Category Archives: আল্লাহ্‌

ত্রিত্ব কী?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

ত্রিত্ব হলো সর্বশক্তিমান একমাত্র আল্লাহর তিনটি চরিত্রের প্রকাশ।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

ঈসায়ী ধর্মতত্ত্বের কয়েকটি কঠিন বিষয়ের মধ্যে ত্রিত্ব অন্যতম। যারা ঈসায়ী নন, তাদের জন্য যেমন বিষয়টি কঠিন তেমনি যারা ঈসায়ী ঈমানদার, তাদের জন্যও তা তেমনই কঠিন। অনেকের ধারণা হলো ত্রিত্ব মানে তিনজন আল্লাহ। অথচ কিতাবুল মোকাদ্দসের কোথাও তিনজন আল্লাহর অস্তিত্ব নেই; বরং একত্ববাদের শিক্ষাই সমধিক শক্তিশালী। তিন আল্লাহর অস্তিত্ব শুধু মানবজাতির জন্য ক্ষতিকরই নয় বরং বিশ্বব্রাহ্মাণ্ডের জন্য হুমকিস্বরূপ। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে, ত্রিত্ব কী? সংক্ষেপে ত্রিত্ব হলো এক এবং অদ্বিতীয় আল্লাহর তিনটি প্রকাশ। নিচে তাঁর এই তিনটি প্রকাশ দেখানো হলো:

বিশ্বপিতা: পাককিতাবে লেখা আছে, আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করলেন। যখন কোন কিছুই সৃষ্টি হয়নি তখন আল্লাহ ছিলেন। আল্লাহ হলেন বিশ্বপিতা, কেননা সবকিছুর মূলেই রয়েছেন তিনি। এই পিতা আল্লাহকে দেখা যায় না। তিনি সৃষ্টির আগে কালাম হিসেবে বিরাজ করছিলেন। ইউহোন্না কিতাবে লেখা আছে, “প্রথমেই কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহর সঙ্গে ছিলেন এবং কালাম নিজেই আল্লাহ ছিলেন” (ইউহোন্না ১:১)। সৃষ্টির শুরুতে কোন কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না, তখন শুধু একটি কালাম শোনা গিয়েছিল, “কুন্” অর্থাৎ হও। আর তাতেই পর্যায়ক্রমে আকাশ-মাটি-চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্র-গাছপালা-পশু-পাখি সবই আল্লাহর কালামের সাহায্যে সৃষ্ট হলো। তাই আল্লাহ কেবল মানুষের পিতাই নন, তিনি সমস্ত সৃষ্টির পিতা, কারণ সকল সৃষ্টিই তাঁকে প্রকাশ করে। হজরত দাউদ বলেন, “হে মাবুদ, আমাদের মালিক, সারা দুনিয়ায় রয়েছে তোমার মহিমার প্রকাশ; বেহেশতে তোমার মহিমা তুমি স্থাপন করেছ” (জবুর শরিফ ৮:১)। কিন্তু আল্লাহর অস্তিত্ব কোথায়? ঈসায়ীরা বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ আছেন। তিনি নিরাকার, তাঁকে দেখা যায় না। এটি তাঁর অতুলনীয় গুণ। যা দেখা যায় তা সীমাবদ্ধ আর যা দেখা যায় না, তা অসীম। যদি তাঁকে দেখা যেত তবে তিনি সীমাবদ্ধ হয়ে যেতেন; তাঁকে দেখা যায় না বলেই তিনি অনন্ত অসীম হিসেবে বিরাজ করছেন।

বেহেস্তি পিতা: ঈসায়ীরা আল্লাহকে বেহেস্তি পিতা বলে ডাকে। পিতার সাথে যেমন সন্তানের অনবদ্য সম্পর্ক, ঈসায়ীরা আল্লাহর সাথে তাদের এই সম্পর্ক আছে বলে বিশ্বাস করে। হজরত ঈসাকে যখন তাঁর সাহাবিরা মুনাজাত করতে শিখিয়ে দিতে বলেছিলেন তখন তিনি আল্লাহর এই পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “তোমরা এভাবে মুনাজাত করো, ‘হে আমাদের বেহেস্তি পিতা।” এই পিতৃত্বের সাথে দুনিয়ার কোন সম্পর্ক নেই। এর সাথে সাধারণ পিতা-মাতা হবার যে শর্ত তারও কোন যোগসূত্র নেই। এটি একটি অপার্থিব সম্পর্ক যা কেবল বেহেস্তি আল্লাহর ক্ষেত্রেই মানায়, অন্যকোন ক্ষেত্রে নয়।

পুত্র: পুত্র মানে প্রকাশক। জাগতিক পিতার সন্তান চেহারায়, আচার-আচরণে, কথাবার্তায়, চালচলনে তার পিতাকে প্রকাশ করে। কিতাবে হজরত আদমকে আল্লাহর পুত্র বলা হয়েছে। আল্লাহ বনি-ইসারাইলকে বলেছেন, ইসরাইল আমার সন্তান। আল্লাহ হজরত ঈসাকে পাঠিয়েছিলেন যেন তিনি মানুষের কাছে আল্লাহকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারেন। হজরত ঈসা মসীহ বলেছেন, “যে আমাকে দেখেছে সে পিতাকে দেখেছে”। আল্লাহর কালামেই বলা হয়েছে, আল্লাহকে কেউ কখনও দেখেনি, তার কাছে থাকা পুত্রই তাঁকে প্রকাশ করেছেন (ইউহোন্না ১:১৮)। এই পুত্র শব্দও এখানে রুহানি অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে, আক্ষরিক অর্থে নয়। আক্ষরিক অর্থে পুত্র হবার জন্য প্রয়োজন ‘বাবা + মা = সন্তান’ এই ধারণার। এখানে তার প্রয়োজন নেই, কারণ এই যৌগিক ফলাফলের অর্থে হজরত ঈসাকে পুত্র বলা হয়নি, বলা হয়েছে পবিত্রতায়, আচরণে ও আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতায়।

