Category Archives: ঈসা মসীহ্‌

ঈসা মসীহ সম্পর্কে নবিগণ কী কী বলেছেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর: নবিগণ হজরত ঈসা মসীহ সম্পর্কে তাঁর জন্মের আগের ঘটনা থেকে শুরু করে জন্ম, কাজ, মৃত্যু, পুনরুত্থান, বেহেস্তে চলে যাওয়া এবং শেষকালে ফিরে আসার সকল কথাই বলেছেন।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

হজরত ঈসা মসীহ সম্পর্কে হজরত মুসা, হজরত দাউদ, হরজত ইয়ারমিয়া, হজরত ইশাইয়া, হজরত দানিয়াল, হজরত যোয়েল, হজরত মিখা, হজরত ইয়াহিয়া প্রমুখ নবিগণ নানা ভবিষ্যতবাণী করেছেন। তারা কেউ কেউ তাঁর জন্মের আগে ও জন্মের পরের অনেক ঘটনাবলি নিয়ে, ভবিষ্যতবাণী করেছেন। নবিগণ এত খুটিনাটি বিষয়ে ভবিষ্যতবাণী করেছেন যে, তা বিস্ময়কর। উদাহরণস্বরূপ, তাঁর জন্মের আগে তাঁর পথপ্রস্তুতির জন্য কেন জন্মাবেন, কী রকম মায়ের গর্ভে জন্মাবেন, তাঁর জন্ম কোথায় হবে, কীভাবে হবে, জন্মের সময় কী দুর্ঘটনা ঘটবে, শিশুকাল কীভাবে কাটবে, যৌবন কালে তিনি কী কী করবেন, তাঁর বিরুদ্ধে কী কী হবে, তাঁর বিচার কেন হবে, বিচারের রায় কী হবে, তাঁর মৃত্যু কীভাবে হবে, কেন হবে, কোথায় কবর দেয়া হবে, কবর থেকে তিনি কী করবেন, অবশেষে তিনি কোথায় যাবেন এবং আবার যে দুনিয়াতে ফিরে আসবেন ইত্যাদি সব ঘটনাই নবিরা এক এক করে সব বলে গেছেন। হজরত ঈসার ৩৩ বছরের জীবন কালের প্রায় প্রত্যেকটি ঘটনাই নবিরা বলে গেছেন।

সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো নবিগণ তাঁর এই দুনিয়াতে আগমনের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্যের কথাও বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, হজরত ঈসা গুনাহগার মানুষকে তাদের গুনাহ থেকে উদ্ধার করতেই এই দুনিয়াতে আসবেন। তাঁরা বলেছেন, তিনি নিষ্পাপ হিসাবে জন্ম গ্রহণ করবেন এবং নিজেকে পাপী মানুষের কাফফারা হিসাবে আল্লাহর কাছে উৎসর্গ করবেন। তাঁর এই কাফফারার মধ্যদিয়ে গুনাহগার মানুষকে আল্লাহ নির্দোষ হিসাবে ধরবেন।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

হজরত ঈসা কি ১২০ বছর বেঁচেছিলেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

না, ১২০ বছর নয়, হজরত ঈসা মাত্র ৩৩ বছর দুনিয়াতে বেঁচেছিলেন।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

অবধারিত সত্য – আহমদিয়া মতবাদ অনুসারে হজরত ঈসা ১২০ বছর বেঁচেছিলেন এবং ভারতে গিয়ে স্বাভাবিক মৃত্যু বরণ করেছেন। সুতরাং তাদের মতে তাঁর ৩৩ বছর বয়সের ক্রুশীয় মৃত্যু কাল্পনিক গল্পমাত্র। আহমদিয়া বা কাদিয়ানি মতবাদীদের প্রধান লক্ষ্য ক্রুশধ্বংস। কিতাবি সত্য অনুযায়ী, আসলে এটা ইব্লিশের ইচ্ছা ছিল যেন ক্রুশের সত্যকে ধবংস করা যায়। কিন্তু যে সত্যের উপর ভিত্তি করে ঈসায়ী ঈমান ও আমল প্রতিষ্ঠিত, সেই চিরস্থায়ী সত্যকে খোঁড়া যুক্তি দিয়ে বিযুক্ত করা যায় না। হজরত ঈসার দুনিয়াতে আগমনের উদ্দেশ্যই ছিল মৃত্যুবরণ। তিনি বেঁচে থাকতে সরাসরি তিনবার উদাহরণ হিসাবে, আরো চারবার নানা দৃষ্টান্তের মধ্যদিয়ে তাঁর মৃত্যুর বিষয়ে সরাসরি বলেছেন। প্রাচীনকালের নবিরা তাঁর যন্ত্রণাদায়ী মৃত্যুর বিষয়ে ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। জন্মের ছয়মাস আগে হজরত ইয়াহিয়া এসে তাঁর মৃত্যুদায়ী কোরবানির কথা ঘোষণা করেছিলেন। অতএব, তাঁর মৃত্যু যে অবধারিত সত্য এতে কোন সংশয় থাকার অবকাশ নেই।

ঐতিহাসিক ঘটনা – রোমীয় শাসনকর্তা একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি যিনি হজরত ঈসার মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছিলেন। কিতাব বলে, তিনি কোন দোষ পান নি তাই হাত ধুয়ে, ‘এই মৃত্যুর জন্য তিনি দায়ী নন’ বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। রাজা হেরোদ এবং আগ্রিপাস ছিলেন ঐতিহাসিক ব্যক্তিবর্গ। তারা একই সময়ে বাস করতেন এবং হজরত ঈসার মৃত্যুর ঘটনার সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন। হজরত ঈসা মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে ওঠার ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন বলে রোমীয় কর্তৃপক্ষ হজরত ঈসার কবর পাথর দিয়ে সীলমোহর করে দিয়েছিলেন। হজরত ঈসার মৃত্যুর বিষয়টি ইহুদি ও ফরিশিদের বিশ্বাসের পরিপন্থি বলে, তারা গোপনে পাহারা দিয়েছিলেন। এই মৃত্যু যদি সত্য না হতো তবে এতো ব্যবস্থার কী প্রয়োজন ছিল?

