতে হবে: bijoy-unicode.cct (right click and select ‘save link as’).
  3. ইনস্টল করার পরে Start থেকে লিখেন “Bulk Word Document Converter” এবং সেটা চাপুন। এই রকম একটি জানালা দেখবেন:
    converter1
  4. MS Word খোলা থাকলে সেটা বন্ধ করুন
  5. File > Open সেলেক্ট করুন এবং আপনার একটি বিজয় বাংলা .doc ফাইল পছন্দ করুন। তখন এই রকম একটি জানালা দেখা যাবে:
    converter2
  6. এখন আপনার ফাইলের মধ্যে যত ফন্ট আছে সেটা দেখা যাবে, এবং আপনি কোন্‌ কোন্‌ ফন্ট কনভার্ট করতে চান এবং কোন্‌ ইউনিকোড ফন্টে রাখতে চান সেটা এখন পছন্দ করুন। তাই ‘SutonnyMJ’ ফন্টের পাশে ‘select a converter’ চাপুন।
  7. প্রথমবার ‘Select Converter’ জানালার মধ্যে “Add New” চাপুন
    converter3
  8. “Choose a Transduction Engine” জানালায় ‘CC Table’ চাপুন
    converter4
  9. তখন “CC Table” নামক নতুন একটি জানালা উঠবে, সেখানে ‘Setup’ ট্যাব সেলেক্ট করুন:
    converter5
  10. আপনার কনভার্টার টেবিল পছন্দ করার জন্য উপরের ডান পাশের “” বাটন চাপুন এবং যে ‘bijoy-unicode.cct‘ ফাইল আপনি ডাউনলোড করেছেন সেটা এখন খুঁজে পান এখানে। জানালার মাঝখানে যে ‘CC table expects’ এবং ‘CC table returns’ দুটির ক্ষেত্রে ‘Unicode String (UTF-8)’ সেলেক্ট করুন।
  11. এখন ‘OK’ চাপুন এবং ‘Yes’ চাপুন যেন পরবর্তিতে এই কনভার্টার সহজে ‘Select Converter’ জানালা থেকে পাওয়া যাবে। আবার ‘OK’ চাপুন এবং মূল জানালায় ফিরে যান।
  12. প্রত্যেকটি বিজয় ফন্টে এই কনভার্টার ব্যবহার করুন এবং সোলাইমানলিপির মত একটি ইউনিকোড ফন্ট পছন্দ করুন।
  13. এবার ‘File’> ‘Convert and Save Documents’ পছন্দ করুন
  14. লক্ষ্য করুন যে এই সফ্‌টওয়্যার একাধিক doc ফাইল একসাথে কনভার্ট করতে পারে…
  15. কনভার্শনে কোন ভুল থাকলে আপনি সরাসরি ‘bijoy-unicode.cct’ ফাইল Notepad-এ খুলে তা পরিবর্তন করতে পারবেন
  16. Enjoy!

‘ঐশীভাষা’র পক্ষে প্রচলিত যুক্তির জবাব

“অমুক ভাষা অন্যান্য সমস্ত ভাষার উৎস ও মূল, ‘সমস্ত ভাষার মাতা’”

অনেক ভাষা এই দাবী করেছেন; সংস্কৃত, হিব্রু, আরবি। কিন্তু আধুনিক ঐতিহাসিক ভাষাবিজ্ঞান প্রমাণ করেছেন যে সমস্ত ভাষা বিবর্তন এবং পরিবর্তন করতে থাকে, এবং আজকাল কোন “সমস্ত ভাষাদের মাতা” এমন ভাষা নেই। যেমন ধরুন, পাঁচ হাজার বছর আগে আরবি ও হিব্রু ভাষা বিদ্যমান ছিল না – এরা পশ্চিম সেমিতীয় নামক অন্য একটি লুপ্ত ভাষা থেকে বিবর্তন হয়েছে, এবং সেই পশ্চিম সেমিতীয় অন্য একটি আরো প্রাচীন ‘আদি সেমিতীয়’ ভাষা থেকে বিবর্তন হয়েছে।    

“অমুক ভাষার বর্ণমালা এত সুন্দর যে দেখলেই বোঝা যায় সেটি ঐশীভাষা”

ভাষার বর্ণমালাগুলোও বিবর্তন হয়েছে। হযরত মূসা (আ.) এর আমলে আধুনিক হিব্রু অক্ষরের রূপ ছিল না – হিব্রু ভাষা লেখা হত প্রাচীন ফোনিষীয় ভাষার অক্ষরে (ইতিহাসের প্রথম বর্ণমালা)। হযরত ঈসা মসীহ্‌র আমলে আরবি বর্ণমালা আবিষ্কার হয় নি; আরবি অক্ষর প্রাচীন আরামায় অক্ষর থেকে খ্রীষ্টাব্দ চতুর্থ শতাব্দীতে ক্রমে ক্রমে বিবর্তন হয়েছে, এবং কোর’আন শরীফ নাজেল হওয়ার সময় দেখতে এইরকম ছিল:

