Category Archives: সাধারণ বিশ্বাস

ঈসায়ীরা রক্তের কথা কেন বলে? রক্তপাত তো নিষিদ্ধ?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

ঈসায়ীরা মানুষের রক্তপাতের কথা বলে না, বলে ঈসা মসীহের রক্তপাতের কথা।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

রক্তেই থাকে শরীরের প্রাণ। এইজন্য রক্তপাত দ্বারা গুনাহর জন্য কাফফারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল আগের কিতাবের সময়। আল্লাহ নিজেই এই ব্যবস্থা স্থাপন করেছিলেন। হজরত আদমের গুনাহর ফলে, যখন লজ্জা প্রকাশ পেয়েছিল, তখন আদম-হাওয়া পাতার পোশাক পরেছিলেন কিন্তু আল্লাহ পশুর চামড়া পরিয়ে দিয়ে, প্রমাণ করলেন যে পাপ ঢাকা দেবার জন্য রক্তপাতের প্রয়োজন আছে। পাপ ঢাকা দেবার জন্য আল্লাহ বনি-ইসরাইল জাতিকে নানা রকম কোরবানির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু পশুর রক্তে মানুষের পাপ ঢাকা যায় না। তাহলে তিনি কেন তা চালু করেছিলেন? পশু কোরবানি ছিল আসল কোরবানির ছায়ামাত্র। পশু কোরবানি দিয়ে আল্লাহ মানুষকে আসল কোরবানির জন্য প্রস্তুত করেছেন। আসল কোরবানি হলেন হজরত ঈসা মসীহ, যিনি স্বেচ্ছায় কোরবানি হয়ে, নিজের রক্ত ঢেলে মানুষের গুনাহর কাফফারা দিয়েছিলেন। হজরত ঈসার রক্ত মানুষকে গুনাহ থেকে নাজাত দেয়।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

যাদু, তাবিজ, কবজ, ঝাড়-ফুক, মাজার-খানকা ইত্যাদি বিষয়ে ঈসায়ীদের দৃষ্টিভঙ্গি কী?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

ঈসায়ীরা এসবে বিশ্বাস করে না।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

যারা যাদু, তাবিজ, কবজ, ঝাড়-ফুকে বিশ্বাসী, তারা প্রকৃত অর্থে আল্লাহর উপর আস্থা রাখে না। তাদের আচরণে প্রকাশ করে যে, আল্লাহর চেয়েও যাদু, তাবিজ, কবজ, ঝাড়-ফুকের শক্তি বেশি। কিন্তু আল্লাহ হলেন স্বগৌরব রক্ষণে উদ্যোগী আল্লাহ। আল্লাহ তাঁর পাওনা সম্মান কাউকে দেন না। আল্লাহর কালামে আল্লাহ নিজেই বলেন, “কোন জাদুকারিণীকে বেঁচে থাকতে দেবে না” (হিজরত ২২:১৮)। যাদুকরদের কাজ হলো নিজের চালাকি দিয়ে কিছু তৈরি করা বা কোনকিছু ঘটানো, যা অবিশ্বাস্য বা অলৌকিক এবং এর মধ্যদিয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা ও কোন কোন ক্ষেত্রে মানুষকে ঠকিয়ে পয়সা উপার্জন করা। আমরা জানি যে, আল্লাহ কোন কোন নবিকে বিশেষ উদ্দেশ্যে এমন মোজেজা দেখাবার ক্ষমতা দিয়েছিলেন। আর সেই ক্ষমতা ব্যবহার করার মধ্যদিয়ে, আল্লাহর গৌরব হয়েছে। মানুষ আল্লাহর ক্ষমতাকে জেনেছে। যেমন হজরত মুসা, হারুন, ইলিয়াস, আলিছা, শামূয়েল, ঈসা প্রমুখ নবিগণসহ আরো বেশ কয়েকজন নবিকে এরূপ কিছু ক্ষমতা আল্লাহ দিয়েছিলেন। যারা এসব অলৌকিক কাজ করেছেন। তারা সেসব কাজের মধ্যদিয়ে মহান আল্লাহর গৌরব বয়ে এনেছেন। মানুষ আল্লাহকে সম্মান ও ভয় করতে শিখেছে।