কাদিয়ানিদের দাবি অনুযায়ী, হজরত ঈসা ১২০ বছর পর মৃত্যু বরণ করলে, তাঁর পুনরুত্থানের বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্য করা যাবে। নবিরাসহ হজরত ঈসা কেবল তাঁর মৃত্যুর ভবিষ্যতবাণীই করেননি, পুনরুত্থানের ভবিষ্যতবাণীও করেছিলেন। এছাড়া মসলা নিয়ে কবরের কাছে মহিলাদের যাওয়া, মসীহের দেখা পাওয়া, সাহাবিদের খবর দেওয়া, পাকরুহের জন্য অপেক্ষা করার কথা বলা এবং সাহাবিদের সামনে তাঁর বেহেশতে চলে যাওয়া ইত্যাদি সব ঘটনাই হজরত ঈসার ৩৩ বছর বয়সেই সংঘটিত হয়েছে এবং অনেক সাক্ষীর সামনেই হয়েছে। হজরত ঈসা যদি সেই সময় মৃত্যু বরণ না করতেন, তবে তিনি নিশ্চয় পরবর্তিতে তাঁর মৃত্যু ও পুনরুত্থানের কথা বলতেন না। অতএব, হজরত ঈসা ১২০ বছর বেঁচে থাকবার কাহিনী একটি কাল্পনিক গল্পমাত্র যা সত্যের ধারেকাছে নেই।

কোরানের দৃষ্টিতে ঈসা মসীহ কে?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

কোরানের দৃষ্টিতে হজরত ঈসা আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত পূর্ববর্তী নবির সমর্থক ও পথ প্রদর্শক।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

সুরা আলে-ইমরান (৩:৪৯) অনুসারে হজরত ঈসা আল্লাহ কর্তৃক প্রেরিত হয়েছেন যা ইঞ্জিল শরিফের বহু নিকট ভবিষ্যতবাণীর সাথে মিলে যায়। কোরান শরিফে হজরত ঈসাকে আল্লাহর রসুল ও তাঁর বাণী বলেও অবহিত করা হয়েছে (সুরা নিসা ৪:১৭১)। রসুল মানে পথপ্রদর্শক। এ থেকে বোঝা যায়, হজরত ঈসা মানুষের পথপ্রদর্শক হিসাবে এসেছিলেন শুধু তা নয়, তিনি আল্লাহর কালাম হয়ে নেমে এসেছিলেন। ইঞ্জিল শরিফও একই কথা বলে। ইউহোন্না ১:১ আয়াতে বলা হয়েছে, প্রথমে কালাম ছিলেন আর কালাম আল্লাহর সঙ্গে ছিলেন। একই অধ্যায়ের ১৪ আয়াতে বলা হয়েছে, সেই কালাম মাংসে রূপান্তরিত হয়ে, দুনিয়াতে আসলেন। ব্যাখ্যাটা কোরান শরিফে দেওয়া হয়নি।

কোরান শরিফে হজরত ঈসার আশ্চর্য জন্ম এবং অলৌকিক জীবন যাপন সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে। বলা হয়েছে, তিনি জন্মের পরপর শিশু অবস্থায় কথা বলতেন, পাখি বানিয়ে জীবন দিতেন, অসুস্থকে সুস্থ করতেন এবং মৃত মানুষকে জীবন দিতেন। কোরানের দৃষ্টিতে হজরত ঈসা একজন অসাধারণ নবি।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

হজরত ঈসা কি দ্বিতীয় আগমনের পর মৃত্যুবরণ করবেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

না, তিনি মৃত্যুবরণ করবেন না, করতে পারেন না। কারণ তিনি মৃত্যুকে জয় করেছেন।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

হজরত ঈসা নিষ্পাপ, তার মৃত্যু হতে পারে না। অন্যদের গুনাহর কাফফারা হিসাবে তিনি নিজেকে মৃত্যুর হাতে সমর্পণ করলেও মৃত্যুকে জয় করে তিনি কবর থেকে উঠেছেন। তিনি আর মৃত্যুবরণ করবেন না। তিনি যদি মৃত্যুবরণ করেন তবে সম্পূর্ণ ইঞ্জিল শরিফই মিথ্যা হয়ে যাবে। ইঞ্জিল শরিফে পরিষ্কার এ কথা লেখা আছে যে, “তিনি যখন দ্বিতীয়বার আসবেন তখন গুনাহের জন্য মরতে আসবেন না, বরং যারা তাঁর জন্য আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করে আছে, তাদের সম্পূর্ণভাবে নাজাত করাবার জন্য আসবেন” (ইবরানী ৯:২৮)। একথা আবারও জোর দিয়ে বলছি যে, মানুষের গুনাহর কাফফারা দিতে গিয়ে তিনি একবার মৃত্যুবরণ করেছিলেন। সেই মৃত্যু তাঁর নিজের গুনাহর জন্য মৃত্যু নয়, বরং আমাদের গুনাহর জন্য মৃত্যু। তার প্রমাণস্বরূপ তিনি তৃতীয়দিন কবর থেকে জীবিত হয়ে উঠেছিলেন। সবচেয়ে বড়কথা, পুনরুত্থান হলো ঈসায়ী জীবনের ভিত্তি। আর সেই একই মৃত্যু যদি তিনি আবার বরণ করেন তবে ইঞ্জিল শরিফের শিক্ষাই বিফল হবে। তাঁর মৃত্যু হওয়া তো দূরের কথা বরং পুরো মৃত্যুর ব্যবস্থাকেই তিনি ধ্বংস করবেন। অর্থাৎ হজরত ঈসার উপর যারা ঈমান আনে, তাদের আর কখনও মৃত্যু হবে না। কিতাবে লেখা আছে, “শেষ শত্রু যে মৃত্যু, তাকেও ধ্বংস করা হবে” (১ করিন্থীয় ১৫:২৬)। হজরত আদম এবং তাঁর রক্তে জন্মগ্রহণকারী প্রত্যেকের মৃত্যু হবে, কারণ হজরত আদম মাটি দিয়েই তৈরি ছিলেন কিন্তু হজরত ঈসা ছিলেন মাটি ও রুহের তৈরি। তিনি বেহেশত থেকে এসেছিলেন আর বেহেশতেই চলে গিয়েছেন (১ করিন্থীয় ১৫:৪৫-৪৮)। কিতাবি সত্য হলো, হজরত ঈসা দ্বিতীয়বার ফিরে আসার পর ১০০০ (্এক হাজার) বছর রাজত্ব করবেন; সেই রাজত্ব শান্তির রাজত্ব। সেই রাজ্যের রাজা হবেন তিনি নিজে এবং প্রজা হবেন তাঁর উম্মতেরা।