পবিত্রতায়: আল্লাহ যেমন পবিত্র ঠিক তেমনি একমাত্র হজরত ঈসাও পবিত্র ছিলেন। তাঁর জন্মই হয়েছিল পবিত্রভাবে। হজরত ঈসার জন্মের আগে তাঁর মা বিবি মরিয়মের কাছে ফেরেশতা এসে বলেছিলেন, “পাকরুহ তোমার উপরে আসবেন এবং আল্লাহতা’লার কুদরতির ছায়া তোমার উপরে পড়বে। এই জন্য যে পবিত্র সন্তান জন্মগ্রহণ করবে, তাকে ইব্নুল্লাহ বলা হবে” (ইউহোন্না ১:৩৫)। ‘পাকরুহ তোমার উপর আসবে’। তার মানে হলো এই পুত্রের জন্ম পাকরুহের শক্তি দিয়ে, অন্য কোনভাবে নয়। ফেরেশতা আরও বলেছিলেন যে, পবিত্র সন্তান জন্ম হবে’। মানুষ সাধারণত পাপস্বভাব নিয়েই জন্মায়। কিন্তু একমাত্র ব্যতিক্রম ঈসা মসীহ, তিনি পবিত্র হয়েই জন্মেছিলেন। আর এভাবে মসীহ আল্লাহর পবিত্র স্বভাবকে প্রকাশ করেছিলেন।

আচরণে: হজরত ঈসা তাঁর আচরণের মধ্যদিয়ে আল্লাহর সকল গুণাবলী প্রকাশ করেছেন। তিনি মহব্বতে পূর্ণ ছিলেন। প্রাত্যহিক জীবনে তিনি মানুষের দুঃখকষ্ট লাঘব করতেন। তিনি অসুস্থদের সুস্থ করতেন, অন্ধকে দেখার শক্তি দিতেন, খোঁড়াকে ভালো করতেন, অবশ রোগীকে চলার শক্তি দিতেন, কুষ্ট রোগীকে স্পর্শে ভালো করতেন, মন্দ আত্মায় পাওয়া লোকদের ভালো করতেন, এমন কি মৃতকেও জীবিত করতেন। মোট কথা তিনি ছিলেন আল্লাহরই মতো মহব্বতে এবং আরোগ্যকারী ক্ষমতায় পূর্ণ এক অসাধারণ মহাপুরুষ। আর সেই কারণে তিনি আল্লাহর ইচ্ছা অনুযায়ী জীবন যাপন করতেন এবং তাঁর আচরণ দ্বারা মানুষের প্রতি আল্লাহর আচরণ কী তা-ই প্রকাশ পেয়েছে।

সার্বভৌম ক্ষমতায়: হজরত ঈসা আল্লাহর মতো সার্বভৌম ক্ষমতা ব্যবহার করতেন। প্রথমত: প্রাকৃতিক শক্তিকে তিনি নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর আদেশে ঝড় থেমে যেত, মাছ জালের মধ্যে চলে আসতো, ভূত চলে যেত, এমন কি মৃত লাশ উঠে দাঁড়াতো। তিনি মানুষের অন্তরের গোপন কথা জানতেন, নিজের মৃত্যু ও পুনরুত্থানের বিষয় জানতেন এবং ভবিষ্যতবাণী করতেন। তিনি পানির উপর দিয়ে হাঁটতেন, দরজা বন্ধ থাকলেও ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতেন আবার মৃত্যুর পর- মৃত্যুকে জয় করে পুনরুত্থিত হয়ে, প্রাকৃতিক শক্তির উপর তাঁর সার্বভৌম ক্ষমতা প্রকাশ করেছেন।

আল্লাহর ইচ্ছায়: সবচেয়ে বড় কথা, এই পুত্র শব্দটি কোন মানুষের কাছ থেকে আসেনি কিংবা হজরত ঈসা নিজেও এই উপাধি নেননি বরং আল্লাহ স্বয়ং প্রকাশ করেছিলেন। জন্মের সময় ফেরেশতা বলেছিলেন, যে পবিত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করবেন তাঁকে ইবনুল্লাহ বলা হবে (ইউহোন্না ১:৩৫)। এ^ছাড়া দৈববাণীর দ্বারা কয়েকবার আল্লাহ বেহেস্ত থেকে ঈসা মসীহকে পুত্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। তাঁর নবুয়তের সময় আল্লাহ বেহেস্ত থেকে বলেছিলেন, “ইনিই আমার প্রিয় পুত্র, এঁর উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট” (ইঞ্জিল শরিফ, মথি ৩:১৭)। এরপর হজরত ঈসা একবার তাঁর তিন সাহাবিকে নিয়ে পাহাড়ের উপর মুনাজাত করতে গিয়েছিলেন। আর সেখানে মুনাজাত করতে করতে তাঁর মুখ সূর্যের মতো উজ্জ্বল সাদা হয়ে গিয়েছিল, উপস্থিত সাহাবিরা মেঘের মধ্যে হজরত মুসা ও ইলিয়াসকে কথা বলতে দেখেছিলেন, আর তখন বাণী হয়েছিল, “ইনি আমার প্রিয় পুত্র, এঁর উপর আমি খুবই সন্তুষ্ট” (ইঞ্জিল শরিফ, মথি ১৭:৫)।