যারা রোগ-ব্যাধি, আয়-উন্নতি ইত্যাদির জন্য ভূতের আশ্রয় নেয়, তারা এসব কাজের মধ্যদিয়ে আল্লাহর অগৌরব করে। তারা তাদের এই কাজের মধ্যদিয়ে প্রকাশ করে যে, আল্লাহ তাদের রোগ-ব্যাধি থেকে সুস্থ করতে পারে না, আয়-উন্নতিও দিতে পারে না; বরং তাবিজ কবজ বা ভূতেরাই পারে। অথচ আল্লাহ তাঁর কালামে বলেন যেন আমরা মুনাজাতের মধ্যদিয়ে তার কাছে সরাসরি চাই। হজরত ঈসার উম্মতেরা তাঁর মধ্যদিয়ে, মুনাজাতের দ্বারা তাদের প্রয়োজনের কথা আল্লাহর কাছে বলার সুযোগ পেয়েছে। তাদের ভূতের কাছে যাবার কোন প্রয়োজন নেই। আল্লাহর কালামে লেখা আছে, “যারা ভূতের মাধ্যম হয় কিংবা যারা ভূতের সঙ্গে সম্বন্ধ রাখে তাদের কাছে যাওয়া চলবে না, কারণ তারা তোমাদের নাপাক করে তুলবে” (লেবীয় ১৯:৩১)। অতএব, যাদুবিদ্যা, ভূত-প্রেত-মাজার ইত্যাদির উপর বিশ্বাস এবং নির্ভরতা ঈসায়ীদের জন্য কোনভাবেই কাম্য নয়।

আল্লাহ মানুষকে তাঁর কালাম দিয়েছেন পড়ার জন্য এবং কালামে যা যা লেখা আছে তা নিজের জীবনে কাজে লাগানোর জন্য। আল্লাহ চান, তাঁর কালামের মধ্যে তিনি তাঁর যে ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন, তা যেন আমরা পালন করি। কিন্তু তা না করে যদি আমরা সেই কালামকে অথবা কালামে উল্লেখিত কোন গাছ অথবা তার শিকড়কে কিংবা কোন মাঝারের পানিকে, মাটিকে, তাবিজ-কবজ বানিয়ে গলায় ঝুলিয়ে রাখি বা হাতে বেঁধে রাখি তবে আল্লাহ অবশ্যই অসন্তুষ্ট হবেন।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

ঈসায়ীরা কি ভাগ্য বা নিয়তি মানে?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

না, ঈসায়ীরা ভাগ্য বা নিয়তিতে বিশ্বাস করে না।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

ভাগ্যে যারা বিশ্বাস করেন, তাদের কথা হলো ভাগ্যে বা অদৃষ্টে যা লেখা আছে তা ঘটবেই, কোনভাবেই তা ফেরানো যাবে না। এর মানে এই যে, মানুষের কী হবে না হবে তা আগেই লেখা আছে। তাতে একজন মানুষ যা-ই করুক না কেন, কোনভাবেই তার ব্যতিক্রম হবে না। এই ধারণা অনুযায়ী মানুষ কাঠের পুতুলের মতো, তার নিজস্বতা বলতে কিছু নেই। পুতুলের মালিক যেমন করে তাকে নাচায় ঠিক তেমনি করে সে নাচে। সে নিজে ইচ্ছা করে কিছু করতে পারে না, তাকে দিয়ে যা করানো হয় কেবল তা করে।

আমরা এরূপ বিশ্বাস করি না। আমরা বিশ্বাস করি, ভাগ্যের নিয়ন্তা হচ্ছেন আল্লাহ স্বয়ং। আল্লাহ সবসময় তাঁর সন্তানদের মঙ্গল কামনা করেন এবং যা তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো তাই করে থাকেন। আল্লাহ যখন মানুষ সৃষ্টি করেন তখন, তিনি তাঁর আপন সুরত ও সিফত দিয়ে সৃষ্টি করেন। এর মানে হলো আল্লাহ মানুষকে তাঁরই মতো ইচ্ছা, আবেগ ও অনুভূতি দিয়ে তৈরি করেন। মানুষ কাঠের পুতুলের মতো নয়, ইচ্ছা করলে সে কোনকিছুু পছন্দ করতে পারে, ভালোমন্দ বেছে নিতে পারে। ভালোকিছু বেছে নিয়ে, তার জন্য ভালো ভবিষ্যত নির্মাণ করতে পারে, আবার খারাপ কিছু পছন্দ করে দুর্ভাগ্য টেনে আনতে পারে।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০