তারপরে আসবে শেষবিচার। আর সেই বিচারে কেউ অনন্ত দোজখের জন্য এবং কেউ অনন্ত বেহেশতের জন্য মনোনীত হবেন। আল্লাহর কালাম বলে, মানুষের জন্য একবার মৃত্যু তারপর বিচারের ব্যবস্থা আছে। ঈসায়ীদের বিশ্বাস, হজরত ঈসা একবার মারা গিয়েছিলেন। তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠেছেন। তিনি আর কখনও মারা যাবেন না বরং অনন্তকাল বেঁচে থাকবেন।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

হজরত ঈসা কি মুসলমান ছিলেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

না, জাতিগতভাবে হজরত ঈসা মুসলমান ছিলেন না। বংশের দিক থেকে তিনি ছিলেন ইহুদি; তবে তাঁকে মুসলমান বলতে দোষের কিছু নেই।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

কিতাব থেকে জানা যায়, হজরত ঈসার মা-বাবা দু’জনই ইহুদি ছিলেন। ইঞ্জিল শরিফে আছে, ‘ইউসুফ ছিলেন বাদশাহ্ দাউদের বংশের লোক। বাদ্শাহ দাউদের জন্মস্থান ছিল এহুদিয়া প্রদেশের বেথেলহেম গ্রামে। তাই ইউসুফ নাম লেখাবার জন্য গালীল প্রদেশের নাসরত গ্রাম থেকে বেথেলহেম গ্রামে গেলেন। মরিয়মও তাঁর সঙ্গে সেখানে গেলেন’ (লূক ২:৪,৫)। আরো লেখা আছে, ‘ঈসা মসীহ দাউদের বংশের এবং দাউদ ইবরাাহিমের বংশের লোক’ (মথি ১:১)। হজরত ঈসা ছোটবেলা থেকেই ইহুদি নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন। লেখা আছে, ‘পরে মুসার শরিয়ত মতে তাঁদের পাকসাফ হবার সময় হলো। তখন ইউসুফ ও মরিয়ম ঈসাকে মাবুদের সামনে উপস্থিত করবার জন্য তাঁকে জেরুজালেম শহরে নিয়ে গেলেন’ (লূক ২:২২)। তিনি শুধু একবারই যে এ নিয়ম পালন করেছিলেন তা নয়; লেখা আছে, ‘উদ্ধার-ঈদের সময়ে ঈসার মা-বাবা প্রত্যেক বছর জেরুজালেমে যেতেন। ঈসার বয়স যখন বরো বছর, তখন নিয়ম মতোই তাঁরা সেই ঈদে গেলেন’ (লূক ২:৪১)। হজরত ঈসা তাঁর ৩০ বছর বয়সে তরিকাবন্দি গ্রহণ করে তাঁর কাজ শুরু করেন। তিনি যে নিয়মিত ইহুদি মজলিশখানায় যেতেন তাঁর প্রমাণও মেলে। লেখা আছে, ‘আর এক বিশ্রামবারে ঈসা মজলিস-খানায় গিয়ে শিক্ষা দিচ্ছিলেন’ (লূক ৬:৬)। হজরত ঈসার জীবনের শেষ দিকেও আমরা দেখতে পাই, তিনি তাঁর জাতীয় নিয়মগুলো ভালোভাবে পালন করতেন। কিতাবে লেখা আছে, ‘খামিহীন রুটির ঈদের দিনে, উদ্ধার-ঈদের ভোজের জন্য ভেড়ার বাচ্চা জবাই করা হতো। সেই দিনটা উপস্থিত হলে পর, ঈসা পিতর ও ইউহোন্নাকে এই বলে পাঠিয়ে দিলেন, “তোমরা গিয়ে আমাদের জন্য উদ্ধার ঈদের ভোজ প্রস্তুত কর যেন আমরা তা খেতে পারি (লূক ২২:৭,৮)।