পাকরুহ: পয়দায়েশ প্রথম অধ্যায় দ্বিতীয় আয়াতে আছে, “আল্লাহর রুহ সেই পানির উপরে চলাফেরা করছিলেন।” এখানে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রথম প্রকাশ পায়, আর সেই প্রকাশ হলো রুহ হিসেবে পানির উপর চলাফেরা। আগেকার নবিরা আল্লাহর পক্ষে কথা বলতেন, তবলিগ করতেন, ভবিষ্যতবাণী বলতেন। আর এসবকিছুই করতেন পাকরুহের মাধ্যমে অনুপ্রাণিত হয়ে। আল্লাহর যত কিতাব এই পর্যন্ত নাজেল হয়েছে, তা পাকরুহের মধ্যদিয়েই হয়েছে। পাকরুহের অনুপ্রেরণা পেয়েই নবিরা কিতাব লিখেছেন। হজরত ঈসার নবুয়তের সময় বেহেস্ত থেকে পাকরুহ কবুতরের মতো হয়ে নেমে এসেছিলেন। পাকরুহ আল্লাহর অদৃশ্যতাকে প্রমাণ করেন এবং আল্লাহর সকল ক্ষমতা প্রকাশ করতে পারেন। হজরত ঈসা দুনিয়া থেকে বেহেস্তে চলে যাবার আগে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি তাঁর উম্মতদের জন্য পাকরুহকে পাঠিয়ে দেবেন। তিনি সত্যের রুহ, যিনি ঈমানদারদের অন্তরে থাকেন ও তাদের পরিচালনা করেন। আসল কথা হলো, মানুষ আল্লাহবিহীন থাকতে পারে না। সেই কারণে হজরত আদমকে আল্লাহবিহীন অবস্থায় মৃত বলা হয়েছে। নবিগণের মাধ্যমে হজরত ঈসা আসার প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল, যার মানে ইম্মানুয়েল অর্থাৎ আমাদের সাথে আল্লাহ। আর যতদিন হজরত ঈসা আসেননি ততদিন পাকরুহ এসে নবিদের পরিচালনা করেছেন এমনকি কিতাব লেখায় সাহায্য করেছেন। অতপর হজরত ঈসা এসেছেন ও মানুষের সাথে থেকেছেন এবং তিনি চলে যাবার পর পাকরুহকে পাঠিয়েছেন।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

দ্বিতীয় অধ্যায়
হজরত ঈসা মসীহ সম্পর্কে

ঈসায়ীরা কি তিন আল্লাহর এবাদত করে?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

না, ঈসায়ীরা তিন আল্লাহর নয় বরং এক আল্লাহরই এবাদত করে।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

ঈসায়ীরা কখনও কোনভাবে তিন আল্লাহ বিশ্বাস করে না, করতে পারে না; আর তাই তিন আল্লাহর এবাদত করার প্রশ্নই ওঠে না। যদি কোন ঈসায়ী তিন আল্লাহ বিশ্বাস করে তবে সে ঈসায়ী নয় বরং আল্লাহ ও কিতাবের বিরুদ্ধে তার অবস্থান। এখন আসুন, আল্লাহ সম্পর্কে ঈসায়ীরা কী বিশ্বাস করে তা দেখি:

আল্লাহ এক: তৌরাত শরিফে আছে, “বনি-ইসরাইলরা শোন, আমাদের মাবুদ আল্লাহ এক” (দ্বিতীয় বিবরণ ৬:৮)। হজরত ঈসা মসীহও একই শিক্ষা দিয়েছিলেন যে, আমাদের আল্লাহ একই আল্লাহ, যার এবাদত হজরত আদম, নুহ, ইব্রাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, দাউদ এবং অন্যান্য নবিরা করেছিলেন।

লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ: আল্লাহ ছাড়া যে আর কোন মাবুদ নাই, তার শিক্ষাও কিতাবুল মোকাদ্দস থেকে এসেছে। আল্লাহভক্ত লোকদের জীবন ইতিহাস থেকে বার বার প্রমাণিত হয়েছে যে, একমাত্র ও অদ্বিতীয় আল্লাহ নিজেই মানুষের উপাস্য। তিনি নিজেই ঘোষণা করেছেন, “আমার জায়গায় কোন দেবতাকে দাঁড় করাবে না” (হিজরত ২০:২)। তৌরাত শরিফে বর্ণিত ১০ হুকুমের দ্বিতীয়টি হলো, পূজার উদ্দেশ্যে তোমরা কোন মূর্তি তৈরি করবে না, তা আকাশের কোন কিছুর মতো হোক বা মাটির উপরকার কোন কিছুর মত হোক কিংবা পানির মধ্যেকার কোনকিছুর মতো হোক” (হিজরত ২০: ৪)। কিতাবুল মোকাদ্দসের প্রধান শিক্ষা হলো কেবল আল্লাহর এবাদত করতে হবে যা ঈসায়ীরা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে। আল্লাহপাক বলেন, “তোমরা কোন দেবদেবীর পূজা করবে না কিংবা তাদের কাছে মাথা নিচু করবে না এবং তাদের সেবা করবে না কিংবা তাদের উদ্দেশ্যে বলি দেবে না। কিন্তু মাবুদেরই এবাদত করবে, তাঁকে সেজদা করবে এবং তাঁর উদ্দেশ্যেই কোরবানি দেবে” (২ বাদশাহনামা ১৭:৩৫-৩৬)।

ন্যায়বিচারক: ঈসায়ীরা আল্লাহকে ন্যায়ের ধারক ও বাহক হিসেবে বিশ্বাস করে। বিশ্বাস করে যে, তিনি কখনও অন্যায় করেন না, অন্যায়কারীকে প্রশ্রয় দেন না কিংবা অন্যায়কারীর পক্ষ নেন না। আল্লাহ পবিত্র, তাই তিনি প্রত্যেক গুনাহ্‌র বিচার করবেন। কোন গুনাহগার মানুষ তাঁর সাথে থাকতে পারে না কিংবা বেহেস্তে যেতে পারবে না। সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা আল্লাহ্‌র অনন্য গুণ যা তাঁর মহব্বত গুণের সাথে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে চলে।

মহব্বতের আল্লাহ: ঈসায়ীদের বিশ্বাস হলো আল্লাহ হলেন মহব্বতের আধার। আল্লাহভক্ত ইউহোন্না বলেন, “আল্লাহ নিজেই মহব্বত” (১ ইউহোন্না ৪:৮)। আল্লাহ আমাদের সৃষ্টি করেছেন তা যেমন সত্য, তার চেয়েও বড় সত্য হলো তিনি মানুষকে ভালোবাসেন। যার ফলে আমরা তাঁকে ভুলে গেলেও তিনি বিভিন্ন উপায়ে আমাদের তাঁর কাছে আসতে সাহায্য করেন। হজরত দাউদ গজল গেয়েছিলেন, “মাবুদকে শুকরিয়া জানাও, কারণ তিনি মেহেরবান, তাঁর অটল মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। বনি-ইসারাইলরা বলুক, তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। হারুনের বংশ বলুক, তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী। মাবুদের ভক্তরা বলুক, তাঁর মহব্বত চিরকাল স্থায়ী” (জবুর শরিফ ১১৮:১-৪)।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