ফেরেশতা, নবি, কেয়ামত, শেষবিচার, বেহেস্ত, দোজখ সম্পর্কে ঈসায়ীদের সাধারণ বিশ্বাস কী?

সংক্ষিপ্ত উত্তর:

বর্ণিত সবকিছু সম্পর্কে ঈসায়ীরা সাধারণভাবে বিশ্বাস করে।

ব্যাখ্যামূলক উত্তর:

উপরিউক্ত বিষয়গুলোতে বিশ্বাসের প্রশ্ন দেখা দিলে বলতে হয় যে, এদের প্রত্যেকটা সম্পর্কে কিতাবুল মোকাদ্দসে নির্দিষ্ট সীমারেখা অনুসারেই ঈসায়ীরা বিশ্বাস করে। এসব সম্পর্কে সমাজে নানা গল্প এবং কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। আমরা সরাসরি যতটুকু আল্লাহর কালামে লেখা আছে, ততটুকু বিশ্বাস করি, এর বাইরে কোন বিন্দু বিসর্গে আমাদের আস্থা নেই। উদাহরণ স্বরূপ:

ফেরেশতা: আমরা যতদূর আল্লাহর কালাম থেকে জানি, সৃষ্টির সময় আল্লাহ ফেরেশতাদের সৃষ্টি করেছিলেন। পাককালামে লেখা আছে, আল্লাহর বিস্ময়কর সৃষ্টিকাজ দেখে, ফেরেশতারা আল্লাহর প্রশংসা করেছিলেন। ফেরেশতাদের সম্পর্কে নানা ধর্মে নানা মতবাদ থাকলেও আমরা কালাম অনুসারে বিশ্বাস করি যে, ফেরেশতারা আল্লাহর সৃষ্ট আত্মা যাদের তাঁর সেবা করার জন্য এবং তাঁর সংবাদ বাহক হিসাবে তিনি তৈরি করেছেন। এই ফেরেশতাদের মধ্যে কিছু ফেরেশতা, সবচেয়ে বড় ও সুন্দর ফেরেশতা লুসিফারের সাথে আল্লাহর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে যোগ দিয়ে, শয়তানের অনুসারী বা মন্দ আত্মায় পরিণত হয়েছে। এসব মন্দ আত্মারা মহাশাস্তির অপেক্ষায় আছে। আর মানুষকে মন্দতায় টেনে নেবার জন্য সর্বক্ষণ চেষ্টা চালাচ্ছে। তবে এই মন্দ আত্মারা ঈসার উম্মতদের তেমন ক্ষতি করতে পারে না। কারণ হজরত ঈসা মন্দ আত্মার সকল শক্তি থেকে তাঁর উম্মতদের উদ্ধার করেছেন।

নবি: নবি মানে ভাববাদী, যিনি ভবিষ্যতের কথা বলেন। পাককিতাবের মধ্যে অনেক নবির বিষয়ে আমরা জাতে পাই; কোন দেশ বা ব্যক্তি যখন আল্লাহর কথা ভুলে গিয়ে পাপ, অনাচার, অবিচার ইত্যাদির মধ্যে গা ভাসিয়েছে তখন আল্লাহ নবিদের পাঠাতেন যারা ব্যক্তি, সমষ্টি এমন কি কোন দেশের বিপক্ষে ভবিষ্যত বাণী করতেন। নবিরা মাঝে মাঝে মানুষকে সৎ পথের বিষয়ে শিক্ষাও দিতেন। নবিদের কথা যারা শোনেনি তারা নানা শাস্তি লাভ করতো আর যারা শুনতো তারা আল্লাহর আশ্রয় ও রহমত লাভ করতো।