মুসলমান সেই ব্যক্তি, যার জীবনে শান্তি আছে; আর যিনি আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণকারী। হজরত ঈসা বলেছিলেন, আমি শান্তি দিতে এসেছি, আমারই শান্তি আমি তোমাদের দিচ্ছি। প্রকৃতই তিনি শান্তি দিতে এসেছিলেন, আর মানবজাতির শান্তির জন্য নিজেকে আল্লাহর কাছে সমর্পণ করেছিলেন। কিতাবে লেখা আছে, ‘তিনি বরং গোলাম হয়ে এবং মানুষ হিসাবে জন্মগ্রহণ করে, নিজেকে সীমিত করে রাখলেন। এছাড়া চেহারায় মানুষ হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত, এমন কি ক্রুশের উপরে মৃত্যু পর্যন্ত বাধ্য থেকে তিনি নিজেকে নিচু করলেন’ (ফিলিপীয় ২:৭,৮)। ঈসা মসীহ আল্লাহর উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দেখ, আমি তোমার ইচ্ছা পালন করতে এসেছি’ (ইবরানি ১০:৯)। সত্যই তাই, আল্লাহর ইচ্ছায় হজরত ঈসা আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিলেন আর মানবজাতির উদ্ধারের জন্য নিজের জীবন কোরবানি দিয়েছিলেন। অতএব, তাঁকে একজন শ্রেষ্ঠ মুসলমান বলা যায়।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

ঈসা নবিতো বিয়ে করেননি, তিনি কীভাবে একজন পরিপূর্ণ শিক্ষক হতে পারেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

প্রকৃত শিক্ষা আল্লাহর কালামের জ্ঞান থেকেই আসে। তিনি জ্ঞানে পূর্ণ ছিলেন, তাই শিক্ষা দিতে পারেন।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

এই প্রশ্নটি এমনিই যে, শিক্ষা দিতে হলে শিক্ষককে সকল বিষয়ে আদর্শ হতে হবে। একদিক থেকে প্রশ্নটি যথার্থ, অপরদিক থেকে প্রশ্নটিই প্রশ্নসাপেক্ষ। এই প্রশ্নটি এজন্য করা হয়ে থাকে যে, যেহেতু তিনি স্বামী হননি অর্থাৎ যেহেতু স্বামী-স্ত্রী কিংবা বিবাহিত জীবনের জ্ঞান হজরত ঈসার নেই সেহেতু তিনি পরিপূর্ণ শিক্ষক নন। একথা সত্য যে, হজরত ঈসা বিয়ে করেন নি। তাই বলে যে তিনি সকল মানুষকে শিক্ষা দেবার অধিকার রাখেন না, তা বলা যায় না। প্রত্যেক নবিকে যদি প্রত্যেক রকম আদর্শ হতে হতো তবে কোন নবি বা শিক্ষকই প্রকৃত শিক্ষক হতে পারতেন না। উদারহণ স্বরূপ, নবিরা বেশির ভাগই ছিলেন পুরুষ; তবে কি উত্তম শিক্ষক হতে হলে, তাঁদের সকলকে মেয়ে হতে হতো না? এছাড়া অবিবাহিতদের সম্পর্কে কী বলা যেতো? রাজাদের সম্পর্কে কী বলা যেতো? জেলে, তাঁতী, ধনী, ব্যবসায়ী? তিনি যদি বিয়ে করতেন তবে অবিবাহিতদের তিনি কী করে আদর্শ শিক্ষা দিতেন?

হজরত ঈসা মানুষকে জাগতিক জ্ঞানে জ্ঞানী করে তোলার জন্য এই দুনিয়াতে আসেন নি। জাগতিক জ্ঞানগুলো মানুষ প্রকৃতিগতভাবেই অর্জন করে। মানুষ দেখে দেখে, বুঝে বুঝে শেখে। হজরত ঈসা এসেছিলেন যেন মানুষ জীবন পায় এবং জীবনের উপচয় পায়। সেইজন্য তিনি মানুষকে জীবনের অতি প্রয়োজনীয় বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন। এছাড়া নবিরা মানুষের কিংবা নিজের জ্ঞানে কথা বলেন না। তাঁরা আল্লাহর পাকরুহ দ্বারা পরিচালিত হয়ে, আল্লাহ নিজে যা চান তাই শিক্ষা দেন। সুতরাং ছোট-বড়, পুরুষ-মহিলা, স্বামী-স্ত্রী, জ্ঞানী-মূর্খ সকলকে নবিরা শিক্ষা দিতে পারেন। নবিদের যোগ্যতা হলো, তাঁরা আল্লাহর ইচ্ছামতো চলেন এবং আল্লাহর ইচ্ছায় শিক্ষা দেন।

হজরত ঈসার বারো বছর বয়সে যখন তার মা-বাবার সাথে জেরুজালেম এবাদতখানায় গিয়েছিলেন, তখন বাঘা বাঘা ইহুদি আলেমরা তাঁর পাণ্ডিত্যে ও জ্ঞানে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলেন। বড় হয়ে যখন তিনি সমাজগৃহে ও এবাদতখানায় শিক্ষা দিতেন, তখনও তাঁর চেয়ে অভিজ্ঞ ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা হার মানতেন এবং বুঝতেন যে, তিনি এমনভাবে শিক্ষা দেন যার শিক্ষা দেবার অধিকার আছে। অনেক কুটিল এবং জটিল প্রশ্নেরও এমন উত্তর দিতেন যে, সবাই হা হয়ে যেতো এবং তাঁর সামনে মুখ তুলে দাঁড়াতে সাহস করতো না। আধুনিক যুগের বড় বড় পণ্ডিত, শিক্ষক ও দার্শনিকরা তাঁর শিক্ষার উদাহরণ দেন। মহাত্মা গান্ধী হজরত ঈসার শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘হে দারিদ্র্য তুমি মোরে করেছ মহান, তুমি মোরে দানিয়াছ খ্রিস্টের সম্মান।”

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

হজরত ঈসা নিজে মানুষ হয়ে কীভাবে মানুষকে নাজাত দিতে পারেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

তিনি নাজাত দিতে পারেন কারণ তিনিই একমাত্র নিষ্পাপ মানুষ ছিলেন।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