হিব্রু, আরবি ও চীন লেখার সৌন্দর্য্য উন্নতি সাধন করেছেন পরে সেই ধর্মাবলম্বীদের শ্রমে, সেটা লেখাটার কোন স্থায়ী গুণ নয়। অনেক “ঐশী ভাষা” বিশ্বাসি ধর্মাবলম্বী অসংখ্য বছরের গবেষণার সময় নষ্ট করেছেন তাদের ঐশী ভাষার অক্ষরের পিছনে গুপ্ত আধ্যাতিক অর্থের খোঁজে, সংস্কৃত, হিব্রু, চীন বা আরবি হউক।

অমুক ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে গভীর ও সুন্দর ভাষা

ভাষাবিজ্ঞানের পণ্ডিতেরা এখন একমত যে প্রত্যেকটি বক্তার অন্তরের কথা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করতে সমানভাবে মানুষের পক্ষে তার সমর্থ। মানুষের পক্ষে তার নিজের ভাষাকে একটি শ্রেষ্ঠ ভাষা মনে করা স্বাভাবিক, কিন্তু আসলে সমস্ত ভাষা সমানভাবে সমৃদ্ধ।

আমাদের ইবাদত বা উপাসনার অবশ্যই ধর্মগ্রন্থের মূল ভাষা ব্যবহার করা উচিত কারণ সেটি স্বয়ং আল্লাহ্‌র বাণী

আল্লাহ্‌ যদি কোন ভাষা বলেন আর সেটা যদি হয় এমন ভাষা যেটা দন্ত ব্যাঞ্জনবর্ণ ব্যবহার (যেমন আরবি) তাহলে আল্লাহ্‌র দাঁত থাকতে হবে, এবং যেহেতু দাঁতের কাজ খাদ্য খাওয়া, তাই বলতে হবে যে আল্লাহ্‌ আহার করেন। এই যুক্তির সিদ্ধান্তটা কিন্তু বেশ শ্রুতিকটু।

সংরক্ষণ ও তার বিচ্যুতি রোধের জন্য আমাদের অবশ্যই মূল ভাষা ব্যবহার করতে হবে

আমরা আগে দেখিয়েছি কীভাবে মাতৃভাষার অর্থ ব্যবহারের বদলে বিদেশী মূল ভাষা ব্যবহার করার ফলাফল তার বিপরীত; বৌদ্ধ ধর্মে যেভাবে ধর্মের পরিবর্তন হয়েছে তেমনভাবে পরিবর্তন ঢুকে যেতে পারে।

নিজের মাতৃভাষা নিয়ে গর্ব করা স্বাভাবিক ও ভাল বিষয়, কিন্তু সেটাকে একমাত্র “ঐশীভাষা” হিসাবে গণ্য করা অগ্রহণযোগ্য। আল্লাহ্‌ সমস্ত ভাষাগুলো সমানভাবে গ্রহণ করেন।

আরবী ভাষা ও মাতৃভাষা

চিত্র ১ – যেসব দেশে মাতৃভাষা ত্যাগ করে আজকাল প্রধানত আরবী ভাষা বলার প্রচলন আছে।
চিত্র ১ – যেসব দেশে মাতৃভাষা ত্যাগ করে আজকাল প্রধানত আরবী ভাষা বলার প্রচলন আছে।

মিশরীয় জাতি – ভাষা এবং সংস্কৃতির ক্ষেত্রে মিশরীয় লোক আরবী বলা যায়, কিন্তু বংশগতভাবে তারা পুরোপুরি পৃথক। তাদের প্রাচীন কপ্ত্‌বা ⲘⲉⲧⲣⲉⲙÌⲛⲭⲏⲙⲓ (মেৎরেমেঙ্কিনি) ভাষা আজকাল শুধু ঈসায়ী সমাজের মধ্যে ব্যবহার করা হয়।

আসিরিয় ভাষা ছিল প্রাচীন মেসেপতেমিয়া (বর্তমান ইরাক) এলাকার মাতৃভাষা। আজকাল ঈসায়ী এবং দূরুজ সমাজ ছাড়া সবাই এই মাতৃভাষা ত্যাগ করে আরবী ভাষা ব্যবহার করে।

নূবীয় জাতিরা – বর্তমান উত্তর সুদান দেশের অধিকাংশ লোক আজকাল আরবী বাসাতে ব্যবহার করে থাকেন। তবুও কিছু কিছু মানুষদের মধ্যে তাদের আগেকার নূবীয় উপভাষাগুলো ব্যবহার করে থাকেন।

বেরবের জাতি – মাঘরেবের অধিকাংশ লোক বংশগত আরব নয়, তবে এখন অধিকাংশ বাসাতে আরবী ব্যবহার করা হয়।

বর্তমান লেবানন দেশের আদীবাসিরা শুধু আরবী ভাষা ব্যবহার করেন যুদিও তারা বংশগতভাবে ফিনিশীয়। তাদের সেই প্রাচীন ফিনিশীয় ভাষা লুপ্ত হল ৭০০ খ্রীষ্টাব্দ যখন আরব ভাষা এলাকাতে প্রথম আসল।