ঈসায়ী, ইহুদি ও মুসলমানদের আল্লাহর মধ্যে কোন পার্থক্য আছে কি?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

এককথায় এই তিন জাতির আল্লাহ একই আল্লাহ, তবে প্রত্যেক জাতি তাদের মনস্তাত্ত্বিক ধারণায় আল্লাহর বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের উপর গুরুত্ব দিয়ে থাকে অর্থাৎ এক এক জাতি আল্লাহর বিশেষ বিশেষ গুণের উপর জোর দেয়।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

আল্লাহ একই আল্লাহ। প্রত্যেক জাতির জন্য আলাদা কোন আল্লাহ আছে বলে ঈসায়ীরা বিশ্বাস করে না। ঈসায়ী, ইহুদি এবং মুসলমানদের আল্লাহ যে অভিন্ন তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই তথ্য কিতাব অনুসারেই সত্য। ঈসায়ী, ইহুদি এবং মুসলমানরা প্রায় একই মূল সত্যে বিশ্বাসী; আর সেই বিশ্বাস হলো আল্লাহ এক এবং অদ্বিতীয়। তবে এই ত্রিবিধ জাতিগণের আচরণ অনুযায়ী দেখা যায় যে, ঈসায়ীগণ আল্লাহকে প্রেমময় আল্লাহ ও ধার্মিক আল্লাহ, বলে জানে এবং তারা মানে মাবুদ মমতায়পূর্ণ ও দয়াময়, তিনি সহজে রেগে ওঠেন না, তাঁর অটল মহব্বতের সীমা নেই। ইহুদিগণ নিয়মতান্ত্রিক আল্লাহ এবং মুসলমানগণ একদিকে রহমতের আল্লাহ আরেকদিকে কাহারু বা কঠোর আল্লাহ হিসেবেই মানে। এগুলো হলো এক এক জাতির চিন্তা, দর্শন ও ধর্মীয়-সামাজিক চরিত্র অনুসারে আল্লাহ সম্পর্কে তাদের চিন্তাভাবনা। আল্লাহর উপরে বর্ণিত তিনটি গুণই অপরিহার্য। আল্লাহ প্রেমময় তাতে যেমন সন্দেহ নেই তেমনি আল্লাহ সবকিছুকে নিয়মের মধ্যে আবদ্ধ রেখেছেন তা-ও অস্বীকার করার উপায় নেই; আবার কোন কোন বিষয়ে আল্লাহ কঠোর হন তা-ও ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই। কিন্তু কোন একটি বিষয়ে জোর দিতে গিয়ে, আল্লাহর অপরাপর গুণগুলোকে এড়িয়ে যাওয়াও কিতাব সম্মত নয়। মনে রাখতে হবে যে, এই তিন গুণাবলী ছাড়াও আল্লাহর আরও অনেক গুণ রয়েছে যা মানব জাতির কল্যাণে সদাসর্বদা নিয়োজিত। উদাহরণস্বরূপ ‘সত্য’, ‘ন্যায়পরায়ণতা’, ‘বিশ্বস্ততা’ ও ‘ধার্মিকতা’ ইত্যাদিও আল্লাহর প্রধান প্রধান গুণাবলী। এ গুণগুলো না থাকলে মানবজাতি বহুকাল আগেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।

ঈসা মসীহ সম্পর্কে: যুগে যুগে যেসব নবি-পয়গাম্বর এ দুনিয়াতে এসেছিলেন, তাঁদের মধ্যে ঈসা মসীহের নাম অনন্য সাধারণ। প্রায় দু’হাজার বছর আগে, তাঁর অসাধারণ জন্ম, অলৌকিক কাজ, বিস্ময়কর শিক্ষা, অবিস্মরণীয় মৃত্যু এবং অকল্পনীয় পুনরুত্থান ঈসা মসীহ সম্পর্কে মানুষের মনে বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছিল। অতঃপর যুগে যুগে মানুষ প্রশ্ন করেছে তিনি কে? আজ দু’হাজার বছর পরেও মানুষ নানা প্রশ্ন করছে, তিনি আসলে কে? কারণ নবিরা যেসব আশ্চর্য কাজ করেছিলেন তার চেয়ে তিনি আরো বেশি কিছু করেছিলেন। নবিরা যেভাবে শিক্ষা দিতেন তার চেয়ে তিনি আরো বেশিদূর এগিয়ে গিয়েছেন। মৃত্যুর মধ্যদিয়ে সব নবিই জীবনের ইতি টেনেছেন কিন্তু সেই মৃতুকেও তিনি পরাজিত করেছেন। মসীহের জন্মের আগে তাঁর সম্পর্কে ভবিষ্যতবাণী করে গিয়েছিলেন এবং তাঁর জন্ম ও পুনরুত্থানের পর শতশত মনীষী তাঁর সম্পর্কে কথা বলেছেন, অনেকে তাঁর উপর ঈমান এনেছেন। আজো তাঁর সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যেসব প্রশ্ন করে তার কিছু উত্তর নিম্নে দেওয়া হলো।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

ঈসায়ীদের আল্লাহ আর মুসলিমদের আল্লাহ কি একই আল্লাহ?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

হ্যাঁ, এক অর্থে ঈসায়ীদের আল্লাহ ও মুসলিমদের আল্লাহ একই আল্লাহ, তবে কিছু পার্থক্যও আছে।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

বিশ্বব্রক্ষ্মাণ্ডের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ দুইজন হতে পারেন না, তিনি একই আল্লাহ। কিতাবুল মোকাদ্দসে যে আল্লাহর কথা বলা হয়েছে, যে আল্লাহর কথা হজরত আদম, নুহ, ইব্রাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব, ইউসুফ, মুসা, দাউদ, সোলায়মান, ঈসা প্রমুখ নবিরা বলেছেন, তিনিই সর্বশক্তিমান পাকআল্লাহ। আল্লাহর কালাম থেকে বিভিন্ন ঘটনাবলী পড়ে তাঁর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে, যে গুণগুলো পাওয়া যায়, তা প্রায় সকল ধর্মের মধ্যেই বিধৃত আছে। তবে বিশ্বাসের দিক থেকে বুঝতে হবে যে, কারা কোন্ ধরনের বৈশিষ্ট্যগুলোগুলোর উপর গুরুত্ব দেয় এবং সেভাবে আল্লাহকে বিশ্বাস করে। কোরানে বর্ণিত আল্লাহর ৯৯ নামের সকল বৈশিষ্ট্যই ঈসায়ীদের আল্লাহর চরিত্রে বিদ্যমান, সেই আল্লাহকেই তারা বিশ্বাস করে। তবে আল্লাহর ধার্মিক গুণটি এই ৯৯ নামের মধ্যে পাওয়া যায় না। এদিক থেকে আল্লাহকে ঈসায়ীরা একটি বিশেষ দৃষ্টিকোন থেকে বিশ্বাস করে। বোঝার সুবিধার জন্য কোরানে বর্ণিত আল্লাহর ৯৯টি নাম নিম্নে দেয়া হলো:

  1. আল্লাহ: যে নাম সকল নামের উপরে অবস্থান করে।
  2. আল-আউয়াল: সর্বপ্রথম, যিনি শুরুর আগেই ছিলেন। (সূরা হাদিদ ৩ আয়াত)।
  3. আল-আখির: সর্বশেষ, সবকিছু শেষ হওয়ার পরও যিনি থাকবেন। (সূরা হাদিদ ৩ আয়াত)।
  4. আল-বাদি: পরিকল্পনাকারী, যিনি সৃষ্টির সকল কিছুর পরিকল্পনা করেন। (সূরা বাকারা ১১৭ আয়াত)।
  5. আল-বারি: সৃষ্টিকর্তা, যার হাত দিয়ে আমরা সবাই এসেছি। (সূরা হাশর ২৪ আয়াত)।
  6. আল-বার: উপকারী, যার সকল সৃষ্টিকর্মের মধ্যে সর্বজনগ্রাহ্যতা আছে। (সূরা তুর ২৮ আয়াত)।
  7. আল-বশির: পর্যবেক্ষণকারী, যিনি সব দেখেন ও শোনেন। (সূরা হাদিদ ৩ আয়াত)।
  8. আল-বাসিত: ছড়ানোকারী, যিনি তাঁর ইচ্ছামত দয়া বিতরণ করেন। (সূরা রা’দ ২৬ আয়াত)।
  9. আল-বাতিন: আভ্যন্তরীণ, যিনি সবকিছুর অভ্যন্তরে কাজ করেন। (সূরা হাদিদ ৩ আয়াত)।
  10. আল-বাইত: উত্থাপক, যিনি সবজাতি থেকে সাক্ষী উত্থাপন করেন। (সূরা আন্’আম ৮৯, ৯১ আয়াত)।
  11. আল-বাকি: সহ্যশীল, যিনি আরো বেশি সহ্য করেন। (সূরা তাহা ৭৩, ৭৫ আয়াত)।
  12. আল-তাওয়াব: ত্যাগকারী, যিনি আদম এবং বংশধরদের ত্যাগ করেন। (সূরা বাকারা ৩৭ আয়াত)।
  13. আল-জাব্বার: মহাশক্তিশালী, যার ক্ষমতা ও শক্তি অপরিসীম। (সূরা হাশর ২৩ আয়াত)।
  14. আল-জলিল: শক্তিশালী এবং কর্তৃত্বকারী।
  15. আল-জামি: সংগ্রহকারী, যিনি একটি সুনির্দিষ্ট দিনে সকলকে সংগ্রহ করেন। (সূরা আল-ইমরান ৯ আয়াত)।
  16. আল-হাসিব: হিসাবকারী, যিনি বার বার জবাবদিহি করেন। (সূরা নিসা ৬-৮ আয়াত)।
  17. আল-হাফিজ: অভিভাবক, যিনি সবকিছুর দেখাশোনা করেন। (সূরা হুদ ৫৭ আয়াত) (ইশাইয়া ১:২)।
  18. আল-হক্ক: সত্য। (সূরা তাহা ১১৪ আয়াত)।
  19. আল-হাকেম: বিচারক, যিনি তাঁর বান্দাদের বিচার করেন। (সূরা মু’মিন ৪৮, ৫১ আয়াত)।
  20. আল-হাকিম: জ্ঞানী, যিনি জ্ঞানী ও সর্বজ্ঞ। (সূরা আ’রফ ১৮ আয়াত)।
  21. আল-হালিম: দয়াময়, যিনি ক্ষমা করেন ও সবকিছু নিষ্পত্তি করেন। (সূরা বাকারা ২২৫ আয়াত)।
  22. আল-হামিদ: প্রশংসাযোগ্য, সবাই তাঁর প্রশংসা করতে বাধ্য। (সূরা বাকারা ২৬৭, ২৭০ আয়াত)।
  23. আল-হাঈ: চিরজীবী, যিনি সকল জীবনের উৎস। (সূরা তাহা ১১১ আয়াত)।
  24. আল-খাবির: অভিজ্ঞ, যিনি জ্ঞানী ও অভিজ্ঞ। (সূরা আন’আম ১৮ আয়াত)।
  25. আল-খাফিদ: নম্রকারী, যিনি কাউকে অবনত করেন আর কাউকে উচ্চে ওঠান। (সূরা ওয়াকি’আ ৩ আয়াত)।
  26. আল-খালিক: সৃষ্টিকর্তা, যিনি সবকিছু সৃষ্টি করেন। (সূরা রা’দ ১৬-১৭ আয়াত) (পয়দায়েশ ১:১)।
  27. আল-হাদি: পথপ্রদর্শক, যিনি ঈমানদারদের সোজা পথ দেখান। (সূরা হাজ্জ ৫৪ আয়াত)।
  28. আল-ওয়াহেদ: এক, বেহেস্তি সার্বভৌমত্বের ক্ষেত্রে অদ্বিতীয়। (সূরা রা’দ ১৬-১৭ আয়াত)।
  29. আল-ওয়াহিদ: অনন্য, যিনি একাকী সব সৃষ্টি করেন। (সূরা মুদ্দাছ্ছির ১১ আয়াত)।
  30. আল-ওয়াদুদ: প্রেমময়, যিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি কৃপাময় ও প্রেমময়। (সূরা হূদ ৯০, ৯২ আয়াত) (১ ইউহোন্না ৪:৮)।
  31. আল-ওয়ারিথ: উত্তরাধিকার দানকারী, সকলই যার যার গন্তব্যে ফিরে যাবে। (সূরা বনি ইসরাইল ৪০-৪১ আয়াত)।
  32. আল-ওয়াসি: মুক্তপ্রাণ, যার অসীমতা সকলের কাছে পৌঁছে যায়। (সূরা বাকারা ২৬৮, ২৭১ আয়াত)।
  33. আল-ওয়াকিল: প্রশাসক, যার কাছে সবকিছুর দায়দায়িত্ব অর্পিত। (সূরা আন’আম ১০২ আয়াত)।
  34. আল-ওয়েলি: সমর্থক, যিনি বান্দাদের যথেষ্ট সমর্থন করেন। (সূরা নিসা ৪৫, ৪৭ আয়াত)।
  35. আল-ওয়ালি: দেহরক্ষী, যাকে ছাড়া মানুষের রক্ষী হিসাবে আর কাউকে চিন্তা করা যায় না। (সূরা রা’দ ১১-১২ আয়াত)।