একথা ধ্রুব সত্য যে, হজরত ঈসা একজন মানুষ ছিলেন। ঈসায়ী ইতিহাসে দেখা যায় কেউ কেউ ‘তিনি মানুষ নন, আত্মা কিংবা অন্যকিছু’ হিসেবেও আখ্যায়িত করতেন। কেউ কেউ তাঁকে অতিমানব হিসেবে এমনকি অনেকে তাঁকে জিনদের সমগোত্রীয় কিছু বলে প্রচার করতেন। এখনও বিশ্বব্যাপী হজরত ঈসার অস্তিত্ব নিয়ে নানা মুণির নানা মত রয়েছে। কিন্তু আমাদের দেখতে হবে কিতাব কি বলে। ইঞ্জিল শরিফে তাঁর যে বংশ তালিকা দেওয়া হয়েছে (লূক ৩:২৩-৩৮) তাতে হজরত ঈসার জাগতিক পিতা ইউসুফ থেকে শুরু করে, হজরত আদম পর্যন্ত চলে গিয়েছেন। মানুষ হিসেবেই তিনি কোন এক মায়ের গর্ভে জন্মেছিলেন, লালিত পালিত হয়েছিলেন, জ্ঞানে ও বয়সে বেড়ে উঠেছিলেন, খাওয়া-দাওয়া করেছিলেন, মানুষের সুখ-দুঃখ অনুভব করেছিলেন, সামাজিক অনুষ্ঠানাদিতে যোগ দিয়েছিলেন এবং মানুষ হিসেবেই তিনি কষ্টকর মৃত্যু গ্রহণ করেছিলেন। হজরত ঈসা নিজেও নিজেকে ইবনেআদম বা মানবপুত্র বলতেন।

এখন প্রশ্নের মৌলিক অংশ হলো, মানুষ হয়েও কী করে হজরত ঈসা মানুষকে গুনাহ থেকে নাজাত দিতে পারেন। হজরত ঈসা নিজেই বলেছেন যে, অন্ধ অন্ধকে পথ দেখাতে পারে না, দুইজনই গর্তে পড়ে। একজন মানুষও তেমনি আর একজন মানুষকে নাজাত দিতে পারে না, কারণ মানুষ পাপী। হজরত ঈসা যদি একজন মানুষ হন তবে কীভাবে তিনি নাজাত দেবেন? এর রহস্য এখানেই যে, হজরত ঈসা একজন আসল মানুষ অর্থাৎ খাঁটি মানুষ ছিলেন, পাপী ছিলেন না। মানুষকে আল্লাহ যে গুণ (সুরত ও সিফত) দিয়ে সৃষ্টি করেছিলেন হজরত ঈসার মধ্যে তার সবটুকুই ছিল। অথচ সুরত থাকলেও আসল জিনিস যে সিফত তা হজরত আদম অর্থাৎ প্রথম মানুষ অবাধ্যতার মধ্য দিয়ে হারিয়ে ফেলেছিলেন। আর হারিয়ে ফেলেছিলেন বলে, অন্যকে নাজাত দেওয়া তো দূরের কথা নিজেই আল্লাহর কাছ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। ফলে মানব বংশে যারা জন্ম লাভ করেছে, তাদের প্রত্যেকেই হজরত আদমের মতো গুনাহগার হয়েছে। হজরত ঈসা মানব বংশে জন্ম গ্রহণ করলেও আল্লাহর অসীম কুদরতের ফলে তাঁকে পাপ স্পর্শ করতে পারে নি।

হজরত ঈসা ছিলেন নিষ্পাপ মানুষ। আর এই নিষ্পাপ মানুষ স্বেচ্ছায় নিজের প্রাণ দিতে রাজি হয়েছিলেন যেন আমাদের উদ্ধার করতে বা নাজাত দিতে পারেন। অন্যান্য নবিগণ শরিয়তের কথা বলেছেন, শিক্ষা দিয়েছেন, আশ্চর্য কাজ করেছেন কিন্তু কেউই মানুষের নাজাতের জন্য কোরবানি হননি। অবশ্য এটা তাঁদের কাজ এবং দায়িত্বও ছিল না। এই কারণে ফেরেশ্তা বিবি মরিয়মের কাছে গিয়ে, তাঁর নামও রেখেছিলেন ঈসা, যার মানে নাজাতদাতা। রাখালদের সংবাদ দিতে গিয়ে ফেরেশতা বলেছিলেন, ‘তোমাদের জন্য আজ দাউদের শহরে উদ্ধারকর্তা জন্মেছেন’। সুতরাং তিনি নাজাত দিতে না পারলে মানুষের নাজাত আর কার দ্বারা সম্ভব হবে? আমরা গান গাই, ‘আর কোন নাম নাই যে নামে নাজাত পাই’।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

ঈসা মসীহ কি নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করেছেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

হজরত ঈসা নিজে কখনও বলেননি যে, ‘আমি নিজেই আল্লাহ’। কিন্তু আল্লাহর সব গুণাবলী তাঁর মধ্যে ছিল।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

হজরত ঈসা নিজেকে কখনও আল্লাহ বলে দাবি করেননি। এরূপ দাবি করলে তিনি কুফরি করতেন বরং তিনি আল্লাহর অধীনতা প্রকাশ করে নিজেকে আল্লাহর কাছে নত করেছেন। তাঁকে যখন সৎগুরু উল্লেখ করে তৎকালীন লোকেরা প্রশ্ন করতেন তখন তিনি বলতেন, ‘আমাকে কেন সৎ বলছ? সৎ কেবল একজনই আছেন।’ কেয়ামতের সময় সম্পর্কে সাহাবিরা জানতে চাইলে তিনি বলতেন, সেই সময় সম্পর্কে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না। সাহাবিরা যখন মুনাজাত করতে শিক্ষা দেবার জন্য হজরত ঈসা মসীহকে অনুরোধ করেছিলেন তখন শিক্ষা দিয়েছিলেন, তোমরা এইভাবে মুনাজাত করো, ‘হে আমাদের বেহেস্তি পিতা’। উপরিউক্ত উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায় তিনি সব সময় আল্লাহকে যথার্থ সম্মান দান করেছেন।