কেয়ামত: কেয়ামত মানে শেষকাল। আমরা শেষকাল সম্পর্কে বিশ্বাস করি। কেয়ামতের অনেক আলামত সম্পর্কে ইঞ্জিল শরিফে বর্ণিত আছে। কেয়ামতের সবচেয়ে বড় আলামতগুলোর মধ্যে ভীষণ দুর্ভিক্ষ, মহামারি, ভূমিকম্পের উল্লেখ আছে। সবচেয়ে বড় আলামত হলো, হজরত ঈসা মসীহ দ্বিতীয়বার পৃথিবীতে আসবেন। কেয়ামত সম্পর্কে হজরত ঈসা বলেন, “তোমাদের কানে যুদ্ধের আওয়াজ আসবে আর যুদ্ধের খবরাখবরও তোমরা শুনতে পাবে। কিন্তু সাবধান! এতে ভয় পেয়ো না কারণ এই সব হবেই; কিন্তু তখনও শেষ নয় এক জাতি অন্য জাতির বিরুেেদ্ধ এবং এক রাজ্য অন্য রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। অনেক জায়গায় দুর্ভিক্ষ ও ভূমিকম্প হবে। কিন্তু এসবই যন্ত্রণার শুরু” (ইঞ্জিল শরিফ, মথি ২৪:৬-৮)।

আরো লেখা আছে, “সেই সময়কার কষ্টের ঠিক পরেই সূর্য অন্ধকার হয়ে যাবে, চাঁদ আর আলো দেবে না, তারাগুলো আসমান থেকে খসে পড়ে যাবে এবং চাঁদ-সূর্য-তারা আর স্থির থাকবে না। এমন সময় আসমানে ইবনে-আদমের চিহ্ন দেখা দেবে। তখন দুনিয়ার সমস্ত লোক দুঃখে বুক চাপড়াবে। তারা ইবনে-আদমকে শক্তি ও মহিমার সঙ্গে মেঘে করে আসতে দেখবে। জোরে জোরে শিঙা বেজে উঠবে আর সঙ্গে সঙ্গে ইবনে-আদম তার ফেরেশতাদের পাঠিয়ে দেবেন। সেই ফেরেশতারা দুনিয়ার একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত চার দিক থেকে তাঁর বাছাই করা বান্দাদের একসঙ্গে জমায়েত করবেন” (ইঞ্জিল শরিফ, মথি ২৪:২৯-৩১)।

শেষবিচার: শেষবিচার সম্বন্ধে আমাদের বিশ্বাস হলো, হজরত ঈসাই মানুষের শেষ বিচার করবেন। “সেইসময় সমস্ত জাতির লোকদের তাঁর সামনে একসঙ্গে জমায়েত করা হবে। রাখাল যেমন ভেড়া আর ছাগল আলাদা করে, তেমনি তিনি সব লোকদের দু’ভাগে আলাদা করবেন। তিনি নিজের ডানদিকে ভেড়াদের আর বাঁদিকে ছগলদের রাখবেন। এরপরে বাদশাহ তাঁর ডানদিকের লোকদের বলবেন, ‘তোমরা যারা আমার পিতার দোয়া পেয়েছ, এস। দুনিয়ার শুরুতে যে রাজ্য তোমাদের জন্য প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে, তার অধিকারী হও।… পরে তিনি বাঁদিকের লোকদের বলবেন, বদদোয়াপ্রাপ্ত লোকেরা, আমার কাছ থেকে দূর হও। ইবলিশ এবং তার ফেরেশতাদের জন্য যেআগুন প্রস্তুত করা হয়েছে, তার মধ্যে যাও” (মথি ২৫:৩২-৪১)। তিনি ঈমানদাদেরও বিচার করবেন। তবে সেই বিচার হবে ভালো কাজের পুরস্কার দেবার জন্য। যারা বিশ্বস্তভাবে ভালো কাজ করেছেন, তিনি তাদের মূল্যায়ন করে পুরস্কার দেবেন।

উৎস: শত প্রশ্নের হাজার উত্তর, আবু তাহের চৌধুরী, ২০১০