  36. আল-ওয়াহাব: হৃষ্টচিত্তদাতা, যিনি তাঁর অসীম ধন থেকে মুক্তহস্তে দান করেন। (সূরা আল-ইমরান ৮ আয়াত)।
  37. আল-আজিজ: অনুপ্রেরণাদায়ী, অনুপ্রেরণা দান করার ক্ষেত্রে শক্তিশালী এবং সার্বভৌম। (সূরা হাশর ২৩ আয়াত)।
  38. আল-আজিম: শক্তিশালী, যিনি সবকিছুর উপরে এবং শক্তিশালী। (সূরা বাকারা ২৫৫-২৫৬ আয়াত)।
  39. আল-আফ্যু: ক্ষমাকারী, যিনি তাঁর বান্দাদের ক্ষমা করতে সর্বদা প্রস্তুত। (সূরা নিসা ৯৯-১০০ আয়াত)।
  40. আল আলিম: জ্ঞানীজন, যিনি সবকিছু সম্বন্ধে সচেতন। (সূরা বাকারা ২৯ আয়াত)।
  41. আল-আলি: সুউচ্চজন, যিনি উচ্চীকৃত এবং শক্তিশালী। (সূরা বাকারা ২৫৫-২৫৬ আয়াত)।
  42. আল-গফুর: ক্ষমাদানকারী, যিনি ক্ষমা করেন এবং ব্যবস্থা করেন। (সূরা বাকারা ২৩৫ আয়াত)।
  43. আল-গাফ্ফার: বিবেচনাকারী, কোনকিছু বিবেচনা করতে এবং ক্ষমা করতে সর্বদা প্রস্তুত। (সূরা নুহ ১০ আয়াত)।
  44. আল-গনি: ধনী, যিনি সবকিছুর মালিক এবং অধিকারী। (সূরা বাকারা ২৬৭ আয়াত)।
  45. আল-ফাতাহ্‌: উদ্বোধক, যিনি পরিষ্কার করেন এবং পথ খুলে দেন। (সূরা সাবা ২৬ আয়াত)।
  46. আল-ক্বাবিদ: ধারণকারী, যিনি ধারণ করেন এবং খোলাহাতে দান করেন। (সূরা বাকারা ২৪৫-২৪৬ আয়াত)।
  47. আল-ক্বাদির: সমর্থ, যিনি নিজের সন্তোষজনক কিছু করতে সমর্থ। (সূরা বনি-ইসরাইল ৯৯, ১০১ আয়াত)।
  48. আল-কুদ্দুস: অতি পবিত্রজন, বেহেস্তে এবং দুনিয়াতে সবাই যাঁর চোখে পবিত্র থাকতে বাধ্য। (সূরা জুমু’আ ১আয়াত)।
  49. আল-ক্বাহ্‌হার: সর্বজয়ী, যিনি সবকিছু জয় করেন। (সূরা রা’দ ১৬-১৭ আয়াত)।
  50. আল-কাউয়ী: শক্তিশালী, যিনি শক্তি ও ক্ষমতায় সার্বভৌম। (সূরা রা’দ ১৯ আয়াত)।
  51. আল-কাইয়ুম: আত্মনির্ভরশীল, যিনি কেবল একজনই অনন্তকাল স্থায়ী। (সূরা আলে-ইমরান ২ আয়াত)।
  52. আল-কবির: মহান, যিনি সুউচ্চ এবং মহান। (সূরা হাজ্জ ৬২ আয়াত)।
  53. আল-করিম: মহানুভব, যিনি কেবল ধনীই নন, হৃষ্টচিত্তদাতাও। (সূরা নামল্ ৪০ আয়াত)।
  54. আল-লতিফ: অনুগ্রহশীল, যার অনুগ্রহ তাঁর সকল বান্দাদের প্রতি বর্তে। (সূরা শূরা ১৯ আয়াত)।
  55. আল-মজিদ: গৌরবময়, যিনি প্রশংসার যোগ্য এবং যিনি গৌরবান্বিত। (সূরা হুদ ৭৩, ৭৬ আয়াত)।
  56. আল-মালিক: রাজা, যিনি রাজাদের রাজা। (সূরা হাশর ২৩ আয়াত)।
  57. আল-মুতাফাক্কির: রক্ষাকারী, যিনি যখন ইচ্ছা শাস্তি দেন ও রক্ষা করেন। (সূরা ইবরাহিম ৪২, ৪৩ আয়াত)।
  58. আল-মুমিন: বিশ্বস্ত, যিনি সকলের নিরাপত্তা বিধান করেন। (সূরা হাশর ২৩ আয়াত)।
  59. আল-মুতালি: যিনি আত্মোন্নত, নিজেকে উতি উচ্চে স্থাপন করেন। (সূরা রা’দ ৯, ১০ আয়াত)।
  60. আল-মুতাকাব্বির: গৌরবান্বিত, কাজের মধ্যেই যার গৌরব। (সূরা হাশর ২৩ আয়াত)।
  61. আল-মতিন: দৃঢ়, যিনি পদমর্যাদা এবং শক্তির দিক থেকে সুদৃঢ়। (সূরা যারিয়াত ৫৮ আয়াত)।
  62. আল-মুবদি: সৃষ্টিকারী, যিনি সৃষ্টি করেন এবং রক্ষা করেন। (সূরা বুরুজ ১৩ আয়াত)।
  63. আল-মুজিব: উত্তর দানকারী, যিনি বান্দাদের ডাকে সাড়া দেন। (সূরা হুদ ৬১, ৬৪ আয়াত)।
  64. আল-মুহ্‌সি: গনণাকারী, যিনি সবকিছু গণনা করে হিসাব রাখেন। (সূরা মারইয়াম ৯৪ আয়াত)।
  65. আল-মুহাইয়ী: শীঘ্রকারী, যিনি শীঘ্র করেন এবং মৃতকে জীবন দেন। (সূরা রূম ৫০ আয়াত)।
  66. আল-মুধিল: দমনকারী, যিনি তাঁর ইচ্ছানুয়ী কাউকে সম্মানিত করেন এবং কাউকে দমন করেন। (সূরা আল-ইমরান ২৬ আয়াত)।
  67. আল-মুজিল: পৃথককারী, যিনি মানুষকে অপদেবতা এবং তাদের পূজাপার্বন থেকে পৃথক করেন। (সূরা ইউনূস ২৮-২৯ আয়াত)।