আমরা জানি হজরত ঈসা নিজে ইহুদি ছিলেন। ইহুদি ধর্মের প্রধান হুকুমগুলোর একটি হলো আল্লাহকে স্বীকার করা এবং সম্মান করা। তিনি নিজে তা মেনেছেন এবং অন্যদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, আমাদের মাবুদ আল্লাহ এক, যা ছিল তাওরাত কিতাবের প্রধান শিক্ষা। অতএব, তিনি যদি নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করতেন তবে আল্লাহর বিরুদ্ধেই কাজ করতেন। একবার শয়তান হজরত ঈসাকে পরীক্ষায় ফেলতে এসে বলেছিল, ‘তুমি পাহাড়ের উপর থেকে লাফিয়ে পড়, তোমার কোন ক্ষতি হবে না।’ তখন শয়তানকে হজরত ঈসা বলেছিলেন, ‘তোমার মাবুদ আল্লাহকে তুমি পরীক্ষা করতে যেয়ো না।’ আল্লাহকে বরং হজরত ঈসা পিতা বলে ডাকতেন এবং পিতার মতোই সম্মান করতেন। নিশ্চিত মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়ে যিনি বলেছিলেন, ‘পিতা আমার ইচ্ছা নয় বরং তোমার ইচ্ছাই সিদ্ধ হোক’, তাহালে তিনি কীভাবে নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করতে পারেন?

তিনি নিজেকে আল্লাহ বলে দাবি করেন নি সত্য কিন্তু কালাম বলে যে, তিনি ‘আল্লাহর সমান থাকা আঁকড়ে ধরে রাখবার মতো এমন কিছু করেন নি’। এই কথাকে আমরা কেমন করে ব্যাখ্যা করব? এদ্বারা তো এটাই বোঝা যায় যে, একসময় তিনি আল্লাহর সমান ছিলেন। পরে নিজেকে নিচু করলেন। পাককালামের অন্যত্র আছে, ‘এই পুত্রই হলেন অদৃশ্য আল্লাহর হুবহু প্রকাশ’। যদি তা না হবেন তবে আমরা কেমন করে এই আয়াত বুঝব, ‘প্রথমেই কালাম ছিলেন, কালাম আল্লাহর সঙ্গে ছিলেন এবং কালাম নিজেই আল্লাহ ছিলেন’? হজরত ঈসার জন্মের সময় ফেরেশতার দেওয়া দু’টো নাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি ঈসা, যার মানে নাজাতদাতা আর দ্বিতীয়টি হলো, ‘ইম্মানুয়েল’ যার মানে আমাদের সাথে আল্লাহ। হজরত ঈসা নিজেই সাক্ষ্য দিয়ে বলেছেন, যে আমাকে দেখেছে সে পিতাকে দেখেছেন।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

হজরত ঈসার পুনরুত্থানের রহস্য কী? আসলেই কি তিনি মৃত্যু থেকে পুনর্জীবিত হয়ে উঠেছেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

হজরত ঈসার পুনরুত্থান কোন রহস্য নয়। বাস্তবিকই তিনি মৃত্যু থেকে পুনরুত্থিত হয়েছেন।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

একদিক থেকে ভাবলে মসীহের পুনরুত্থান এক বিরাট রহস্য। প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম হচ্ছে মৃত্যু। ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা রবে?’ চারণ কবির এই ছত্রকে ভুল প্রমাণিত করে আর এক জ্বলন্ত সত্যকে হজরত ঈসা মসীহ বাস্তবায়ন করেছেন। সেই জ্বলন্ত সত্য হলো নিষ্পাপকে কবরস্থ করে রাখা যায় না। ইঞ্জিল কিতাবে লেখা আছে, “গুনাহের বেতন মৃত্যু” (রোমীয় ৩:২৩)। আমরাও কথায় কথায় বলি, ‘লোভে পাপ পাপে মৃত্যু’। আসলেই তাই, গুনাহর কারণেই এই দুনিয়াতে মৃত্যু এসেছে। কিন্তু হজরত ঈসা তো গুনাহর স্বাদ গ্রহণ করেননি, তবে কি করে তাঁর মৃত্যু হবে। এজন্য তিনি জীবিত থাকাকালে নিজেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছিলেন যে, তিনি মৃত্যু থেকে জীবিত হয়ে উঠবেন। তিনি ইউনুস নবির উদাহরণ দিয়ে বলেছিলেন, ইউনুস যেমন তিনদিন মাছের পেটে ছিলেন তেমনি তিনিও তৃতীয় দিবসে কবর থেকে উঠে আসবেন।

সাহাবিদের জীবন পরিবর্তন: মানুষ যত বেশি মানসিক শক্তির অধিকারী হোক না কেন, মৃত্যুর কাছে হার মানতে বাধ্য। হজরত ঈসা মসীহের সাহাবিরা তাঁর যন্ত্রণাদায়ী মৃত্যুতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন এবং অনেকে পালিয়ে গিয়েছিলেন। হজরত ঈসার সাহাবি পিতর মসীহকে প্রাণের ভয়ে অস্বীকার করেছিলেন। সেই একই পিতর যখন দেখলেন যে হজরত ঈসা কবর থেকে উঠেছেন তখন তাঁর জীবনে এমন পরিবর্তন এসেছিল যে, তিনি মৃত্যুর মুখে যেতে ভয় পান নি। এমন কি রোমীয় শাসনকর্তাদের বিরুদ্ধে হজরত ঈসাকে মৃত্যুদণ্ড দেবার জন্য অভিযুক্ত করে বক্তব্য দিয়েছিলেন। এই কারণে অত্যাচারিত ও নির্যাতিত হতে কখনও আর পিছ পা হননি; অবশেষে সাক্ষ্য দিতে দিতে তিনি মৃত্যুবরণ করতেও প্রস্তুত ছিলেন এবং মৃতুকে আলিঙ্গন করেছেন। মূলত সাহাবিদের ভগ্নপ্রায় ঈমান এই পুনরুত্থানের মধ্য দিয়েই চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল।

তাঁর বেহেস্তে চলে যাওয়া: একেশ্বরবাদীদের প্রায় সকলেই জানে ও বিশ্বাস করে যে, ঈসা মসীহকে আকাশে তুলে নেয়া হয়েছে। যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেয়া হয় যে, তিনি মৃত্যু থেকে উঠেননি, তবে তিনি কীভাবে আসমানে উঠে গেলেন? মানব বংশে জন্মগ্রহণকারী হিসাবে সকল মানুষের মৃত্যু তো অবধারিত। এও তো প্রাকৃতিক নিয়ম। ইঞ্জিল শরিফ অনুসারে হজরত ঈসা মানুষ হিসাবে জন্মেছিলেন, আর প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে আমাদের হয়ে তিনি মৃত্যু বরণ করেছিলেন। যেহেতু তিনি নিজে নিষ্পাপ ছিলেন সেহেতু মৃত্যুর সাধ্য ছিল না তাঁকে ধরে রাখার। কবর থেকে জীবিত হয়ে ওঠার পর তিনি ৪০ দিন যাবৎ পৃথিবীতে ছিলেন এবং একসাথে ৫০০এরও বেশি লোককে দেখা দিলেন। অতপর সাহাবিদের সামনেই তিনি আসমানে উঠে গেলেন।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

ঈসা মসীহ কি কোন নির্দিষ্ট জাতির জন্য এসেছেন?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

না, তিনি সকল মানুষের জন্যই এসেছেন।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

অনেকে এই প্রশ্ন করে যে, হজরত ঈসা তো ইসরাইল জাতির জন্য এসেছেন, তবে কেন আমরা তাঁকে সকল মানুষের নাজাতদাতা বলি? একদিক থেকে এটা যথার্থ যে হজরত ঈসা বনি ইসরাইল জাতির জন্য এসেছিলেন। আল্লাহ তাঁর লোকদের উদ্ধারের জন্যই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন এবং সেই প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী মসীহকে পাঠিয়েছেন। এর স্বপক্ষে যুক্তির জন্য যে আয়াতগুলো সাধারণত ব্যবহার করা হয় তা হলো এই: হজরত ঈসা মসীহের জন্মের হাজার বছর আগে, হজরত ইশাইয়া নবি বনি-ইসরাইলদের অবাধ্যতা ও মসীহকে অগ্রাহ্য করার বিষয়ে যে ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন, তার উদ্ধৃতি ইঞ্জিল শরিফে দেওয়া হয়েছে। মসীহ যে তাদের জন্যই আসবেন ও পরবর্তিতে এসেছেন, তাই বোঝা যায়। কালামে লেখা আছে, “গরু তার মালিককে চেনে, গাধাও তার মালিকের যাবপাত্র চেনে; কিন্তু ইসরাইল তার মালিককে চেনে না, আমার বান্দারা আমাকে বোঝে না” (ইশাইয়া ১:৩)। হজরত ঈসার জন্মের আগে ফেরেশতা বিবি মরিয়মের কাছে এসে বলেছিলেন, “তুমি তাঁর নাম ঈসা রাখবে, কারণ তিনি তাঁর লোকদের তাদের গুনাহ থেকে নাজাত দেবেন” (মথি ১:২১)। হজরত ঈসা তাঁর কাজ শুরু করার পর, পরজাতি এক মহিলা উপকার চাইলে, হজরত ঈসা বলেছিলেন, ‘সন্তানদের খাবার নিয়ে কুকুরদের দেওয়া উচিত নয়।’ এতেও হজরত ঈসার বনি-ইসরাইলদের পক্ষপাতিত্ব করেছেন বলে মনে হয়।

অতপর হজরত ঈসা বেহেশতে চলে যাবার পর হজরত পিতর ইসরাইলদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “আল্লাহ তাঁকেই বাদশাহ ও নাজাতদাতা হিসাবে নিজের ডানপাশে বসবার গৌরব দান করেছেন, যাতে তিনি বনি-ইসরাইলদের তওবা করবার সুযোগ দিয়ে, গুনাহের মাফ দান করতে পারেন” (প্রেরিত ৫:৩১)।

এগুলোই শেষ কথা নয়, আরো কথা আছে। বনি-ইসরাইল জাতির জন্য তাঁর আগমনের স্বীকৃতিতে যেমন আয়াত আছে, তার চেয়ে ঢের বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য মসীহের আগমনের বিষয়ে। শুধু হজরত ঈসা মসীহ নন, পৃথিবীতে যত মহাপুরুষ এসেছিলেন তারা কেউ কোন বিশেষ গোত্রের জন্য আসেন নি, এসেছিলেন সকল মানুষের জন্য। নবিরা সকল মানুষকেই হেদায়েত করতেন আর যারা নবির কথা শুনতো তারা রক্ষা পেত। তেমনি হজরত ঈসাও যে কেবল ইসরাইলদের জন্য আসেন নি বরং দুনিয়ার সকল লোকদের জন্য এসেছিলেন, তা নিচের দেয়া আয়াতগুলো থেকে পরিষ্কার বোঝা যায়।