  68. আল-মুসাউয়ীর: সৌন্দর্যপিপাসু, যিনি তাঁর সৃষ্টিকে মনের মতো করে সাজান। (সূরা হাশর ২৪ আয়াত)।
  69. আল-মুইদ: সংগ্রহকারী / রক্ষাকারী, যিনি উৎপন্ন করেন এবং সুরক্ষা করেন। (সূরা বুরুজ ১৩ আয়াত)।
  70. আল-মুঈজ: সম্মানদানকারী, যিনি নিজ ইচ্ছানুযায়ী সম্মান দেন কিংবা অপমান করেন। (সূরা আলে-ইমরান ২৮ আয়াত)।
  71. আল-মুতি: দাতা, যার হাত থেকে সবকিছু আসে। (সূরা তাহা ৫০, ৫২ আয়াত)।
  72. আল-মুঘনি: ধনীকারী, যিনি তাঁর ধনভাণ্ডার থেকে মানুষকে ধনবান করেন। (সূরা তাওবা ৭৪-৭৫ আয়াত)।
  73. আল-মুকিত: যিনি সুশোভিত, সবকিছুর উপরে আপন শক্তিবলে সাজানো গুছানো। (সূরা নিসা ৮৫, ৮৭ আয়াত)।
  74. আল-মুকতাদির: ফলপ্রসূ, যিনি মন্দ লোকদের তার শক্তিবলে কাবু করেন। (সূরা কামার ৪২ আয়াত)।
  75. আল-মুকাদ্দিম: সামনে আনয়নকারী, যিনি আগেই তাঁর প্রতিজ্ঞা পাঠিয়ে দেন। (সূরা কা’ফ ২৮ আয়াত)।
  76. আল-মুকসিত: ন্যায়বিচার পর্যবেক্ষণকারী, যিনি ন্যায়বিচারের সমতা আনবেন। (সূরা আম্বিয়া ৪৭-৪৮ আয়াত)।
  77. আল-মুমিত: জীবনমৃত্যুময়, যেভাবে তিনি জীবনের কারণ সেভাবে তিনি মৃত্যুরও কারণ। (সূরা হিজর ৩২ আয়াত)।
  78. আল-মুনতাকিম: শাস্তি দানকারী, যিনি দুষ্টদের ও পাপীদের দমন এবং শিষ্টের তথা ঈমানদারগণের লালন করেন (৩০:৪৭)।
  79. আল-মুহাইমিন: উপস্থাপনকারী, সবকিছুর উপর যার সতর্ক দৃষ্টি। (সূরা হাশর ২৩ আয়াত)।
  80. আর-রশিদ: পথপ্রদর্শক, যিনি ঈমানদারগণকে সঠিক মনোভাব নিয়ে চলতে সাহায্য করেন। (সূরা হুদ ৮৭, ৮৯ আয়াত)।
  81. আর-রহমান: দয়ালু, যারা দয়া দেখায় তাদের মধ্যে সবচেয়ে দয়ালু। (সূরা ফাতিহা ৩, ১২:৬৪ আয়াত)।
  82. আর-রউফ: ভদ্র, যিনি তাঁর লোকদের প্রতি মমতা করেন। (সূরা বাকারা ১৪৩ আয়াত)।
  83. আর-রাহিম: করুণাময়, যিনি ভদ্র এবং করুণার আধার। (সূরা ফাতিহা ৩, ২:১৪৬ আয়াত)।
  84. আর-রাজ্জাক: যোগানদাতা, যিনি যোগান দেন কিন্তু কোন সুযোগ খোঁজেন না।
  85. আর-রাফি: উচ্চে উত্তোলনকারী, যিনি কাউকে দমন করেন এবং কাউকে উঁচু পদে বসান। (সূরা হূদ ৮৩ আয়াত)।
  86. আর-রাকিব: দর্শক, যিনি তাঁর সৃষ্টিকে দেখাশোনা করেন। (সূরা মায়িদা ১১৭ আয়াত)।
  87. আস-সালাম: শান্তি স্থাপনকারী, যার নাম হলো শান্তি। (সূরা হাশর ২৩ আয়াত)।
  88. আস-সামি: শ্রোতা, যিনি সব দেখেন ও শোনেন। (সূরা বনি-ইসরাইল ১ আয়াত)।
  89. আশ-শাকুর: কৃতজ্ঞ, যিনি তাঁর লোকদের সেবা আনন্দের সাথে গ্রহণ করেন। (সূরা তাগাবুন ১৭ আয়াত)।
  90. আশ-শহিদ: সাক্ষী, যিনি সবকিছুর সাক্ষী (সূরা মায়িদা ১১৭ আয়াত)।
  91. আস-সবুর: ধৈর্যশীল, যিনি তাঁর লোকদের প্রতি অতিশয় ধৈর্য ধারণ করেন।
  92. আস-সামাদ: অনন্তকালস্থায়ী, যিনি জন্মপ্রাপ্ত নন, যিনি কাউকে জন্ম দেন না। (সূরা ইখলাস ২ আয়াত)।
  93. আদ-দ্বার: সুদৃঢ়কারী, যিনি সুদৃঢ় করেন ও আশীর্বাদ দেন। (সূরা ফাত্হ ১১ আয়াত)।
  94. আজ-জাহির: বাহির, যিনি বাহির এবং ভিতর উভয় দেখাশোনা করেন। (সূরা মুহম্মদ ৩ আয়াত)।
  95. আল-আদল: ন্যায়পরায়ণ, যার কথা যথার্থতার দিক থেকে খাঁটি এবং ন্যায়পরায়ণ। (সূরা আন্’আম ১১৫ আয়াত)।
  96. আন-নাসির: সাহায্যকারী, সাহায্যকারী হিসাবে তিনিই যথেষ্ট। (সূরা নিসা ৪৫, ৪৭ আয়াত)।
  97. আন-নুর: আলো, যিনি বেহেস্ত এবং দুনিয়াকে আলোকিত করেন। (সূরা নুর ৩৫ আয়াত)।
  98. মালিক-আল-মুল্ক: রাজ্যের অধিকারী, যিনি যাকে ইচ্ছা সার্বভৌমত্ব দান করেন। (সূরা আল-ইমরান ২৬ আয়াত)।
  99. ধুল-জালাল-ওয়াল-ইকরাম: মহামান্য ও সম্মানিত প্রভু। (সূরা রাহমান ২৭ আয়াত)।