ইঞ্জিল শরিফে হজরত ঈসা নিজে বলেন, “আল্লাহ মানুষকে এত মহব্বত করলেন যে, তাঁর একমাত্র পুত্রকে দান করলেন যেন যে কেউ তাঁর উপর ঈমান আনে সে বিনষ্ট না হয় কিন্তু অনন্ত জীবন পায়” (ইউহোন্না ৩:১৬)। এই আয়াতে তিনি বনি-ইসলাইলদের কথা না বলে, মানুষকে বলেছেন। আর মানুষ বলতে পৃথিবীর সকল মানুষকে বোঝানো হয়েছে। কোন বিশেষ জাতি বা গোষ্ঠীর প্রশ্নই আসে না। আল্লাহ মানুষের দুঃখ দুর্দশা লাঘবের জন্যই মসীহকে এই দুনিয়াতে পাঠিয়েছিলেন। দুঃখার্ত মানুষের প্রতি সদয় হয়ে তাঁর আহ্বান, “তোমরা যারা ক্লান্ত ও বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছ, তোমরা সবাই আমার কাছে এস; আমি তোমাদের বিশ্রাম দেব” (মথি ১১:২৮)। হজরত ঈসা তাঁর বেহেশতে যাবার সময় শেষ আদেশ দিয়েছিলেন এভাবে, “বেহেশতের ও দুনিয়ার সমস্ত ক্ষমতা আমাকে দেওয়া হয়েছে। এই জন্য তোমরা গিয়ে সমস্ত জাতির লোকদের আমার উম্মত কর” (মথি ২৮:১৯)। হজরত ঈসা যদি কেবল ইসরাইল জাতির জন্য আসতেন তবে তিনি সমস্ত জাতি উল্লেখ করতেন না। এখানে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে যেন সকল জাতির লোকদের কাছে যাওয়া হয়।

একদিন কোন এক পরিবারে শিক্ষা দেবার সময়, হজরত ঈসার মা ও ভাইয়েরা তাঁকে ডাকতে এসে ঘরের বাইরে দাঁড়িয়েছিলেন। কেউ গিয়ে হজরত ঈসাকে একথা জানালো, হজরত ঈসা তাদের বলেছিলেন, ‘আমার মা ও ভাই তারাই যারা আমার উপর ঈমান আনে এবং আমার শিক্ষা কাজে লাগায়।’ আমরা জানি হজরত ঈসা নিজে ব্যক্তিগত জীবনে পিতামাতার বাধ্য ছিলেন। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে তিনি এই দুনিয়াতে এসেছিলেন তা ছিল গোটা মানব জাতির উদ্ধার। আর সেই মানব জাতির মধ্যে তাঁর মা ও ভাইয়েরাও পড়ে। তাই হজরত ঈসার মা নিজেও হজরত ঈসাকে প্রভু বলে ডাকতেন। হজরত ঈসা বিবি মরিয়মের গর্ভে জন্মেছিলেন সত্য কিন্তু তিনি পবিত্র আত্মা বা পাকরুহ থেকে জন্মেছিলেন।

বনি-ইসরাইল জাতির মধ্যে শামাউন নামে একজন মহান ও ধার্মিক ব্যক্তি ছিলেন। তিনি মসীহের অপেক্ষায় ছিলেন। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, মসীহকে না দেখা পর্যন্ত তিনি মারা যাবেন না। তাঁর ঈমানের জোরে তিনি মসীহকে দেখা পর্যন্ত বেঁচেছিলেন। তিনি তাঁর বাণীতে হজরত ঈসার আগমনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, “… মানুষকে নাজাত করবার জন্য সমস্ত লোকের চোখের সামনে তুমি যে ব্যবস্থা করেছ, আমি তা দেখতে পেয়েছি (লূক ২:৩০)। তিনি যদিও ইসরাইল জাতির লোক ছিলেন, তথাপি তিনি বলেন নি ইসরাইলকে, বলেছেন মানুষকে। অর্থাৎ আল্লাহর পরিকল্পনা কোন বিশেষ জাতির জন্য হতে পারে না, হলে তিনি পক্ষপাতদুষ্ট হবেন, সকলের সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাঁর অনন্ত পরিকল্পনা সকল লোকের জন্যই করেছেন।

এক অর্থে বলা যায়, তিনি ইহুদিদের জন্যই এসেছিলেন, আর সেই ইহুদি হলো আসল ইহুদি। “বাইরের দিক থেকে যে ইহুদি সে আসল ইহুদি নয়, শরীরের বাইরে খৎনা করানো হলেই যে আসল খৎনা করা হলো তাও নয়। কিন্তু দিলে ইহুদি সে-ই আসল ইহুদি” (রোমীয় ২:২৮, ২৯)।

হজরত ইব্রাহিমের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করা হয়েছিল তা ঈমানের মধ্যদিয়েই পূর্ণতা পেয়েছে। কারণ হজরত ইবরাহিম ঈমানের মাধ্যমেই ধার্মিক গণিত হয়েছিলেন। শরিয়তের হুকুম পালনের মধ্যদিয়ে হজরত ইবরাহিম ধার্মিক গণিত হননি কারণ তখন শরিয়ত আসেও নি। এর কারণ হলো, “শরিয়ত পালন করেই যদি কেউ দুনিয়ার অধিকার পেয়ে যায়, তবে তো ঈমান অকেজো হয়ে পড়ে আর আল্লাহর সেই ওয়াদারও কোন মূল্য থাকে না, কারণ শরিয়ত আল্লাহর গজবকে ডেকে আনে” (৪:১৪,১৫)। কিন্তু হজরত ঈসার জীবন দর্শন শরিয়ত নয়, তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য হলো ঈমানের মাধ্যমে নাজাত। যেমন করে হজরত ইবরাহিম কেবল ঈমানের দ্বারাই ধার্মিক হয়েছিলেন। এতে বোঝা যায় যে, তিনি কেবল ইসরাইল জাতি তথা শরিয়ত পালনকারী লোকদের জন্য আসেননি, এসেছেন পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য (রোমীয় ৪:২৩,২৪)।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০