ইসলামে আল্লাহ নামটি তাঁর ব্যক্তিগত নাম যা প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। ইসলমি চিন্তাবিদদের মতে এটি আল্লাহর বেহেস্তি নাম, যার সাথে হজরত ইব্রাহিম, হজরত মুসা এবং হজরত দাউদের আল্লাহর নামের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। কোন কোন ইসলামি চিন্তাবিদের মতে, আল্লাহ শব্দটি আরবি “ইলাহা” মূল ধাতু থেকে এসেছে। আরো এগিয়ে গেলে ইলাহা শব্দটি হিব্রু এল বা এলোহিম থেকে এসেছে। এই শব্দগুলো প্রত্যেকটিতেই আল্লাহ নামের প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়। অতএব, ইসলামের আল্লাহর সাথে ঈসায়ীদের আল্লাহর সাধারণত কোন পার্থক্য নেই। তবে আল্লাহর ধার্মিকতার দিক বিশ্লেষণ করলে, আল্লাহ সম্পর্কে ঈসায়ীদের ঈমানের দিক থেকে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

ঈসায়ীরা কি এক আল্লাহ বিশ্বাস করে?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

হ্যাঁ, ঈসায়ীরা এক আল্লাহ বিশ্বাস করে এবং তাঁর এবাদত করে।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

ঈসায়ী বলতে এ দেশের অনেকেই মনে করে, তারা বিদেশি তথা ইউরোপ আমেরিকার লোক। মানুষ মনে করে, এসব বিদেশি লোকেরা সাধারণত আল্লাহ-খোদা মানে না। তারা জ্ঞান বিজ্ঞানে বিশ্বাসী; আল্লাহর অস্তিত্বকে তারা স্বীকার করে না। আসলে তা ঠিক নয়। ঈসায়ীরা যে কোন দেশের হতে পারে এবং তারা আল্লাহর অস্তিত্বকে স্বীকার করে। ঈসায়ীদের কিতাব কিতাবুল মোকাদ্দসের প্রথম খণ্ডের প্রথম আয়াতের শুরুই হলো আল্লাহকে দিয়ে। লেখা আছে, “সৃষ্টির শুরুতেই আল্লাহ আসমান ও জমিন সৃষ্টি করলেন” (পয়দায়েশ ১:১)। এরপর এই কিতাব পড়ে পড়ে আরো অগ্রসর হলে দেখা যায়, এই পৃথিবীর সবকিছুই আল্লাহ পর্যায়ক্রমে সৃষ্টি করেছেন। সবার সৃষ্টিকর্তা হিসেবে তিনি মানুষের বাধ্যতা এবং এবাদত চান। তার প্রমাণ পাওয়া যায়- তিনি আদন বাগানে হজরত আদম ও হাওয়ার কাছ থেকে বাধ্যতা কামনা করেন এবং তাঁদের ছেলে হাবিলের কোরবানি গ্রহণের মাধ্যমেও আমরা বুঝতে পারি যে, তিনি মানুষের এবাদত আশা করেন। আল্লাহ চান যেন মানুষ নৈতিক নিয়ম শৃঙ্খলা মানে, সৎ ও ন্যায়পারায়ন হয়। যার ফলে, হজরত নুহ (আ.) এর সময়কার বন্যার কথা এবং হজরত মুসা (আ.) এর দেওয়া বিখ্যাত ১০ হুকুম আমাদের তা-ই মনে করিয়ে দেয়। এছাড়া হজরত ইব্রাহিম, ইয়াকুব, দাউদ প্রমুখ নবিদের মাধ্যমেও আল্লাহ তাঁর অস্তিত্বকে তুলে ধরেছেন। আর তা কিতাবুল মোকাদ্দসে বর্ণিত আছে এবং ঈসায়ীরা তা বিশ্বাস করে।

একথা সত্য যে ইউরোপ, আমেরিকার লোকদের মধ্যে অনেক নাস্তিকও রয়েছে, যারা আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। তাদের মধ্যে কেউ কেউ জ্ঞানবাদী, কেউ কেউ বস্তুবাদী আবার কেউ কেউ কোন বাদীই নয়। তবে এদের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। আবার যারা একেশ্বরবাদী, তাদের মধ্যে সবাই যে সম্পূর্ণ কিতাবি সত্য অনুসারে চলে, তা-ও নয়। অনেকের মা-বাবা ঈসায়ী ঈমানের পথে চলতো; আর সেই কারণে কিছু পারিবারিক ও সামাজিক নিয়ম-কানুন মানে, সেই হিসাবেও কেউ কেউ ঈসায়ী পরিচয় দেয় এবং এক আল্লাহতে বিশ্বাসী বলে দাবি করে। সার্বিক অর্থে বলা যায় ঈসায়ীরা মূলত: একেশ্বরবাদী।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০